লালমনিরহাট বার্তা
গীতিকার ও সুরকার রবীন্দ্রনাথ মিশ্র সম্পর্কে--“আত্মকথা”
সুভাষ চন্দ্র রায় | ১৫ অক্টো, ২০২৩, ৫:১১ AM
গীতিকার ও সুরকার রবীন্দ্রনাথ মিশ্র সম্পর্কে--“আত্মকথা”

সময়টা সম্ভবত ১৯৭৬ খৃষ্টাব্দের মার্চ কিংবা এপ্রিল মাস। আমি তখন বাংলাদেশ বেতার, রংপুর কেন্দ্রের একজন তালিকাভূক্ত পল্লীগীতি ও ভাওয়াইয়ার কন্ঠশিল্পী। বেতারে প্রোগ্রাম করে সন্ধ্যার পর বাড়িতে ফিরছিলাম। পথে রাস্তার ধারে (শিববাড়ি) কালি কান্ত বর্মণের বাড়িতে ভক্তিমুলক গানের আসর (হরিরলুট) চলছিল। আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে গানগুলি শুনছিলাম,এক সময় লোপ সংবরণ করতে না পেরে বাড়িতে ঢুকে পড়লাম। দেখলাম গেরুয়া পোশাক পরিহিত লম্বাচুল খোঁপা বাঁধা,লম্বাদাড়ি ওয়ালা সুঠাম দেহের মানুষটি (রবীন্দ্রনাথ মিশ্র) নেচে-নেচে ভজন-কীর্তন করছেন,সে কি-যে ভাব আর আনন্দ। ওনারাও সকলে আমাকে পেয়ে সীমাহীন খুশী,কারন তখনতো এত বেতার শিল্পী ছিলনা। আমিও সেখানে দু'একটি গান করলাম।আমি তাঁর গান গুলোর কথা জিজ্ঞাসা করতেই উনি বললেন,"আমার লেখা- আসলে ভাল হয়নি"।সেদিন থেকেই তাঁর সঙ্গে আমার হৃদ্যতা গড়ে ওঠা।

সে সময় আমার বাড়িতেও আমরা কয়েকজন নিয়মিত গান গাইতে বসতাম। পরদিন থেকে রবিদা যোগ দেওয়ায় আরও আসর জমে গেলো।সেদিন তাঁর গানগুলো বেতারে গাওয়ার অনুমতি চাওয়ায় তিনি এতটাই আনন্দিত হলেন যে, আমি সম্ভবত আমার পরবর্তী প্রোগ্রামেই তাঁর লেখা ও সুরে একটি গান রেকর্ড করেছিলাম।পরবর্তীতে রবিদার বাড়িসহ তরনী কান্ত রায় এর বাড়িতেও আমাদের সঙ্গীতের আসর বসা শুরু হলো।সে সময় অনেকেই আসতেন,তার মধ্যে নীল কমল মিশ্র(তাঁর ছোটভাই), তরনী কান্ত রায়, মোজাম্মেল হক, ইয়াছিন আলী, চিন্ময় মজুমদার, শৈলেন রায়,সত্যেন্দ্র নাথ রায়, মনোরঞ্জন রায়, ধনেশ বনিক, সুভাষ সরকার, ভূপতি ভূষণ বর্মা,আশীষ বনিক, মোহাম্মদ কাফি, বিমল রায় আরও অনেকে।

এভাবে রবিদার গানগুলো অনেকের নজরে আসলো। ইতোমধ্যে বেশকিছু গান আমি বেতারে রেকর্ড করায় এবং প্রচার হয়ায়,সে সময়ে বেতারের মূখ্য মিউজিক প্রোডিউচার শ্রদ্ধেয় সিরাজ উদ্দিন আহমেদ আমাকে রবিদার ২৫টি পল্লীগীতি এবং ২৫টি ভাওয়াইয়া গানের পান্ডুলিপি বেতারে জমা দেওয়ার জন্য বলেন। আমরা সেভাবেই কাজ করলাম। পরবর্তীতে সিলেকশন বোর্ডে গানগুলি অনুমোদিত হয়ায়, আঞ্চলিক পরিচালক মহোদয় রবিদাকে ডেকে পাঠান। কিন্তু এখানেই যত বিপত্তি, কারন তিনি সে সময় শুধুমাত্র একটি গেরুয়া কাপড় পরিহিত থাকতেন, চুল খোঁপা বাঁধা,লম্বা দাড়ি এবং কোন কাটা কাপড় পরতেন না। আমি ওনাকে অনুরোধ করে শেষে শুধু একটা পাঞ্জাবী গায়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করলাম।

আঞ্চলিক পরিচালক মহোদয় ওনাকে দেখেই বলেছিলেন,আপনি তো সাধক মানুষ,আপনার গানগুলো আমি দেখেছি খুব ভাল লিখেন এবং সেদিনই ওনার হাতে গীতিকারের চুক্তিপত্র খানা দিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে শ্রদ্ধেয় সিরাজ উদ্দিন ভাই এর মূখ্য ভূমিকা ছিল।সে সময় আমাদের অঞ্চলে পল্লীগীতি ও ভাওয়াইয়ার খুব একটা গীতিকার ছিল না। কুড়িগ্রামে ওস্তাদ কছিমুদ্দিন আহমেদ, জনাব নুরুল ইসলাম জাহিদ এবং রংপুরে জনাব সিরাজ উদ্দিন সাহেবের নিকট থেকে আমাদের গান সংগ্রহ করে গাইতে হতো।এরপর রবিদা গীতিকার হওয়ায় আমি ব্যাক্তিগত ভাবে খুবেই উপকৃত হয়েছি। তাঁর কোন গানের ডাইরী বা খাতা ছিলনা। গান লিখে সুর করে গাওয়ার পর আর কোন পান্ডুলিপির খোঁজ রাখতেন না, এভাবে তাঁর অনেক গান হারিয়ে গিয়েছে। তিনি গীতিকার হওয়ার পর,গানগুলো খাতায় সংরক্ষণ করা শুরু করেন। আমি দেখেছি তাঁর কি এক বিরল প্রতিভা, আমার বাড়িতে এসে আমার গানের ডাইরীতে গান লিখে,সুর করে আমাকে উঠিয়ে দিতেন। তাঁর কখনও অহমিকা দেখিনি,গান লেখায় বা সুরে ভাল না লাগলে আমাকে বলতো, দেখতো ভাই কি করা যায়? বড় খোলা মনের মানুষ ছিলেন।

আমার জানামতে তিনি তাঁর সম্পর্কে কাকু প্রতিবেশী বাবু জীতেন্দ্র নাথ ঝাঁ মহাশয়ের নিকট গান শিখেছেন। তিনিও এক সঙ্গীত পাগল মানুষ ছিলেন। তিনি নিজেও একটা ঝুমুর যাত্রাদল পরিচালনা করতেন। রবীন্দ্রনাথ নাথ মিশ্র সে দলের হারমনিয়াম মাষ্টার ছিলেন। এছাড়াও নাট্যকার, গীতিকার, সুরকার এবং নৃত্য পরিচালকও ছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি ভাল তবলা বাজাতে পারতেন, ছবি আঁকতেন এবং প্রতিমা তৈরীতেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত ।শত কষ্টের মাঝেও তিনি সঙ্গীতে হাল ছাড়েননি। তিনি বড়বাড়ি হাটে একটি সঙ্গীত শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন, যেখানে তিনি বাড়ি থেকে হারমনিয়াম কাঁধে করে নিয়ে এসে গান শেখাতেন। সেখান থেকে অনেক শিল্পী বেতারে তালিকা ভূক্ত হয়ে,সঙ্গীতে আজ সুনাম অর্জন করছেন। অভাবের তারনায় তিনি ছেলে-মেয়েদের নিয়ে সীমাহীন কষ্ট করেছেন। কিন্তু এত কষ্টের মাঝেও আমরা কেউ তাঁকে একটু সহানুভূতি দেখাতে পারিনি। এত দৃঢ়চেতা মানুষ ছিলেন তিনি। এখানে তাঁর সহধর্মিনী ইলা মিশ্রের কথা না বললে নয়, মূলত তিনি প্রচন্ড কষ্ট সহিষ্ণু মহিলা ছিলেন। বাড়িতে গানের আসর চলছে, রবিদা হঠাৎ সকলকে নিমন্ত্রণ দিয়ে বসতেন, যা বৌদিকে ধার-কর্জ করে সব সামাল দিতে হতো। তাঁকে কোনদিন বিরক্ত হতে দেখিনি।

গীতিকার হওয়ার পর আমার সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহন করার সুযোগে, আমি তাঁকে সাধক বেশ থেকে সাধারন বেশে ফিরে নিয়ে আসার চেষ্টা করি এবং সফলও হই। পরবর্তীতে তাঁর সহধর্মিনীর বড়ভাই বাবু পঙ্কজ ভট্টাচার্য এর সহযোগীতায় আর,ডি,আর,এস(রংপুর দিনাজপুর রুরাল সার্ভিস) এ মাঠকর্মী হিসাবে চাকুরীতে যোগদান করেন। ওনার মুখে যতটুকু শুনেছি,চাকুরী ক্ষেত্রেও বাবু জয়ন্ত চক্রবর্তী, প্রনব বিশ্বাস, জনাব একরামুল হক ওনাকে খুব পছন্দ করতেন এবং যথেষ্ট সহযোগীতা করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ নাথ মিশ্র চার সন্তানের জনক। আমার জানামতে তাঁর চতুর্থ সন্তান জন্মের সময় মৃত্যু বরণ করলে, তখন থেকে তাঁর মানুষিক পরিবর্তন আসে, এ হেন পরিবর্তনের কারণে তিনি সাধনার পথে মননিবেশ করেন। তিনি আমার চেয়ে ৩/৪ বৎসরের বড় ছিলেন। তাঁর জন্ম লালমনিরহাট জেলা ও সদর উপজেলাধীন রামদাস গ্রামে ৪ জানুয়ারি ১৯৫০ খৃষ্টাব্দ। তিনি অনেকদিন ধরেই দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যানসারে ভূগছিলেন।তাঁর পরিবার সূত্রে যতটুকু জেনেছি,তিনি রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও বেশ কিছুদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন। সে সময় গীতিকার,সুরকার ও কন্ঠশিল্পী জনাব এ কে এম মোস্তাফিজুর রহমান সাহেব যথেষ্ট সহযোগীতা করেছিলেন। তিনি হাতীবান্ধায় চাকুরীরত অবস্থায় খুব অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। নিজ বাড়িতে ১ ডিসেম্বর ১৯৯৫ খৃষ্টাব্দ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর অনেক গান রংপুর বেতার ছাড়াও খুলনা ও ঠাকুরগাঁও বেতারেও প্রচার হয়েছে।তাঁর শুধু দু'চারটি বিখ্যাত গানের কথা বললে ভুল হবে, তাঁর অনেক গানই মানুষের হৃদয় ছুঁয়েছে। তিনি বেঁচে থাকলে হয়তো লোকসঙ্গীত জগত আরও সমৃদ্ধ হতো। এখানে ভূপতি ভূষণ বর্মার কথা না বললে নয়। ভূপতি আমার ছোট ভগ্নিপতি হিসাবে আমাদের বাড়িতে যাতায়তের সুবাদে রবিদার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠে এবং রবিদাও তাকে খুব স্নেহ করতেন।পরবর্তীতে ভূপতি ভূষণ বর্মা এবং বাবু তরনী কান্ত রায় তাঁর মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত খোঁজ-খবর রেখেছিলেন। তিনি অনেক অভাবের মাঝেও সামাজিক কাজে পিছিয়ে ছিলেন না। তিনি অনেকের অনুরোধে একবার গ্রাম সরকার নির্বাচিত হয়েছিলেন। আমাদের অঞ্চলে অনেক সঙ্গীত একাডেমী এখনও অতি গুরুত্বের সহিত অন্যান্য দেশবরেণ্য শিল্পী-গীতিকার ও সুরকারের মত তাঁর জন্ম ও প্রয়াণ দিবস পালন করে আসছে, আমি তাদের সাধুবাদ জানাই। আমার দূর্ভাগ্য আমি সরকারী চাকুরীতে খুলনা এবং পরবর্তীতে সাতক্ষীরায় কর্মরত থাকায় ১৯৮৫ খৃষ্টাব্দের পরে সেভাবে আর ওনাকে সময় দিতে পারিনি। পরিশেষে বিনম্র শ্রদ্ধা ও তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি।

(জানুয়ারি ২০২১ সরগম পত্রিকায় প্রকাশিত।)

এই বিভাগের আরও খবর