লালমনিরহাট বার্তা
জাতীয় অর্থনীতিতে গ্রামের লোকজন কিভাবে ভুমিকা রাখছে?
ইয়ার আলী | ৬ জুন, ২০২৪, ১০:২০ AM
জাতীয় অর্থনীতিতে গ্রামের লোকজন কিভাবে ভুমিকা রাখছে?

একটি দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কত যে বিশাল এবং ব্যাপক তা যেমন কোন সরকারের পক্ষে সম্পূর্ণভাবে যাচাই করা সম্ভব নয় তেমনি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষেও সম্ভব নয় ।রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সার্বজনীনভাবে অর্থনীতির কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ভাসা ভাসা ভাবে একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়। প্রকৃত পরিসংখ্যান তুলে ধরা অসম্ভব বা কঠিন।অর্থনীতির অনেকগুলো সেক্টর থাকে ,যেমন পাড়ার অর্থনীতি,গ্রামীণ অর্থনীতি, উপশহর অর্থনীতি,শহরের অর্থনীতি, কলকারখানার অর্থনীতি ,বৈদেশিক বাণিজ্যের অর্থনীতি,আন্তদেশীয় বাণিজ্যিক অর্থনীতি,সীমান্তবর্তী দেশের অর্থনীতি এবং মানুষে মানুষে অর্থনীতি। অর্থনীতির সকল চিত্রপট তুলে ধরা কঠিন ।সংক্ষিপ্তভাবে কোন অর্থনীতির অবকাঠামো বর্ণনা করা কঠিন হলেও বাস্তব ঘটনার আলোকে আমি গ্রামীণ অর্থনীতির চিত্র নিচে তুলে ধরার চেষ্টা করছিঃ-

(১) আমার বাড়ির পাশে নুরূল হকের জন্ম তিনি আমার চেয়ে অনেক সিনিয়র। পেশায় তিনি একজন ঋতুকালীন শাক ব্যবসায়ী। তার সর্বমোট জমির পরিমাণ চার শতক। সে তার জমিতে পালাক্রমে এবং আংশিক আংশিক ভাবে বিভিন্ন ঋতু কালীন শাক সবজি আবাদ করে থাকে।বছরে কতবার শাক সবজি চাষ করে তা বলা কঠিন,যেমন ধনেপাতা,পালং শাক,মুলা শাক, ডাটা শাক কখনো বা কচু শাক,কিছু সময় আলু বা অন্য কিছু চাষ করে সারা বছরই সেই শাক সবজি বাজারে নিজেই বিক্রি করে, যে অর্থ আয় করে,তা দিয়ে তা সংসার চলে অর্থাৎ তার অর্থনীতি সবজি চাষের উপর কেন্দ্র করে পরিচালিত বা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে ।এটা একটা অর্থনীতির চাকা। অর্থনীতির এই চাকা চালু রাখার জন্য মাত্র মূলধন ৫০০ টাকা হলেই চলে ।অতএব ৫০০ টাকার মূলধনের একটি ব্যবসা সারা বছর ধরে চলে।নিজের উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির চাকাকে সক্রিয় রাখে।

(২)রফিকুল ইসলাম পেশায় মাছ ব্যবসা।জেলেদের কাছ থেকে বিকালবেলা মাছ সংগ্রহ করে এবং সেই মাছ বাজারে বিক্রি করে তার জীবনযাত্রা নির্বাহ করে ।এই ব্যবসার মূলধন মাত্র দুই হাজার টাকা। দুইহাজার টাকার মধ্যে তার জীবনের ৫০ টি বছর অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছে। তিনিও গ্রামীন অর্থনীতির গতি প্রবাহের সহযোগিতাকারী।

(৩)মানিক মিয়া পেশা বাঁশ দিয়ে মুরগির খাঁচা তৈরি করে বাজারে বিক্রি করা।পিতাও করেছেন পুত্ররাও করেছেন একই ব্যবসা।মূলধন মাত্র দুইটি বাঁশ ক্রয় করা যার মূল্য ৫০০ টাকা। যা দিয়ে কয়েকটি মুরগীর খাঁচা অথবা কবুতরের খাঁচা তৈরি করে বাজারে বিক্রি করে সংসার চালায়।আবহমান কাল থেকেই এই ব্যবসা চলে আসছে এবং জীবনযাত্রা নির্বাহ হচ্ছে।তাদেরও দেশের প্রতি কোন অভিযোগ নেই এবং অধিক পাওয়ার কোন আকাঙ্ক্ষা নেই, চালচলন দেখলে মনে হয় তাদের কিছু চাওয়ার নেই। গ্রামীন অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র কুঠির শিল্প উননয়নে অবদান রাখছে।

(৪) দবিয়ার রহমান পেশাগতভাবে তিনি একজন কটকটি ব্যবসায়ী।তিনি সকালবেলা উঠে ৫০ টাকার গুড় আর ৫০ টাকার আটা ভেজে কটকটি তৈরি করে,ঘাড়ে নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বাচ্চাদের কাছ থেকে পরিত্যক্ত জুতা,স্যান্ডেল,হাড়ি,পাতিলের টুকরা সংগ্রহ করে সন্ধ্যা বেলা পাইকারদের কাছে বিক্রি করে যা আয় হয় তা দিয়ে তা সংসার চলে।দীর্ঘদিন থেকে তার মূলধন ৫০ থেকে সর্বোচ্চ 100 টাকা। তিনি জীবনকে এভাবেই দেখেছেন ।তাই তার জীবনের প্রতি এমন কোন আকাঙ্ক্ষা বা প্রত্যাশা কিছুই নেই ।শুধু প্রত্যাশা জীবন শেষ হবে কবে? এটাই তার শেষ কথা। মনের অগোচরেই সমাজের পরিত্যাক্ত জিনিস সংগ্রহ করে রিসাইকেলিং অর্থনীতি চালু রাখার ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রাখছে।

(৫) আমজাদ আলী তিসতা নদীরচরে তার বসবাস।মূলধন হল একটি রিক্সা ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকায় সেটি সে কিনেছিল।দীর্ঘদিন থেকে রিক্সা চালায়ে তার জীবন সংসার নির্বাহ । ৪০ বছর সে রিকশা চালাচ্ছে তার জীবনের আশা আকাঙ্ক্ষা সবটাই এই রিক্সার উপর নির্ভর করে। তার অর্থনীতি এবং আয় ব্যায় রিক্সা থেকেই আসে। দিনে ১০০ টাকা থেকে এখন সর্বোচ্চ ১০০০ টাকা পর্যন্ত আয় হয়। এর মধ্যেই তার জীবনযাত্রা পুত্র সন্তান, বিবাহ শাদী,সবকিছু হয়ে থাকে। তিনিও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের গ্রামীণ অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন।

(৬) জাহিদুল ইসলাম পেশায় সে একজন অটো ভ্যান চালক।সকালে ঘুম থেকে উঠে কোন প্রকার মূলধন ছাড়াই শুধু অটো ভ্যানটি তেল মেখে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে।সারাদিন এই ভ্যানে মাল পরিবহন,মানুষ পরিবহন করে সন্ধ্যা বেলা ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা নিয়ে বাড়িতে ফিরে।তার অর্থনীতি এই অটো ভ্যানের উপরেই ভিত্তি করে চলমান রয়েছে। তিনিও গ্রামীন পন্য পরিবহনে অবদান রেখে অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছেন।

(৭)শফিকুল ইসলাম তার কোন পেশা নেই। পেশা একটাই সে গ্রামীন হাটে যাওয়ার পরে শুধু গরু বা ছাগল ক্রয়ে মানুষকে সহযোগিতা করা,তার বিনিময়ে মানুষ খুশি হয়ে তাকে যে ১৫০- ২০০ টাকা দেয় তাতেই সে সন্ধ্যা বেলা ৫০০ টাকা বা ৭০০ টাকা নিয়ে বাড়িতে ফিরে।এই আয় দিয়ে সংসার চলে ।মুখের উপর ভিত্তি করেই অর্থনৈতিক কাজ চলমান কোন মূলধন ব্যবহার হয় না।

ডেইরি খাত উন্নয়নে তার অবদান রয়েছে।

(৮) রাজা মিয়া স্বল্পশিক্ষিত কিনতু অধিক চালাক। অল্প বয়সী একটি ছেলে যার মূলধন বলতে একটি মোটরসাইকেল ।প্রতিদিন সকালে মোটরসাইকেলে উঠে গাড়ির পিছনে একটি ব্যাগ রেখে বেরিয়ে পড়ে। বিভিন্ন ব্যবসায়ী,বিভিন্ন প্রকার বুদ্ধিজীবী এবং সমাজের বিভিন্ন উচ্চ শ্রেণীর লোকদের কাছে সে মেলামেশার চেষ্টা করে।তাদেরকে সে মৌখিকভাবে সাহায্য সহযোগিতা করার চেষ্টা করে থাকে।বিনিময়ে সেই ব্যবসায়ী তাকে ১০০ বা ২০০ টাকা উপহার হিসেবে দেয়।দুই তিনজনের মাধ্যমেই সে সারাদিন ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা আয় করে বাড়িতে ফিরে এবং তা দিয়ে তার সাংসারিক অর্থনীতির চাকা ঘুর্নায়মান। এই আয়ে সংসার চলে একটু একটু করে জমিজমা ক্রয় করে এবং ছেলেমেয়েদের বড় করে। মুখের ওপর নির্ভর করে ব্যবসায়ীদের ব্যবসায় সহায়তা করে অর্থনীতিকে সম্প্রসারণ করতে সহযোগিতা করে থাকে।

(৯) আব্দুল জলিল যার স্থায়ী কোন পেশা নেই ।স্বল্প শিক্ষিত মানুষ সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা খেয়ে প্যান্ট শার্ট পরে উপজেলা সদরে ভূমি অফিসে চলে আসেন। ভূমি অফিসের সামনে বসে থাকে,হাটাহাটি করে মানুষ যখন ভুমি অফিসে আসে তাদেরকে সে মৌখিক সাপোর্ট বা লজিস্টিক সাপোর্ট প্রদান করে থাকে। বিনিময়ে ৫০ টাকা থেকে শুরু করে ৫০০ টাকা পর্যন্ত মানুষের কাছ থেকে গ্রহণ করে থাকে ।দিনশেষে সে হয়তো এক হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করে থাকে। এই আয়ে তার জীবিকা নির্বাহ হয়ে থাকে। এটাকেই সে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে দীর্ঘকাল জীবন যাপন করতেছে।তার এই মৌখিক সেবা দেওয়ার উপর নির্ভর করে গ্রামের মানুষের ভুমি সেবার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। সরকারের ভূমি উন্নয়ন কর আদায়ে সহযোগী হিসেবে কাজ করে থাকে।

(১০) মইয়ার রহমান তিনিও পেশায় একজন মুহুরী।নির্ধারিত কোন মূলধন নেই, প্রতিদিন সকালবেলা উঠে কোর্ট চলাকালীন সময়ে কোর্টের বারান্দায় ঘোরাঘুরি করে।উকিলদের সঙ্গে খাতির করে তাদের সমস্ত কাজে সহায়তা দেয়।নানারকম টুকিটাকি কাজ করে দেয়।দৈনিক একহাজার থেকে দুই হাজার টাকা নিয়ে বাড়িতে ফিরে।মুহুরী বা সাহায্যকারী হিসেবে তার অর্থনৈতিক কার্যক্রম চলে ।তার আয়েই জীবনযাত্রা নির্বাহ হয় ।কোর্টকে কেন্দ্র করে এবং উকিলকে কেন্দ্র করে তার জীবন পরিচালিত হয়। তিনিও আইনের কাজে সহায়তা করে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে।

(১১) শামসুল ইসলাম বয়স তার ষাটের বেশি।দীর্ঘদিন থেকে তিনি কোন স্থায়ী পেশায় নিয়োজিত নেই কিন্তু সকালবেলা উঠে প্যান্ট শার্ট পড়ে বাজারের কোন একটা কর্নারে বা চায়ের দোকানে ঘুরাঘুরি করে বা বসে থাকে। মানুষ কোন বিপদে পরলে বা মানুষের সামাজিক কোন্দল সৃষ্টি হলে তিনি সমাধান করে দেওয়ার চেষ্টা করে থাকে। বিনিময় উভয় পক্ষের কাছ থেকেই কিছু অর্থ উৎকোচ হিসেবে অথবা উপহার হিসেবে গ্রহণ করে থাকে।এই উপহারের অর্থই তার জীবনযাত্রার একমাত্র আয়ের উৎস ।এটাও একটি অর্থনীতির চাকা । যা দূর থেকে কিছুই দেখা যায় না কিন্তু কাছে গেলে দেখা যায় তার জীবনযাত্রা বিচার সালিশ করে দেওয়ার মাধ্যমে নির্বাহ হয়ে থাকে। গ্রাম্য শালিশ বৈঠকের মাধ্যমে বিচার সালিশ সম্পাদন করে দিয়ে দেশের আইন আদালতের বিচার সংখ্যা কমানো দরকার বিশাল ভূমিকা থাকছে যা পরোক্ষভাবে অর্থনীতিতে একটি প্রভাব বিস্তার করছে।

(১২) নেছার উদ্দিন নামের একজন ব্যক্তি যিনি বয়সের ভারে বৃদ্ধ হয়েছে ।ছেলে মেয়েরা তাকে প্রতিপালন করে না। তাই এখন সে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে ঘটকালি করা। এই পেশায় কোন মূলধন লাগেনা বরপক্ষ বা কনেপক্ষের সাহায্যে তিনি এক স্থান থেকে আরেক স্থানে রিক্সায় বা গাড়িতে যাতায়াত করে। বিয়া সংগঠিত হলে উভয়পক্ষের নিকট থেকে উপহার হিসেবে তিনি অর্থ গ্রহণ করে।তা দিয়ে তার সংসার যেমন পরিচালিত হচ্ছে তেমনি অর্থনীতির চাকাও চলমান থাকে।

(১৩)ইব্রাহিম মিস্ত্রি অনেক বৃদ্ধ মানুষ।দীর্ঘদিন কাঠমিস্ত্রি হিসাবে কাজ করে সংসার চালিয়েছেন।এখন তার শক্ত কাজ করার মতো আর কোন শারীরিক সক্ষমতা নাই ।তাই সে এখন একটি হোমিওপ্যাথি বই সংগ্রহ করে এক চোখ কানা আরেক চোখে একটি চশমা দিয়ে দেখার চেষ্টা করে।মানুষকে হোমিওপ্যাথি ডাক্তার হিসেবে চিকিৎসা সেবা দিয়ে সারাদিন মিলে ২০০ টাকা বা ৩০০ টাকা।যা আয় করে থাকে তা দিয়ে তার এখন সংসার চলমান রয়েছে। প্রাথমিকভাবে সে নিজে আয় করে চলতে পেরে জাতির একটি অর্থনীতির বোঝা কমে দিয়েছে অপরপক্ষে কিছু হলেও চিকিৎসা সেবা দিয়ে মানুষের কল্যাণ করছে।

(১৪) মোঃ মোজাম্মেল হক লোকে যাকে পেপার মোজাম্মেল বলে ডাকে। তিনি এখন বয়সের ভারে নুবজ। কিন্তু বসে বসে শুধু ছেলে সন্তানের উপর নির্ভর করে চলতে চায় না। পুরাতন আয়ুর্বেদ বই সংগ্রহ করে তা পড়াশোনা করে কিছু আয়ুর্বেদ ঔষধ বা গাছ গাছরা কিনে মানুষজনকে দিয়ে কবিরাজি চিকিৎসা শুরু করে থাকে। এতে যা আয় হয় তা দিয়ে তার দিন চলে যায়। চিকিৎসা সেবায় কিছুটা হলেও তিনি ভূমিকা রেখে দেশের অর্থনীতিতে সহযোগিতা করছেন।

(১৫) এজারুল হাফেজ শুধু হেফজ লেখাপড়া করেছে, অন্য কোন লেখাপড়া করার মত সুযোগ তার জীবনে হয়নি।কারণ ছোটকালেই তার পিতা মারা যায়। সম্পদ তেমন কিছুই ছিল না।বাইরে থেকে চাল এনে এলাকায় বিক্রি করে জীবন চালাত।৩০০ টাকা বা ৫০০/টাকা মূলধনে তার সংসার চলে যেত।বর্তমানে হাফেজ হিসাবে বিভিন্ন মাদ্রাসায় মাদ্রাসায় ঘুরে হেফজ পড়ায়ে তার জীবন চালায়।ভালোভাবেই কেটে যাচ্ছে তার জীবন বর্তমানে কোন অভাব তাকে আর এখন স্পর্শ করছে না। শিক্ষা ব্যবস্থায় ভূমিকা রেখে অর্থনীতিতে পরোক্ষভাবে ভূমিকা পালন করছে।

(১৬)লাভলু মিয়া বিদেশ ফেরত একজন কর্মজীবী মানুষ ।দেশে ফেরত এসে কি কাজ করবে সেটা খুঁজে পায় না। হঠাৎ করে খুঁজে পেল গ্রামের পাশেই একটি কোল্ড স্টোরেজ।যেখানে সে লেবার সরবরাহ করে ।লেবার সরবরাহ থেকে কিছু কমিশন গ্রহণ করে তা দিয়ে তার সংসার চলে যাচ্ছে। শুধু লেবার সাপ্লাই এবং সংগ্রহ করাই তার প্রধান কাজ এর মাঝখানে যে কমিশন টুকু পায় তা দিয়ে তার সংসার চলে যায়। সেও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে।

(১৭) আলহার হোসেন বাদল পেশায় একজন কৃষিজীবি ছিলেন। সমস্ত জমি জমা বিক্রি করে যখন সংসার চলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।তখন তিনি প্রাণী চিকিৎসক হিসাবে প্রশিক্ষন গ্রহন করে বা সংক্ষিপ্ত ট্রেনিং নিয়ে গ্রামে পশু চিকিৎসা কেন্দ্র দিয়ে বসেন। ঔষধ বাকিতে নেয় বিক্রি করে ওষুধ সরবরাহকারীদের টাকা দেয়। প্রাণীর ঔষধ এবং চিকিৎসা সেবা দেওয়ার মাধ্যমেই তার আয় হয়। যা আয় হয় তা দিয়ে তার সংসার চলে যাচ্ছে কোন অভাব নাই সংসারে। পশু চিকিৎসায় ভূমিকা রেখে দেশের প্রাণী সম্পদ উন্নয়নে একটি বড় ধরনের সহায়তা করে যাচ্ছেন।

(১৮) সেরাজুল ইসলাম লোকে বলে কসাই সেরাজুল। মানুষের কাছে টাকা পেলে কসাইয়ের মত ধরে টাকা আদায় করতো।একসময় জমিজমা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে

সংসার চালার উপায় খুঁজে না পেয়ে এলাকার জমির কয়েকটি মৌজা ম্যাপ সংগ্রহ করে ব্যাগে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে।মানুষের জমির ম্যাপ দেখার দরকার হলে সেটা সে মানুষকে বুঝিয়ে দেয় তার বিনিময়ে ১০০ টাকা ২০০ টাকা গ্রহণ করে এখন তার সংসার চলে। জমির মৌজা ম্যাপ পর্চা মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে বোঝাতে সহযোগিতা করে সে জমির জটিলতা নির্সনে যে ভূমিকা রাখছে তাকেও অর্থনীতিতে সেবা হিসেবে ভাবা যেথে পারে।

(১৯) নদীর চরে বাস করে নাম তার আব্দুল মাজেদ লেখাপড়া শিখেছে মোটামুটি কিন্তু আয়ের কোন পথ নেই ।তাই হঠাৎ করে চিন্তা করলো শহরের উকিলের যদি খদ্দের ম্যানেজ করে দেওয়া যায় তাহলে কিছু টাকা কমিশন হিসেবে পাওয়া যাবে। তাই সে খদ্দের হিসেবে গ্রামের মামলার বাদী কিংবা বিবাদিকে উকিলের কাছে পৌঁছে দিয়ে একটা কমিশন গ্রহণ করে।তাতেই তার জীবন ভালোভাবে চলে যাচ্ছে। সাধারণত গ্রামের নিরীহ বিচার প্রার্থীদেরকে আইনের সহযোগিতা গ্রহণের সহযোগিতা প্রদান করে দেশের আইন অঙ্গনে একটি বড় ভূমিকা বা সহযোগিতা করে থাকে।

(২০) পিতা একসময় গ্রামের ধনী মানুষ ছিল কিন্তু পুত্রের এখন স্বচ্ছলতা নেই। তাই সে মধ্যবিত্ত হয়ে রাস্তার পাশে একটি দোকান দিয়ে বসে। পণ্য সরবরাহকারিগন বাকিতে পন্য দেয়,পরে বিক্রি করে পরদিন বা তারপরের দিন কিস্তিতে টাকা পরিশোধ করে বিনা মূলধনেই সে একটি দোকান চালিয়ে যাচ্ছে। এতে তার যে আয় হয় তা দিয়েও তার সংসার চলে যায়। তিনিও দেশের পণ্য ক্রয় বিক্রয়ে সহযোগিতা করে বা মানুষের দোড়গলায় সেবা পৌঁছে দিয়ে অর্থনীতির একটি বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে থাকে।

(২১)আব্দুস সোবহান মানিক পেশায় একজন ছোটখাট ব্যবসায়ী।শুরুটা হয়েছিল বিদ্যুৎ বিক্রি।বাড়ীর পাশে একটি বাজার যেখানে বিদ্যুৎ নেই,তিনি সেখানে একটি জেনারেটর ভাড়া করে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে থাকে। লাইটের ভাড়া সংগ্রহ করে জেনেরাটরের তেল এ ভাড়া খরচ প্রদান করে অবশিষ্ট টুকু তার লাভ হিসেবে নিয়ে সংসার চালায়। এটি একটি অল্প মূলধনের ব্যবসা কিন্তু তিনিও বিদ্যুৎহীন একটি বাজারে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে।

(২২)সাইফুল ইসলাম সুপারির ব্যবসায়ী। এলাকার সুপারির বাগান থেকে সুপারী ক্রয় করে বা গাছ থেকে সুপারি পেরে অল্পমূল্যে বা বাকিতে ক্রয় করে বাজারে গিয়ে বিক্রি করে । যা আয় হয় তা দিয়ে সংসার চালায়।মূলধন মাত্র ৫০০ টাকার নিচে । কিন্তু তার কোন অভাব এখন হয় না। তিনিও গ্রাম থেকে শষ্য সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করে অর্থনীতিতে সহযোগিতা করে থাকে।

(২৩)কানাইলাল পেশা তার কিছুই নেই ।আছে একটা পৈত্রিক বাঁশ বাড়ী। সেখান থেকে প্রত্যেকদিন একটি করে বাঁশ কেটে বাজারে নিয়ে যায়। বাঁশ বিক্রি করে তার সংসার চলে।এভাবেই সে জীবনের সময় কাটিয়ে দিচ্ছে ।কারো প্রতি তার কোন অভিযোগ নেই। তিনিও দেশের অর্থনীতিতে বাঁশ সরবরাহ করে একটা পরোক্ষভাবে ভূমিকা পালন করছে।

(২৪) শফিকুল ইসলাম জমি জমা কিছুই নাই শুধু বাড়ি করার মত দুই শতক জমি রয়েছে মাত্র। সেখানেই একটি ঘর তৈরি করে পুত্রকন্যা সহ বসবাস করে।পেশা হিসেবে সে কৃষি শ্রমিক। ঋতুকালীন বিভিন্ন কৃষিকাজে মানুষের বাড়িতে সকালবেলা খালি পেটে যায় সন্ধ্যা বেলা ৫০০ টাকা বা ৪০০ টাকা নিয়ে বাড়িতে ফিরে। তা দিয়ে তা সংসার চলে কোন অভাব হয় না। দেশে কৃষির ফলন উৎপাদনে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করে দেশের কৃষি উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে।

(২৫)লাভলু মিয়া স্বল্পশিক্ষিত একজন বেকার মানুষ। কামলা দেওয়ার ক্ষমতা নেই আবার ব্যবসা করার মতো অর্থ নেই, হঠাৎ তার কাছে মনে হল বিয়ে করে কিছু টাকা নিয়ে একটি ফলের দোকান ধরার।একদিন তাই করল ৫০০০/ টাকা দিয়ে একটি ফলের দোকান রেল স্টেশনে রেললাইনের ধারে বসিয়ে ব্যবসা শুরু করলো। এই ফলের ব্যবসা দীর্ঘদিন থেকে চলে যাচ্ছে। তার আয় দিয়ে তার সংসার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আয় কম হচ্ছে না অল্প মূলধনের সুন্দর ব্যবসা করে সংসার চলে। দেশীয় ফল মূল রেল স্টেশনে বসে বিক্রি করে জাতীয় অর্থনীতিতে একটু হল ভূমিকা পালন করছে।

(২৬) বাবলু মিয়া একদম বেকার কিন্তু সে গোয়ালা হিসাবে বিভিন্ন জনের বাড়ি থেকে দুধ কেনে বাজারে বা বিভিন্ন চায়ের দোকানে সরবরাহ করে দৈনিকভাবে লাভ করে সংসার চালায়।যার মূলধন ৫০০ টাকাও লাগে না কিন্তু সংসার চলে যায়। সেও দেশের প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে এবং পুষ্টি সরবরাহে সহযোগিতা করে অর্থনীতিতে অবদান রাখছে।

(২৭)গ্রামের রাস্তার ধারে কিংবা মোড়ে মোড়ে শুধু দোকান আর দোকান ।একটি দোকান বানানোর খরচ ছাড়া মূলধন হিসেবে আর তেমন কিছুই লাগে না। কোম্পানির মার্কেটিং কর্মকর্তা বা কর্মচারীগণ সেখানে বাকিতে পণ্য সরবরাহ থাকে।বিক্রি করে টাকা-পয়সা পরিশোধ করতে হয়।শত শত মানুষের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে দোকান দেওয়ার মাধ্যমে।সারাদিন বিক্রি ৫০০ থেকে ২০০০/ টাকা ১০% লাভ হিসাবে করে তারা ১০০ থেকে ২০০ টাকা লাভ করে সংসার চালায়। দেশের বিভিন্ন শিল্পকারখানায় উৎপাদিত পণ্য সমূহ মানুষের দোড়গলায় পৌঁছে দিয়ে তারা যেমন শিল্প-কারখানা উন্নয়নের সহযোগিতা করছে তেমনি দেশের অর্থনীতিতেও অবদান রাখছে।

(২৮) মাছুয়া নুরুল নামে পরিচিত নুরল।কাজ হল সকালে উঠে একটি ঝাকি-জাল নিয়ে নদীতে সারাদিন মাছ শিকার করা।যতটুকু মাছ পায় তা বাজারে নিয়ে বিক্রি করে দিয়ে সংসার চালায়। প্রাকৃতিক সম্পদ নদী থেকে সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করে। দেশের অর্থনীতি কিছু হলেও সংযুক্ত করে থাকে।

(২৯)তিস্তা নদীর তীরে বাড়ি নাম তার নজরুল ইসলাম। নিজের কোন জমি-জমা নেই,পৈত্রিক সুত্রেও ঘরের জন্য একশতক জমি প্রাপ্ত ।তাতেই বসবাসের জন্য রয়েছে একটিমাত্র খড়ের ঘর ।যেখানে তিনি বসবাস চলছে ৪০ বছর থেকে।নদীর চরে সুবিধামতো জায়গা দখল তামাক,ভুট্টা,বাদাম,আলু আবাদ করে নিজে খায় এবং বিক্রি করে। মাত্র শুকনো মৌসুমে আবাদ বর্ষা মৌসুমে বসে বসে নদীতে মাছ ধরে।তাতেই তার সংসার চলে যায়।অভাব তার স্বাভাবিক বন্ধু হয়ে যায়। তিনি নদীর চরের অব্যবহৃত জমি থেকে এরকম শস্য উৎপাদন করে দেশের খাদ্য সরবরাহে কিছুটা হলেও যোগান দিয়ে দেশের অর্থনীতিতে একটা ভূমিকা রাখার চেষ্টা করতেছে।

(৩০) আব্দুল আজিজ আর তার কিছু বন্ধু। সবাই বেকার, আয়ের নির্দিষ্ট কোন পথ নেই।একটি সমিতি করে সামান্য কিছু সঞ্চয় দিয়ে নদীর চরের অব্যবহৃত মৌসুমী জায়গাগুলোতে মিষ্টি কুমড়া, পিয়াজ, গম চাষ করে ব্যাপক ফলন ফলায়।এই ফসল সমুহ ঢাকার বাজারে সরবরাহ করে দেশের সবজির বাজারও আটার বাজার স্থিতিশীল রাখতে বিশাল ভূমিকা রাখছে ।তারাও দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে।

গ্রামের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং সবপেশাধারী ব্যক্তিগণ তাদের নিজস্ব উন্নয়নের জন্য যে কাজ করে,তাদের সমষ্টি গোটা দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে থাকে।

(লেখক- মোহাম্মদ ইয়ার আলী প্রোপাইটার আলিবাবা থিম পার্ক)

এই বিভাগের আরও খবর