লালমনিরহাট বার্তা
জলবায়ু ওপরিবেশ; প্রসঙ্গ পাট ও আখশিল্প
শমশের আলী | ১ এপ্রি, ২০২৪, ৩:৪৩ AM
জলবায়ু ওপরিবেশ; প্রসঙ্গ পাট ও আখশিল্প

বৈশ্বিক জলবায়ুরনেতিবাচক প্রভাব কমাতেজাতিসংঘসহ অধিকাংশ দেশের সরকার ও পরিবেশবাদীরা অনেকখানি সরব। জাতিসংঘের আয়োজনে গত ১৯৯৫ সালথেকে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। প্রায় চার লাখ মানুষেরউপস্থিতিতে এবারের ২৮তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন গত ৩০ নভেম্বর থেকে ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখেআরব আমিরাতের রাজধানী দুবাই শহরে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। জাতিসংঘের প্রতিনিধিসহ শতাধিক দেশের সরকারের প্রতিনিধি, বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশ কর্মী যোগদান করেছে। সকলের প্রত্যাশা হচ্ছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা কমাতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, জলবায়ু তহবিল সচল করা, কার্বন গ্যাস নিঃসরণ কমানো এবং তারজন্য জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি করা।

বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের প্রতিপাদ্য ও দাবিসমূহ বিশ্লেষণ করলে, যেসব প্রশ্ন সামনে আসে! তা হলো, বিগত ২৮ বছরে বিশ্বব্যাপি বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদির মাধ্যমে ব্যায়িত অর্থ ও সময়ের তুলনায় অর্জন কি? জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে কি কি ধরনের ক্ষতি হবে? কারা বেশি ক্ষতিগ্রস্থ্ হবে?(যদিও সেই বিষয়ে বেশ কিছু গবেষণা ও প্রতিবেদনে অনেক তথ্য উল্লেখ করা আছে)। যেমন; কোথাও খড়ার তীব্রতা বৃদ্ধি পাবে আবার হিম অঞ্চলে শীতের তীব্রতা কমবে।যা অনুহ্য আছে, তা হলো;এই সম্মেলনের মাধ্যমে কোন কোন গোষ্ঠির জন্য নতুন নতুন সুযোগ তৈরী হচ্ছে?কারা লাভবান ও কারাক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে? প্রতিপাদ্য বিষয় ও দাবিসমূহ কখন ও কেন উত্থাপিত হলো? কোন কোন দেশ জীবাশ্ম জ্বালানি সমৃদ্ধ আর কোন কোন দেশে আছে নবায়নযোগ্য জ্বালানির কারখানা ও ব্যবসা। শুধুমাত্র জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমালে কি বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি রোধ হবে? এক্ষেত্রে বাংলাদেশের কি অবস্থা? প্রতিপাদ্য বিষয় ও দাবিসমূহ কি জলবায়ু কেন্দ্রিক নাকি পরিবেশ কেন্দ্রিক? জলবায়ু ও পরিবেশের মধ্যে সম্পর্ক কোথায়? সর্বপরি জলবায়ু সম্মেলন ও আলোচনার অর্থনীতি কি? এসব প্রশ্নের সোজাসাপটা কোন উত্তর নাই। কিছুটা তথ্য ভিত্তিক আর কিছুটা অনুমান করা যায় মাত্র।

আমরা জানি, জলবায়ু হচ্ছে আবহাওয়ার গড় বা সামগ্রিক অবস্থার একটি হিসাব। যার মধ্যে আছে; বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রার তারতম্য, আদ্রতা, বায়ু প্রবাহ, বায়ুর চাপ, সামুদ্রিক ও ভূউপরিভাগের নিম্নচাপ ও ঝড়। আর পরিবেশ হচ্ছে ৫টি প্রাকৃতিক সম্পদ বা উপাদানের সমন্বয় যথা: (ক) জমি, (খ) জলা, (গ) আলো ও তাপ, (ঘ) বায়ুমন্ডল এবং(ঙ) বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণ ও জীববৈচিত্র। পরিবেশের ৫টি উপাদানের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার সংরক্ষনের উপর নির্ভরশীল করে জলবায়ুর স্থায়িত্বশীলতা। কোন একটি উপাদানের ব্যবস্থাপনার তারতম্যের কারণে পৃথিবীর জলবায়ুর স্থায়িত্বশীলতা নষ্ট হতে পারে।

বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় হচ্ছে, কার্বন নিঃসরণ কমাতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানীর প্রসার ঘটানো। তবে,কার্বন নিঃসরণ কমাতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমোনোর পাশাপাশি সামগ্রিক পরিবেশ ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষনের উপর জোর দেওয়া জরুরি। যেমন বনভূমি ও কৃষিজমি উজার করে বিভিন্ন প্রকারের কল-কারখানা ও নগর স্থাপনসহ প্লাষ্টিকের ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে অক্সিজেনের ঘাটতি ও কার্বন নিঃসরণ বৃদ্ধি ঘটে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে গাছ বা বনভূমির সংরক্ষণ, রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার রোধসহ, জমি ও জলাভূমির ক্ষতি হতে পারে এমন দ্রব্যের ব্যবহার রোধসহ ক্ষতিকর সকল কর্মকান্ড বন্ধ করতে হবে। অথচ পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ অনেকবিষয়ে উক্ত সম্মেলনেআলোচনাহয় নি। পরিবর্তনশীল এই পৃথিবীতে তাপমাত্রার তারতম্যের কারণে কোথায় কোথায় কি ধরনের নেতিবাচক ও ইতিবাচর প্রভাব বিস্তার করতে পারে, তাও কোন গবেষণা নিশ্চিত ভাবে প্রমাণ করতে পারে নি। সামরিক অস্ত্রসহ পারমানবিক ওমহাকাশ গবেষণা শিল্প;জলবায়ু বা পরিবেশের উপর কি ধরনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে তা নিয়েও সুক্ষ্ণও বিশদ গবেষণার দাবি রাখে। আপাতদৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য পরিমানে কার্বন নিঃসরণ ঘটে না। তবে আমরা পুরোপুরি জানিনা যে, নবায়নযোগ্য জ্বালানির উপকরণ প্রস্তুত কারখানা ও উপকরণের মেয়াদ শেষে বর্জ্য হিসাবে ব্যবস্থাপনার ফলে তা জমি ও জলার উপর কি ধরনের নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করতে পারে। যেমন পারমানবিক বিদ্যুতকেন্দ্রে ব্যবহৃত ইউরেনিয়াম বর্জ্যের তেজস্কৃয়তা মাটির নীচে তিন শত বছর পর্যন্ত সক্রিয় থাকে। ইউরেনিয়াম ব্যবহারে হয়তো কর্বণ নিঃসরণ হয় না, কিন্তু তার তেজস্কৃয়তামানবজাতি ও প্রতিবেশের কি ধরনের ক্ষতি করতে পারে! তা ইতোমধ্যে অনেকবার প্রমাণিত হয়েছে। আবার, ক্ষতিকর কার্বন গ্যাস মাটির নীচে চাপা দেওয়ার যে প্রযুক্তি আবিস্কার হয়েছে! তারফলে কি ধরনের নেতিবাচক ফলাফল হতে পারে, তাও সুক্ষ্ণ গবেষণার দাবি রাখে।বৈজ্ঞানিক সূত্রমতে, বিশ্বের কোন কিছুরই বিনাশ হয় না, শুধুমাত্র রূপান্তর হয় মাত্র। এই রূপান্তর কতখানী প্রাণ ও পরিবেশ বন্ধব তা অবশ্যই খতিয়ে দেখতে হবে। জলবিদ্যুৎকে নবায়নযোগ্য জ্বালানী হিসাবে বিবেচনা করা হলেও জলজ জীববৈচিত্রের উপর বিরুপ প্রভাব অনেক ভাবেই প্রমানিত হয়েছে। সৌর বিদ্যুত এখনো অনেক ব্যায় বহুল এবং সেই শিল্পের তেজস্কৃয়তা বিষয়ে অনেক কিছু অজানা আছে।

উল্লেখ্য যে, গত শতাব্দির শেষভাগে আন্তর্জাতিক ভাবে ভোজ্য তৈল হিসাবে সরিষার বিরুদ্ধে একটি বিশেষ মহলের গবেষণা লব্ধ উপাত্ত দিয়ে ব্যপক বিরুপ প্রচারনা করা হয়েছিল, আর বিকল্প হিসাবে সয়াবিল তৈলের বাজার সৃষ্টি করা হয়েছে। এখন সয়োবিন তৈলের বিরুদ্ধেও আন্তর্জাতিক ভাবে গবেষণা লব্ধ উপাত্ত দিয়ে ব্যপক প্রচারনা করা হচ্ছে, আর বিকল্প হিসাবে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের ভোজ্য তৈলের বাজার তৈরির প্রয়াস চলছে। নতুন গবেষণা দ্বারা অনেক পরে হলেও জানা গেছে যে, সরিষার তৈল মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর নয়। তবে, যে কোন কিছুরই অতিমাত্রায় ব্যবহার ক্ষতিকারক। একই ভাবে ভেষজ, আয়র্বেদ ও ইউনানী চিকিৎসা ও প্রতিষেধকের তুলনায় উৎকৃষ্ট হিসাবে এলোপ্যাথিক ঔষধের বিশাল বাজার তৈরী করা হয়েছে। বাস্তবেএলোপ্যাথিক ঔষধ শিল্প কতটুকু ফলপ্রসু, জনবান্ধব, পরিবেশ সম্মতও সহনশীল তানির্ণয়ে নিরপেক্ষ গবেষণার দাবি রাখে। তদ্রুপ রাবার বাগান ও রাবার শিল্প নিয়েও পরিবেশ বিতর্ক আছে। অন্যদিকে বহুমূল্যবান পোস্তদানা বড় কোন অনুষ্ঠান বা আয়োজনের রান্নাসুসাদু করার জন্য বিদেশ থেকে আমদানী করা হয়, কিন্তু সেই আফিম গাছ চাষ করা নিষিদ্ধ। অথচ এটি একটি মূল্যবান ঔষধি গাছ। যদিও এই গাছের গুনাগুন সম্পর্কে না জানা থাকার কারণে ভ্লদিমির ইলিচ উলিয়ানভ লেনিন “ধর্ম”কে আফিম ফলের সাথে তুলনা করেছেন। এশিয়ার আয়ুর্বেদ ও ইউনানী চিকিৎসা এবং ঔষধ সম্পর্কে জানা থাকলে হয়তো তিনি অন্য কিছুর সাথে তুলনা দিতেন।

এছাড়াও, জলাধার ও জমির দূষণ রোধে আমাদের দেশে পলিথিন ও কারেন্ট জালের ব্যবহার বন্ধে বেশ কয়েকটি আন্দোলন হয়েছে এবং সরকারীভাবে এসবের ব্যবহার বন্ধেআইন ও বিধিমালা তৈরী হয়েছে। তবে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে পলিথিন ও কারেন্ট জালের ব্যবহার আবশ্যক হওয়ার অজুহাতে কারখানা সমূহ এবং কাঁচামাল আমদানী বন্ধ করা হয় নি।অপরদিকে, এসব দ্রব্যের বিকল্প সমূহ সহজলভ্য করা হয়নি। ফলে, এসব দ্রব্য ব্যবহারের কোন ব্যাত্তয় ঘটেনি। যার নেতিবাচক প্রভাব আমরা এখন সহজে বুঝতে পারছি। যদিও অনেক দেশের সরকার পরিবেশের নেতিবাচক প্রভাব থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে পলিথিন ব্যবহার নিয়ন্ত্রন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অনেক সাফল্য আর্জন করেছে। যা আমাদের দেশে এখনো গড়ে ওঠেনি। তবে, অনেক দেশ সমুদ্রে মাছ ধরার জন্য কারেন্ট জাল নিষিদ্ধ করেনি এবং সেই বিষয়ে আন্তর্জাতিক পরিবেশ ও প্রতিবেশ সংগঠনের কোন বক্তব্য পাওয়া যায় নাই। আবার, সিন্থেটিক কাপড় ও কৃত্রিম সিল্ক সুতা তৈরীর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিবেশ ও প্রতিবেশের উপর কি ধরনের বিরুপ প্রভাব বিস্তার করছে, তা নিয়েও ব্যাপক কোন গবেষণা ও আলোচনা নাই।এরফলে, বাংলাদেশে গুটি পোকার রেশম ও প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত সুতার শাড়ির বুনন কমে আসছে। অথচ, কোন কোন গবেষক ধান চাষে পানির ব্যবহার কমানো নিয়ে অনেক উদগ্রীব থাকেন।

প্রসঙ্গত: আমাদের দেশেরবিদ্যালয় সমূহের পাঠ্য পুস্তকে শিল্প বিপ্লবের রচনা পড়ানো হচ্ছে, তারসাথে বিজ্ঞানের মোড়কে প্রযুক্তির পক্ষে বয়ান তৈরী শিখানো হচ্ছে। সারা বিশ্ব যখন শিল্প ও কারখানা প্রসারের নতুন নতুন প্রযুক্তির প্রচলন করে পরিবেশের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে চলেছে, তখন জাতিসংঘের নেতৃত্বে পরিবেশ সচেতনতার প্রয়াস কতখানী কার্যকর তা একটি মৌলিক প্রশ্ন। আর কোনটি বিজ্ঞান আর কোনটি প্রযুক্তি তাও বিশ্লেষনের দাবি রাখে। যারা বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার অযুহাতে শিল্প বা প্রযুক্তির আগ্রসনকে সমর্থন ও বিপ্লব হিসাবে আখ্যায়িত করে,অথবা যারা নিজেদেরকে বিজ্ঞান মনস্ক দাবি করে, তাদের উদ্দেশ্য ও পরিবেশ জ্ঞানের মাত্রা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আরো আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, কিছু পরিবেশবাদীর জ্ঞান হচ্ছে পরিবেশ বিষয়ে অন্ধের হাতি দেখার মত!! তা তাদের কথার ফুলঝুড়িবা ঢোল পিটানো দেখলেই তা অনুমান করা যায়। আর তাদেরকে বিভিন্ন বিষয়ের সাথে পরিবেশের যোগসূত্র স্থাপন করতে হিমসিম অবস্থায় দেখা যায়।

সারা বিশ্বের সকল শিল্প-কারখানাকে পরিবেশ-প্রতিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব বিবেচনায় প্রধানত: তিনটি শ্রেনীতে ভাগ করা হয়। (১) লাল, (২) কমলা ও (৩) সবুজ। পরিবেশ-প্রতিবেশের উপর সর্বাধিক নেতিবাচক প্রভাব বিস্তারকারী শিল্প-কারখানাকে লাল শ্রেনীভূক্ত করা হয়েছে! যেমন; কয়লা ভিত্তিকবিদ্যুত কেন্দ্র। আর সবচেয়ে কম বা শুন্য মাত্রার নেতিবাচক প্রভাব বিস্তারকারী শিল্প-কারখানাকে সবুজ শ্রেনীভূক্ত করা হয়েছে। যেমন; পাট ও আখ শিল্প।লাল ও কমলা শ্রেনীভূক্ত শিল্প-কারখানা স্থাপন করা হলে, তা কিভাবে উন্নয়নের তলিকাভূক্ত হয়! সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হয়ে পড়েছে। লালও কমলা শ্রেনীভুক্ত শিল্প-কারখানা কি উন্নয়ন নাকি অধঃপতন?

পুনশ্চ:সারা বিশ্বে পরিবেশ বান্ধব হিসেবে সমাদৃত এবং আমাদের দেশের সোনালী আঁশ হিসাবে পরিচিত; পাট শিল্প ছিল আমাদের গর্ব।পাট এই এলাকার একটি আদি অর্থকরী ফসল। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দ থেকে সিন্ধু সভ্যতায় বস্ত্র তৈরিতে পাট ব্যবহার করা হয়েছে। এখনো বস্ত্র তৈরিতে পাট ব্যবহারের প্রচলন আছে। শাস্ত্রীয় প্রাচীনতত্ত্বে এবংপৃথিবীর প্রথম এনসাইক্লোপিডিয়া রচয়িতাপ্লিনি লিপিবদ্ধ করেছেন যে প্রাচীন মিশরে পাটগাছ খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হত। কিন্তু, পাট শিল্পের প্রথম সুত্রপাত কোথায় হয়েছে তা নিশ্চিতভাবে জানা না গেলেও বিভিন্ন তথ্যে প্রমানিত যে,বাংলায় পাট শিল্পের যাত্রা শুরু হয় অষ্টাদশ শতকে। তবে, বিভিন্ন অযুহাতে সেই শিল্প আজ বিলুপ্তির পথে।অথচ, এই শিল্পের কমপক্ষে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে যথা; পরিবেশ, কৃষি, সভ্যতা, জনঅর্থনীতি ও রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি।

উল্লেখ্য যে, পাট একটি বর্ষজীবী ও পরিবেশ বান্ধব ফসল। বিভিন্ন নথিতে উল্লেখ আছে যে, পাট চাষে কোনো রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োজন হয় না। ফসল-চক্রে পাট চাষ করা হলে পাটের ১০-১২ ইঞ্চি লম্বা শিকড় মাটির তলার শক্ত আস্তরণ ভেঙ্গে ফেলে এবং নিচের স্তর থেকে খাদ্য গ্রহণ করে এবংতা পরবর্তি ফসলের জন্য উপকার বয়ে আনে। অন্যান্য মৌসুমী ফসল এত গভীর থেকে খাদ্য গ্রহণ করতে পারে না। আরো জানা যায় যে, পাটগাছ যে খাবার খায় তার ৬০% মাঠে দাঁড়ানো অবস্থায় পাতা ঝড়ানোর মাধ্যমে মাটিতে ফিরিয়ে দেয়। তাই ধান, গম এবং অন্যান্য ফসলের আবাদ টিকিয়ে রাখতে হলে শস্য পর্যায়ে পাট চাষ অবশ্যই করতে হয়।তাছাড়া, বর্ষায় অতিবর্ষনে প্রবাহিত পানিতে পাট থেকে আঁশ ছাড়াতে বেশি সহায়তা করে এবং পাটের বর্জ্য পরিবেশের কোন ক্ষতি করে না বরং তা মাছের জন্য খাবার প্রস্তুত করে। যদিও পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনার অপ্রতুলতার কারণে কোথাও কোথাও বন্যা বা প্লাবণ হয়ে থাকে।

পাটজাত পণ্য আমাদের সভ্যতার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। যেমন; পাটের তৈরী কাপড়, শাড়ি, লুঙ্গি, জামা, মাদুর, পাপস, দড়ি, সিকা, দোলনা, বস্তা, থলে, পর্দা, সোফা, উপহার বাক্স, গয়না, ল্যাম্পশেড, কার্পেট, পাটখড়ির তক্তা, ঘর সাজানোর নানান রকম উপকরণ, শিশুদের খেলনা, পাটখড়ির বেড়া, পাট খড়ির জ্বলানী, খাদ্য হিসাবে শাক, আরো অনেক কিছু। তাছাড়া, পাট চাষ ও শিল্প গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান, বাণিজ্য এবং জাতীয় অর্থনীতির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ।

বাংলাদেশে পাট শিল্পের যাত্রা শুরু হয়, বেসরকারী উদ্যোগতাদের মাধ্যমে। পরবর্তিতে রাষ্ট্রের রাজস্ব আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে, সরকারী ঘোষণার মাধ্যমে তা রাষ্ট্রিয় মালিকায় নিয়ে আসা হয়। সরকারী ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হওয়ার সময়ে পাট শিল্প বিপুল অংকের ক্ষতির সম্মুখিন হয়। ৯০’র দশকে পাটশিল্পের সমস্যার পর্যালোচনার জন্য বিশেষজ্ঞ বা দক্ষ কমিটি নিয়োগ দেয়া হয়। কমিটি’র পর্যালোচনায় উল্লেখ করে যে, মিলগুলির ক্ষতির কারণ হলো: (ক) কর্মকর্তা ও শ্রমিকদের নৈতিক অবক্ষয় ও দূর্নীতি; (খ) প্রশাসনের সর্বস্তরে অপর্যাপ্ত তত্ত্বাবধান ও তদারকি; (গ) উদ্ধুদ্ধকরণ ও প্রণোদনার পূর্ণ অনুপস্থিতি এবং একত্ববোধের অভাব; এবং (ঘ) নির্বাহী কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার অভাব। অন্য সব জাতীয়করণকৃত শিল্পখাতেও এসব দুর্বলতা কম-বেশি বিদ্যমান ছিল।

১৯৭৯-৮০ সালে বিশেষজ্ঞ বা দক্ষ কমিটির সুপারিশ অনুসারে শিল্প-কল-কারখানার বিরাষ্ট্রীয়করণ শুরু হয় এবং কমিটির সুপারিশ অনুসারে ৩জন বাংলাদেশি মালিকের পাটকল ফেরত দেয়া হয় এবং এরূপ অন্য ৩টি মিল বাংলাদেশিদের নিকট নিলামে বিক্রয় করা হয়। পরবর্তীকালে সরকার এরূপ মিল প্রতিষ্ঠার জন্য পুরাতন ও ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি আমদানিসহ ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগের পরিমাণ উন্মুক্ত করে দেয়। ১৯৮২ সালে সরকার ৩৫টিরও বেশি পাটকল সাবেক বাংলাদেশি মালিকদের নিকট হস্তান্তর করে। ১৯৮২-৮৪ সালে বেসরকারি খাতের বেশ কিছু পাটকল (বিজেএমসির প্রতিনিধিত্বে) মুনাফা অর্জন করে, কিন্তু পরবর্তীকালে এগুলিও পূর্বের ন্যায় ক্ষতির সম্মুখীন হয়।২০২৩ সাল পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া পাটকলের সংখ্যা প্রায় অর্ধশতাধিক। অপরদিকে, অন্যান্য দেশে পাটকলের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। ফলে, পাটজাত পণ্য রফতানী কমে যাওয়ায় আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন কমেছে এবং আমদানী-রফতানীর ভারসাম্য হ্রাস পেয়েছে।

উল্লেখ্য যে, বিশ্বের মাত্র ১০টি দেশে পাট গাছের চাষ করা হয়। তার মধ্যে ভারত ও বাংলাদেশ অন্যতম। বিশ্বের মোট প্রায় ৩৫ ভাগ পাট বাংলাদেশে উৎপাদন হয়। বিগত চার দশকে পাট শিল্পের অধঃগতি গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব এনেছে। পাটের বাজার ও পাটশিল্প ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা ও দূর্নীতির দায়ভাগ পুরোটায় জনগনের কাঁধে চেপেছে।

একইভাবে, আখ চাষ ও চিনি শিল্প আজ প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। এর সাথে জড়িত গ্রামীন কৃষক যেমন ক্ষতিগ্রস্থ, অপরদিকে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে নিম্নমানের চিনি আমদানী বৃদ্ধি পেয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী বাজারে দেশি চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলের সংখ্যা ১৭টি তারমধ্যে প্রায় অর্ধেকটায় উৎপাদন বন্ধ আছে। এখানেও পরিচালনা বিষয়ক অদক্ষতা ও দূর্নীতি অনেকভাবে প্রমানিত হয়েছে। অথচ জনগণের ঘাড়ে দায়ভাগ পুরোটায় চেপেছে।ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা ও দূর্নীতির কারণে কারো শাস্তি পেতে হয়নি। যাকে বলে উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে। দেশের ঊপকূল অঞ্চলে শিল্প ও কারখানা প্রসারের কারণে লবন শিল্পের অবস্থাও অধঃপতিত। বাজরে এখন নিম্নমানের আমদানীকৃত লবনে সয়লাভ এবং তার মূল্য দিনে দিনে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। আগে স্লোগান ছিল: দেশিয় পণ্য কিনে হও ধন্য। এখন বাস্তবতা হচ্ছে; বিদেশি পণ্য কিনে হও দৈন্য। প্রতিটি বৈদেশি পণ্য আমদানী হয়, রফতানী আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো বৈদেশিক মূদ্রায়। তাছাড়াও পণ্য আমদানী বৃদ্ধি হলে দেশিয় কর্মসংস্থানও কমে যায়।

যে দেশের আয়তনের প্রায় সম্পূর্ণ অংশই কৃষিজমি। অধিকাংশ জমি তিন ফসলী বা মিষ্টি পানি সমৃদ্ধ জলাভূমি। সেই দেশে প্রতিবছর, কৃষিজমি, জলাভূমি ও বনভূমির আয়তনসহ জেলে ও কৃষকের সংখ্যা কমছে এবং বৃদ্ধি পাচ্ছে কল-কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীসহ চাকুরীজীবির সংখ্যা। এই পরিসংখ্যাণ থেকে দেশের পরিবেশের গুনগত মান অনুধাবন করা সম্ভব। কারণ, পাট ও আখ শিল্প ব্যাতিতঅধিকাংশ কল-কারখানার বর্জ্য পানি ও মাটিকে অনেকভাবে দূষণ করে চলেছে। এই অবস্থায়, বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের বয়ানে দেশিয় ও বৈদেশিক শিল্পের সার্বিক পরিস্থিতির নিরপেক্ষ ও সুক্ষ্ণ কোন একাডেমিক ও বিভিন্ননীতিমালার বিশ্লেষণ দৃষ্টিগোচর হয়নি;যা থেকে দেশের নীতিনির্ধারক গণ দিকনির্দেশনা পাবেন।

পাট ও আখশিল্পের সাথে সম্পৃক্ত শ্রমিক ও কর্মচারী, যারা কারখানা বন্ধ হওয়ার কারণে চাকুরী হারিয়েছে, শুধুমাত্রতারা জীবিকা রক্ষার তাগিদে দীর্ঘসময় আন্দোলন করে চলেছে। তাদের আন্দোলনকে সমর্থন করছে কিছু রাজনৈতিক দল ও একই রাজনৈতিক আদর্শের অনুসারী কিছু সুশীল। কখনো কখনো এই আন্দোলন কোন কোন সুশীল ব্যাক্তিদের একটি উন্নয়ন প্রকল্প বা নিজেকে প্রতিষ্ঠারউপলক্ষ্য মাত্র। এসব আন্দোলনের মূল দাবি হচ্ছে, বকেয়া পাওয়া ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা। অনেক ক্ষেত্রে এই ন্যায্য দাবি আদায়ে অনেক সময় ক্ষেপণ করতে হয়। তবে,তাদের আন্দোলনের বয়ানে চাষি ও সাধারণমানুষের স্বার্থ, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যকেসম্পৃক্ত করার মত কোন আলোচনা নাই। এসব শিল্পের সাথে চাষি ও সাধারণ মানুষের সম্পর্কের বিষয় সমূহ স্থান পায় নি।বিগত পাঁচ দশকে আখ ও পাট চাষিদের দূর্দশা ও পণের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার বিষয়টি অনেক বার পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে, কিন্তু তাদের বিষয়টি নিয়ে উল্লেখযোগ্য কেউ আওয়াজ তোলেনি। বাস্তবতা হচ্ছে, আখ, পাট ও প্রয়োজনীয় শস্য উৎপাদন করে চাষি, আর লাভবান হয় ব্যবসায়ী। সেই জন্য সবাই চাকুরিজীবী বা ব্যবসায়ী হতে চায়। কোন শিক্ষিত এমনকি কৃষিবিদ হিসাবে খ্যাত ব্যাক্তিরাও চাষি হতে চায় না। কারণ চাষি হওয়া অলাভজনক ও অসম্মানের।

আখ ও পাট শিল্পের বিষয়ে কোন কোন একাডেমিক, পরিবেশবিদ ও সুশীলগণের বক্তব্য রাজনৈতিক বয়ানে ভরপুর;যা বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত নথিপত্র থেকে জানা যায়। তাদের বয়ানে জনমানুষের পরিবর্তে বিশেষ মহলের পক্ষে বা বিপক্ষের যুক্তিস্থান পেয়েছে। আর রাষ্ট্রিয় নীতি, কাঠামো ও সক্ষমতার বিশ্লেষনের পরিবর্তে রাজনৈতিক স্বদিচ্ছা প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। আইনি যৌক্তিকতার পরিবর্তে আবেগ বা মানবিকতা বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। কোন কোন বয়ান একপাক্ষিক বা কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষে শ্রমিকদের সমর্থন বৃদ্ধির প্রয়াস মাত্র।অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব আন্দোলন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে পরিনত হয়েছে।অপরদিকে, পরিবেশবিদরাও পাট ও আখ শিল্পের সাথে পরিবেশ আন্দোলনের বয়ানে যুক্ত করতে পারেনি।ফলে, সমস্যার মূলে বা সমাধানের কূলে পৌছানো অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে।প্রায় দুই যুগের আন্দোলন রাজনৈতিক টানাপোড়নেরকারনে ইতিবাচক তেমন কোন অগ্রগতি হয় নি। উপর্যুপরি এসব রাষ্ট্রায়াত্ত পাট ও আখশিল্প বন্ধ হচ্ছে। যদিও কিছু বেসরকারী উদ্যোগে কিছু পাটকল চালু হলেও তাকে বন্ধ হওয়া পাটকলের তুলনায় ইতিবাচক বলা যায় না। চাষিদের উৎপাদিত পাট দেশিয় শিল্পের যোগন হওয়ার তুলনায় কাঁচা পাট বিদেশের শিল্পে ব্যবহারের জন্য রফতানী করা হচ্ছে।

পরিশেষে, এই সকল বিষয়ের সাথে রাজনৈতিক ও নীতি নির্ধারণের সম্পর্ক অবশ্যই আছে, তবে আলোচনার মূল কেন্দ্র হওয়া উচিৎ সাধারণ জনগণের স্বার্থ। সেই জন্য দরকার একাডেমিক ও নীতি বিশ্লেষণসহ বাস্তবসম্মত সমাধানের যথাযথ সুপারিশমালা, যা কোন গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক-দল ও গোষ্ঠিনিরপেক্ষ সুশীলদের নিকট থেকে প্রত্যাশা করা যায়। আর, শুধুমাত্র চাকুরি হারানো শ্রমিক বা কর্মচারী নয়। রাষ্ট্রের মালিকানার সাথে জাতীয় বাজেট ও নাগরিকদের দেয়া করের নিবিড় সম্পর্ক আছে। দেশের সংবিধান অনুযায়ী জনগণের মালিকানার বিষয়টি দেশের আইন ও নীতিসহসর্বক্ষেত্রে অনুধাবন করা আবশ্যক। অতএব, পাট ও আখ শিল্পকে শুধুমাত্র রাষ্ট্রের মালিকানার দৃষ্টিতে বিবেচনা না করে, দেশের কৃষি, পরিবেশ, নদী সুরক্ষা, জনস্বার্থ, বাজেট ও জনঅর্থনীতি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বৈদেশি মূদ্রা অর্জন, রাষ্ট্রের দক্ষতা, প্রভৃতি বিষয় সার্বিকভাবে বিবেচনা করতে হবে এবং সেই মোতাবেক জবাবদিহীতামূলক আইন তৈরী ও চলমান আইনের সংস্কারসহ যথাযথ প্রশাসনিক কাঠামোতৈরী করতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে রাষ্টায়ত্ত্ব ও বেসরকারী উদ্যোগে পরিচালিত দেশিয় কাঁচামাল ভিত্তিক পরিবেশ বান্ধব শিল্প-কারখানা সমূহ মানসম্মতভাবে পরিচালিত ও লাভজনক হয়। উপরন্তু, বিশ্ব জলবায়ু বা বৈশ্বিক উষ্ণতা কমাতে পাট ও আখ শিল্পের শিল্পের অবদানের পাশাপাশি দেশিয় ও জনঅর্থনীতিতে তার অনেক অবদান রয়েছে।

(বিগত প্রায় ৩০ বছর সরাসরি পাট, আখ, রেশম ও অন্যান্য কৃষি শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত যথা; চাষি, জেলে, ফরিয়া, ব্যবসায়ী, শিল্প-কারখানার শ্রমিক ও কর্মচারি, রফতানী প্রতিষ্ঠান, গবেষক, লেখক, সুশীল ও একাডেমিকদের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা এবং বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত তথ্য ও সংবাদের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরী করা হয়েছে।)

এই বিভাগের আরও খবর