লালমনিরহাট বার্তা
প্রতিবন্ধী একরামুলের এক পায়ের যুদ্ধ গাছের ডাল কেটে চলে সংসার
রংপুর অফিসঃ | ১০ জানু, ২০২২, ১১:৫১ AM
প্রতিবন্ধী একরামুলের এক পায়ের যুদ্ধ গাছের ডাল কেটে চলে সংসার
রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার সারাই ইউনিয়নের মদামুদন দক্ষিণপাড়ার দিনমজুুর আব্দুল করিমের তৃতীয় ছেলে একরামুল হক।শৈশব, কৈশোর পেরিয়ে এখন যুবক একরামুল হক (৩২)। আর দশটা শিশুর মতোই স্বাভাবিক জন্ম হয়েছিল তারও। তবে কখনো সৌভাগ্য হয়ে ওঠেনি দুই পায়ে ভর দিয়ে হাঁটাচলা করার কিংবা দৌড়ানোর। হামাগুড়ি দিয়ে চলতে শেখা শিশু একরামুল কিছু বোঝার আগেই হারিয়ে ফেলেন দূরন্ত শৈশব-কৈশোরের সোনালী দিন। পোলিও রোগে আক্রান্ত হয়ে হারিয়ে ফেলেন একটি পায়ের কর্মক্ষমতা।তাই বলে তো আর থেমে যেতে পারে না স্বপ্ন কিংবা স্বাধ। এক পা নিয়েই জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন ।
বাড়িতে রয়েছে মা-বাবা ও স্বামী পরিত্যক্তা বোন। রয়েছে সন্তান সম্ভাবা স্ত্রী। সংসারের ঘানি টানতে গিয়ে ভিক্ষাবৃত্তিতে না জড়িয়ে একরামুল গাছের ডালে খুঁজে ফেরেন অনাগত দিনের চাওয়া-পাওয়া। এভাবেই চলছে তার বেঁচে থাকার লড়াই। প্রতিবন্ধিতাকে ছাপিয়ে গ্রামে গাছকাটা একরামুল নামেই এখন বেশ পরিচিত তিনি। ডাক আসলেই ছুটে যান এক গ্রাম ছেড়ে অন্য গ্রামে। শহরের অলি-গলি থেকে শুরু করে সবখানে।
একরামুলের বড় দুই ভাইয়ের মধ্যে একজন দিনমজুরি করেন। বিয়ে করে তিনি আলাদা হয়েছেন। মেজোভাই রাজমিস্ত্রীর কাজ করতে গিয়ে পরিবার নিয়ে থাকেন শহরে। একমাত্র ছোট বোনের বিয়ে হলেও সংসার টেকেনি বেশিদিন। ডিভোর্স হয়ে এখন বাবার বাড়িতেই অবস্থান করছেন তিনি। মাত্র চার শতক জমির ওপর তাদের বসতভিটা। এছাড়া আর কোনো সহায়-সম্পদ নেই।
হামাগুড়ি দিয়ে স্কুলে যাওয়া শুরু হলেও অভাবের তাড়নায় মুছে যায় একরামুলের সে স্বপ্ন। স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করে পাঠ চুকে ফেলেন। এরপর শুরু হয় জঠর জ্বালা নিবারনের বেঁচে থাকার লড়াই।প্রতিবন্ধী হয়েও ভিক্ষাবৃত্তিতে না জড়িয়ে কেন গাছের ডালকাটা পেশা বেছে নিয়েছেন সে।
প্রতিবন্ধি একরামুল বলেন, ইচ্ছে ছিল পড়ালেখা শিখে ভালো কিছু করার। কিন্তু অভাবের তাড়নায় সেটা যখন সম্ভব হয়ে উঠেনি।তারপর নিজে কিছু একটা কাজ করার জন্য চেষ্টা করতে থাকি। এক পায়ে ভর দিয়ে গাছে উঠতে শুরু করি। প্রতিবেশীরা বিভিন্ন গাছের ডাল কাটতে ডাকলে ছুটে যাই। এর বিনিময়ে ৫/১০টাকা করে পেতাম। এভাবে ধীরে ধীরে গাছে ওঠা এবং ডাল কেটে আয় বাড়তে থাকে।
একরামুল বলেন, নিজ গ্রাম ছাড়াও আশেপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ডাক আসতে থাকে। কোনো কিছুর সহায়তা ছাড়াই সব ধরনের গাছে উঠে ডাল কেটে কেটে তা পরিস্কার করে দেই। এর বিনিময়ে মজুরিও বাড়তে থাকে। একটা গাছে উঠলে ৫০ থেকে ১শ, দেড়শো টাকা পর্যন্ত দিয়ে থাকেন মালিকরা। এভাবে দৈনিক দুই-আড়াইশো টাকা আয় হয়। তা দিয়ে এবং সমাজসেবা অধিদফতর থেকে পাওয়া ভাতার টাকা দিয়ে চলে সংসারের খরচ।
দুই বছর আগে বিয়ে করেছেন একরামুল। স্ত্রী এখন সন্তান সম্ভাবা। মা-বাবা ও বোন ছাড়াও স্ত্রী এবং অনাগত সন্তানের কথা ভেবে চিন্তিত একরামুল। তবু অন্যের দ্বারে দ্বারে হাত পাততে চান না। যতদিন শরীরে শক্তি ও মনে জোর আছে ততদিন কাজ করেই কুড়ে ঘড়ে থেকেই খেতে-পড়তে চান।একরামুল আরো বলেন, চাইলেই ভিক্ষাবৃত্তি করে কিছু টাকা আয় করতে পেতাম। কিন্তু সেটা ভালো কাজ না। বছরের সবসসময় গাছের ডাল কাটা হয় না। যখন কাজ থাকে না তখন সমস্যায় পড়তে হয়। এজন্য সরকারিভাবে বা বিত্তশালীদের কাছ থেকে স্থায়ী কোনো কর্মসংস্থানের সুযোগ পেলে উপকৃত হতাম।
মদামুদন দক্ষিণপাড়া গ্রামের মোকলেছুর রহমান বলেন, একরামুল মানুষের কাছে হাত পাতে না। সে কাজ করে খায়। এক পা নিয়েই সে এক গাছে উঠে অন্য গাছে চলে যায়। তার সাহসিকতা ও কর্মদক্ষতা দেখে আমরা মুগ্ধ হই। সরকারিভাবে যদি তাকে পর্যাপ্ত সহায়তা করা হতো তাহলে তার জীবনটা আরও সুন্দর ও সুখের হতো।
একরামুলের বাবা আব্দুল করিম বলেন, বাড়িভিটাসহ ৩ বিঘা জমি ছিল তার। ছেলের চিকিৎসায় জমি বিক্রি করতে হয়েছে। এখন সংসারে অভাব থাকলেও ছেলেকে ভিক্ষাবৃত্তি করতে দেইনি। তাকে বলেছি, জীবনে কখনো মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে হাত পাতা যাবেনা। সে নিজের চেষ্টায় গাছে ওঠা ও ডাল কাটা শিখেছে। এখন সেখান থেকে যা পায় তাই দিয়ে কোনোরকমে সংসারের খবর চালায়।
সারাই ইউনিয়নের মদামুদন দক্ষিণপাড়ার স্থানীয় ৭ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সামুসদ্দিন মিয়া বলেন, সমাজসেবা অধিদফতর থেকে তাকে প্রতিবন্ধী ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আরও কোনো সরকারি সহায়তা করা যায় কিনা তা চেষ্টা করা হবে।
এই বিভাগের আরও খবর