লালমনিরহাট বার্তা
তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নে তথ্য সাক্ষরতার গুরুত্ব -মোঃ মামুন অর রশিদ
বার্তা অনলাইন ডেস্ক | ৩ ডিসে, ২০২৩, ১২:১৯ PM
তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নে তথ্য সাক্ষরতার গুরুত্ব  -মোঃ মামুন অর রশিদ

কোনটি তথ্য, কোনটি গুজব- এ নিয়ে আমাদের প্রায়ই বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়। চিলে কান নিয়ে যাওয়ার গুজব বন্ধ হলেও ডিজিটাল মাধ্যমে সৃষ্ট গুজব বন্ধ হচ্ছে না। বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিতকরণের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে গুজব প্রতিরোধ। তথ্য অধিকার বাস্তবায়ন ও গুজব প্রতিরোধে তথ্য সাক্ষরতার কোনো বিকল্প নেই। তথ্য জানার ক্ষমতা, তথ্যের যথার্থতা নিরূপণ ও তথ্যের কার্যকর ব্যবহারকে তথ্য সাক্ষরতা বলা হয়। জনগণকে তথ্য সাক্ষর করতে পারলে তথ্য অধিকার আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা সম্ভব।

তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯ নিঃসন্দেহে একটি শক্তিশালী নাগরিকবান্ধব আইন। তথ্য অধিকার আইনের মূল চেতনা হলো । তথ্য অধিকার আইনের অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো, দেশের প্রচলিত অন্যসব আইনে কর্তৃপক্ষ জনগণের ওপর ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকে; কিন্তু এ আইনে জনগণ কর্তৃপক্ষের ওপর ক্ষমতা আরোপ করে। সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২ মতে, বিচারের ক্ষেত্রে আদালতে যিনি বিচারপ্রার্থী, ঘটনা প্রমাণের দায়িত্ব তারই। কিন্তু তথ্য চেয়ে সংক্ষুব্ধ কোনো নাগরিক তথ্য কমিশনে অভিযোগ করলে অভিযোগ প্রমাণের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার, অভিযোগকারীর নয়। এটি জনগণের ক্ষমতায়নের পূর্বশর্ত। তথ্য অধিকার আইনের মূল ভিত্তি সংবিধানের ৭ ও ৩৯ অনুচ্ছেদ।

সংবিধান মতে, জনগণ প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক। এই মালিকের ক্ষমতায়নে, ক্ষমতা সুসংহতকরণে সবার সর্বদা সচেষ্ট থাকাই একান্ত কাম্য। ক্ষমতায়নের জন্য জনগণের তথ্য অধিকার তথা তথ্যে অভিগম্যতা নিশ্চিত করা একান্ত আবশ্যক। তথ্যের অধিকার ছাড়া সংবিধানে বর্ণিত নাগরিকের অন্যতম মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃত চিন্তা, বিবেক, বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা অকল্পনীয়। তথ্য অধিকার আইনে স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রদানের কথা বলা হয়েছে। ব্যতিক্রম ক্ষেত্র ছাড়া প্রায় সকল সরকারি দপ্তর তাদের যাবতীয় তথ্য ক্যাটালগ ও ইনডেক্স প্রস্তুত করে সংরক্ষণ করে এবং জনগুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও নাগরিক সেবার তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে। অনেক সরকারি দপ্তর বার্ষিক প্রতিবেদন ওয়েবসাইটে প্রকাশ করছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দপ্তর তাদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ করছে। তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিকের তথ্য লাভের অধিকার রয়েছে এবং কোনো নাগরিকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তথ্য প্রদানে বাধ্য থাকবে। তবে তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯-এর ধারা ৭ অনুযায়ী বাংলাদেশের নিরাপত্তা, অখÐতা ও সার্বভৌমত্ব সম্পর্কিত তথ্য, কপিরাইট বা বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ সম্পর্কিত তথ্য, তদন্তাধীন বিষয় ও আইনে তথ্য প্রদানে নিষেধ রয়েছেÑ এমন তথ্য প্রদান করা যাবে না। তথ্য অধিকার আইনের মাধ্যমে জনগণের তথ্য লাভের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই অধিকারের যথাযথ প্রয়োগের জন্য নাগরিককে তথ্য সাক্ষরতা অর্জন করতে হবে। কোন তথ্য কোথায় পাওয়া যাবে? কীভাবে পাওয়া যাবে? তথ্যটি সঠিক কিনা? তথ্যটি কী কাজে লাগবে? এসব বিষয়ে নাগরিকের স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে।

মৌলিক সাক্ষরতার পরবর্তী ধাপ হলো তথ্য সাক্ষরতা। বাংলাদেশে বর্তমান সাক্ষরতার হার ৭৬ শতাংশ। দেশে তথ্য সাক্ষরতা নিয়ে এখনও সরকারি পর্যায়ে কোনো জরিপ হয়নি। তবে তথ্য সাক্ষরতার হার যে মৌলিক সাক্ষরতার হারের চেয়ে অনেক কম তা সহজে অনুমেয়। তথ্য সাক্ষরতা অর্জনে বেশ কিছু করণীয় বিষয় রয়েছে।

প্রথমত, নাগরিককে তথ্যপ্রযুক্তি সচেতন হতে হবে। স্মার্ট ফোনে বা কম্পিউটারে তথ্য অনুসন্ধান করে খুঁজে বের করার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, তথ্যের উৎস সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার, তথ্য অধিদফতরের তথ্যবিবরণী ও প্রেস নোট, বেসরকারি বহুলপ্রচলিত প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে সংবাদের উৎস হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে কোনো বেসরকারি মিডিয়ার তথ্য খুব স্পর্শকাতর মনে হলে তা অবশ্যই বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারের সংবাদ কিংবা তথ্য অধিদফতরের তথ্যবিবরণীর সঙ্গে মিলিয়ে নিতে হবে। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে।

তৃতীয়ত, তথ্যের যথার্থতা যাচাই করতে হবে। অর্থাৎ কোনটি তথ্য আর কোনটি গুজব সেটি বুঝতে হবে। গুজব প্রতিরোধে একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হলো ‘ট্রিপল ফিল্টার টেস্ট’। একটি গল্পের মাধ্যমে ‘ট্রিপল ফিল্টার টেস্ট’ সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক। একদিন একজন লোক বিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিসের কাছে এসে বললেন, ‘সক্রেটিস, তুমি কি জানো এইমাত্র আমি তোমার বন্ধুর ব্যাপারে কী শুনে এলাম? সক্রেটিস বললেন, ‘এক মিনিট দাঁড়াও, তুমি আমার বন্ধুকে নিয়ে ঘটনাটি বলার আগে আমি তোমাকে তিনটি প্রশ্ন করব। প্রশ্ন তিনটির সদুত্তর দিতে পারলে তোমার কথা শুনবো। প্রথম প্রশ্নটি সত্য-মিথ্যা নিয়ে, তুমি কি নিশ্চিত তুমি আমাকে যা বলতে যাচ্ছ তা নির্ভেজাল সত্য? লোকটি উত্তর দিল, না, আমি জানি না এটা সত্য কিনা, আসলে আমি একজনের কাছে শুনেছি।’ সক্রেটিসের দ্বিতীয় প্রশ্ন, তুমি কি আমার বন্ধু সম্পর্কে ভালো কিছু বলবে?’ লোকটি বললেন,‘না, আসলে খারাপ কিছুই...।’ সক্রেটিসের তৃতীয় প্রশ্ন, তুমি আমাকে যা বলতে যাচ্ছ তা কি আমার জন্য উপকারী? লোকটি উত্তর দিল, ‘না, আসলে তোমার জন্য তা উপকারী নয়।’ এবার সক্রেটিস শেষ কথাটি বললেন, ‘তুমি আমাকে যা বলতে চাও তা সত্যও নয়, ভালো কিছুও নয় এবং আমার জন্য উপকারীও নয়, তবে তা আমাকে বলে কী লাভ!’ উল্লিখিত ঘটনাটি থেকে এটি পরিষ্কার যে, কোনো একটি তথ্যের সত্যতা যাচাই না করে তা প্রচার করা ঠিক নয় এবং এ রকম প্রচারণায় কান দেওয়াও উচিত নয়। কোনো একটি বিষয় বা তথ্যকে বিশ্বাস করার আগে আমরা তা সক্রেটিসের দর্শনভিত্তিক ধারণার মতো ‘ট্রিপল ফিল্টার টেস্ট’ করে নিতে পারি।

চতুর্থত, তথ্যকে জীবনমান উন্নয়নে কাজে লাগাতে হবে। অযথা হয়রানির জন্য কর্তৃপক্ষের নিকট তথ্য চাওয়ার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

পঞ্চমত, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুক ও ইউটিউবে প্রচারিত গুজব সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত কোনো বিষয় শেয়ার কিংবা লাইক, কমেন্ট করার আগে অবশ্যই তার সত্যতা যাচাই করতে হবে।

ষষ্ঠত, তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী তথ্য প্রাপ্তির আবেদনের পূর্বে কাক্সিক্ষত তথ্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরের ওয়েবসাইটে আছে কি না-তা যাচাই করতে হবে। উল্লিখিত ছয়টি বিষয় তথ্য সাক্ষরতা অর্জনের অন্যতম পূর্বশর্ত। বাংলাদেশের তৃণমূল পর্যায়ের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী এখনো তথ্য অধিকার ও তথ্য সাক্ষরতা বিষয়ে অবগত নন। তথ্য অধিকার যে একটি আইনগত অধিকার সেটিকে তৃণমূল পর্যায়ে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে পাশাপাশি তথ্য সাক্ষরতা সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে হবে।

তথ্য অধিকার বাস্তবায়ন ও নাগরিকের তথ্য সাক্ষরতা অর্জনে জনপ্রতিনিধি, সুশীল সমাজ, গবেষক, সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, সরকারি কর্মকর্তা, সাংবাদিক, শিক্ষক-সহ সংশ্লিষ্ট সকলকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নের অন্যতম শর্ত হলো নাগরিকের তথ্য সাক্ষরতা অর্জন। নাগরিকের তথ্য সাক্ষরতা অর্জনের মাধ্যমে গুজবকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করা সম্ভব। (পিআইডি ফিচার)

লেখক : সিনিয়র তথ্য অফিসার, আঞ্চলিক তথ্য অফিস, রংপুর

এই বিভাগের আরও খবর