লালমনিরহাট বার্তা
জেলিফিস প্যারেন্টিং ও বেপরোয়া কৈশোর
প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম | ১ মে, ২০২৪, ৬:৫৩ AM
জেলিফিস প্যারেন্টিং ও বেপরোয়া কৈশোর

কিশোর গ্যাং বা উঠতি বয়সের ছেলেদের নিয়ে দলবদ্ধভাবে গড়ে উঠা সন্ত্রাসী কর্মকান্ড নিয়ে আজকাল চিন্তার অন্ত নেই। এই চিন্তা পরিবার থেকে সমাজ ছাড়িয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র পর্যন্ত সবাইকে নাকাল করে তুলেছে। বহু কিশোর অবাধ্য ও বেপরোয়া হয়ে আমাদের সমাজের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবন যাপনে অপারগতা প্রকাশ করতে শুরু করায় তাদের ‘বিগ বস’-দের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরী ও লালনকৃত গ্যাং সমস্যা দিন দিন ভয়ানক হয়ে উঠছে। সাধারণত: টিন এজার যাদের বয়স শৈশব পেরিয়ে থারটিন থেকে নাইনটিন তাদেরকে কিশোর বলা হয়ে থাকে। যদিও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আবহাওয়া ও পরিবেশের প্রভাবে আন্তর্জতিকভাবে আঠারো বছর পর্যন্ত বয়সকে শিশু হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।

বাংলাদেশে মেয়েদের বিয়ের আইনত যোগ্য বয়স আঠরো ও ছেলেদের জন্য একুশ নির্ধারিত হয়েছে। কিন্তু কিশোরদের বয়সসীমা ‘টিনটিন’বা তের-উনিশ পেরিয়ে যুবক বা এডাল্ট হিসেবে সামাজিক স্বীকৃতি না পাওয়া পর্যন্ত একাধারে চলতেই থাকে। আর তাইতো আমাদের দেশে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য হিসেবে যাদেরকে বিভিন্ন অপরাধে গ্রেপ্তার করে গণমাধ্যমে দেখানো হয় তাদের অনেকের বাহ্যিক চেহারা দেখে আরো বয়স্ক বলে মনে হয়।

যাহোক, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের এনআইডিতে উল্লিখত জন্মতারিখ অনুযায়ী বয়সের তথ্য প্রচারিত না হবার কারণে সর্বনিম্ন বয়সের মধ্যে শিশুর সংজ্ঞা অনুযায়ী শিশু ও রাজনৈতিক দর্শনে বিবাহিত, চল্লিশোর্ধ অনেককে রাজনীতিতে যুবনেতা হিসেবে চালিয়ে প্রায়শই মিশ্রিত করে ফেলা হয়।

আমাদের দেশে শিশু-কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা দিন দিন বেড়ে যাবার নানা কারণ বিদ্যমান। এর পেছনে শত শত কারণ ধরা যেতে পারে। এর মধ্যে একটি অন্যতম কারণ হলো অণুপরিবার ও পরিবারবিহীন জন্মনেয়া শিশু। বাংলাদেশের কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের মধ্যে অনেকের পরিবার নেই, আইনী অবিভাবক নেই। তারা জন্ম থেকে বিচ্ছিন্ন ও ভাসমান শ্রেণির।

আবার অনেক শিশু-কিশোরের পরিবার ও পারিবারিক আবহ অনেক উন্নত এবং জীবনযাত্রা অত্যন্ত আধুনিক। অনেকটা উন্নত বিশ্বের পারিবারিক পরিবেশের আদলে তারা বেড়ে উঠে। এই শ্রেণির শিশু, কিশোর-কিশোরীরা ‘জেলিফিস প্যারেন্টিং’-এর বৈশিষ্ট্যে লালিত হয়ে জীবন শুরু করে।

‘জেলিফিস প্যারেন্টিং’ হলো বাবা-মা অথবা অভিাবকের মাধ্যমে সন্তান বেড়ে তোলার এক ধরনের প্রচলিত ব্যবস্থা যেখানে শিশুকাল থেকে অতি নমনীয়, তুলতুলে আদর যত্নে শিশু-কিশোরদেরকে লালন পালন করা হয়ে থাকে। জেলিমাছের যেমন শক্ত হাড় নেই, বাবা-মা তেমনি কোন শক্ত ভূমিকা পালন করতে পারেন না। এই ধরণের পরিবারে বাবা-মা তাদের শিশুদেরকে কোন কিছুর মধ্যে আবদ্ধ রাখে না, তাদের উপর কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয় না। শিশু-কিশোররা যখন যা চায় বা বায়না ধরে তখনই সেটা পরিপূরণ করা হয়। বাবা-মায়েরা শিশুদের সাথে কোনরুপ বিবাদে জড়ায় না।

এখানে বাবা-মা সন্তানের কাছে কোন আদর্শ নয়। সন্তানরা তাদের নিজ নিজ ইচ্ছানুযায়ী অতি স্বাধীন জীবন যাপন করতে পারে। এমনকি বাবা-মা বকুনি দিলে সন্তান পুলিশকে ফোন করে বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে নালিশ করতে পারে। এটা আধুনিক পশ্চিমা স্টাইল। এরা বাবা-মায়ের সাথে একসংগে বসে মদ পান করে মাতাল হতে দ্বিধা নেই। তবে এই স্টাইল আমাদের দেশে শহরাঞ্চলে বিত্তশালী পরিবারগুলোতে ভিন্নভাবে বিরাজমান।

‘জেলিফিস প্যারেন্টিং’-এর বৈশিষ্ট্যে লালিত শহরাঞ্চলে বিত্তশালী পরিবারগুলোতে বেড়ে উঠা শিশু কিশোরদের অনেকেই বড় হতে গিয়ে বেঁকে যায়। তাদের বাইরের পৃথিবীর বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে মনস্ত¡াত্বিক বিকাশ ঠিকমতো না হওয়ায় একটুতেই ঘাবড়ে যায়। আমাদের সমাজে বাবা-মায়েরা তাদেরকে অতি যতেœ লালন করে, গৃহশিক্ষক রেখে শিক্ষা দেয়, দামী পোশাক, ভাল খাবার খেতে দেয়। তবে ক্যারিয়ার গঠণে পশ্চিমাদের মতো উদার না হয়ে নানামূখী চাপ সৃষ্টি করে। পরীক্ষায় এ-প্লাস ফলাফল তাদের জন্য চাই। অথবা নামকরা বিদেশী প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার জন্য ভর্তি অথবা শিক্ষা শেষে ভালো চাকুরী যোগাড় বা কিনে দেয়ার ক্ষমতা ‘জেলিফিস প্যারেন্টিং’-এর বৈশিষ্ট্যধারী বিত্তশালী পরিবারগুলোতে বিরাজমান থাকে।

তবে একটু বড় হয়ে এসব শিশু-কিশোররা তাদের বাবা-মায়ের কাছে আসল চরিত্র খুঁজে পায় না। স্কুলে শিক্ষকদের কাছে শেখা নৈতিক জ্ঞানের নীতির অনুশীলণ বাড়িতে এসে বাবা-মায়ের মধ্যে দেখতে পায় না। এসব জানতে গেলে অনেক বাবা-মা তাদের সন্তানদেরকে এড়িয়ে চলেন অথবা ভুল উত্তর দেন। এসব দেখে তারা সন্তানের প্রতিঅবহেলা শুরু করেন। সন্তানরাও একসময় বিগড়ে যায়। যেহেতু তারা পরিবার থেকে কোন পরামর্শ নেবার দরকার মনে করেনি সেহেতু হঠাৎ করে বাইরের পরিবেশে গেলে তারা উপযোজন লাভে ব্যর্থ হয়। আবার হঠাৎ কোন খারাপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়ে। অনেকেই দিশেহারা হয়ে পাঠে অমনোযোগী হয় ও ‘এটারাক্সিয়ায়’ভুগতে শুরু করে। অনেকে ঘর পালায়। আবার অনেকে নষ্ট বন্ধু বা সহপাঠীদের নিকট থেকে সিগারেট, মাদক ইত্যাদিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।

কোন কোন কিশোরদের সহপাঠী বা বন্ধুদের ১০ জনের মধ্যে সাতজনই ধূমপায়ী হলে একজন আর সাধু সেজে ভাল থাকার উপায় খুঁজে পায় না। একসময় সেও ওদের পাল্লায় পড়ে মাদক গ্রহণ করে। মাদকের টাকা যোগাড় করতে গিয়ে মা-বাবার উপর চাপ দেয়। না পেলে চুরি করে, মিথ্যে বলে অপরাধী হয় এবং ক্রমাগত বাড়তি টাকা যোগাতে ছিঁচকে অপরাধীদের জগতে প্রবেশ করে। সেখানে তারা বড় বড় গ্যাংয়ের কবলে নিপতিত হয়। ‘জেলিফিস প্যারেন্টিং’-এ লালিত হওয়া কিশোরটি ভাসমান কিশোর অপরাধী গোষ্ঠীর সান্নিধ্যে চলে এলে মাফিয়াদের কল্যাণে সে একসময় সেই কিশোর গ্যাংয়ের নেতা মনোনীত হয়। সেখানে তার সমুদয় চাহিদা পরিপূরণের অবাধ সুযোগ দেখে হাতের কাছে অস্ত্র, মাদক, অর্থ সবকিছু পেয়ে ভয়ংকর ‘গ্যাং লিডার’বনে যায়।

দেশে দেশে কিশোর অপরাধীদের নিয়ে অনেক উপাখ্যান তৈরী হয়েছে, হয়েছে অনেক গবেষণা নির্ভর প্রকাশনা। সেগুলোতে শিশুশ্রম, শিশুদের প্রতি নিষ্ঠুরতা, ভিক্ষাবৃত্তি চালানো, শিশু পতিতাবৃত্তি, পানশালায় ওয়েটারগিরি, জমিদখল, চাঁদাবাজি, সর্বপোরি শিশুদের দিয়ে যুদ্ধের মারণাস্ত্র বহন- এগুলো খুবই ভয়ংকর বিষয়।

আজকাল অবাধ ইন্টারনেটের সুবাদে থ্রিল, হিরোইজম, মাদকগ্রহণ, পর্ণোছবি, ইত্যাদি দেখে ঘরে একা একা বসেই নিসঙ্গতা থেকে অনেক শিশু কিশোর পাকামি শিখে ফেলছে। এআই ব্যবহারের সুবাদে সাইবার ক্রাইম নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। রাজধানীর বস্তিতে বেড়ে উঠা বার থেকে তের লক্ষ শিশু-কিশোর রয়েছে। এদর সাথে নেটওয়ার্ক রয়েছে ‘জেলিফিস প্যারেন্টিং’-এ লালিত হওয়া বিত্তশালী ঘরের বখাটে কিশোররা। তারা অকুতোভয়ে লিড দেয়। তাই আমাদের দেশে কিশোর গ্যাং সমস্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। তাদের নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে সংশ্লিষ্ট পরিবার ও অভিভাবকেদের মধ্যে। পাশাপাশি কিশোর গ্যাং সমস্যা নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী সংস্থাগুলো নাজেহাল হয়ে পড়ছেন।

অপরদিকে ‘জেলিফিস প্যারেন্টিং’-এর বৈশিষ্ট্যে পরিবার ছেড়ে স্কুলে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সেখান থেকে শিক্ষার্থীদেরকে শাসন করার সিস্টেম উড়ে গেছে। স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পিয়ারগ্রæপ এখন নষ্ট রাজনীতির কবলে রাহুগ্রস্থ। এমনকি দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকগণও একই দোষে দুষ্ট হয়ে পড়ছেন। ফলস্বরুপ পাঠদান বাদ দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বুলিং, টিজিং, যৌন নিপীড়ণ ইত্যাদি নানাবিধ কুকর্ম ফুলে ফেঁপে উঠছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন নামীদামী স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ ধরণের ন্যাক্কারজনক ঘটনাবলী ও তার প্রেক্ষিতে বিভিন্ন অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ, মামলা, প্রতিবাদ মিছিল, ধর্মঘট ইত্যাদি তার প্রমাণ।

সেজন্য পরিবার থেকে রুট খুঁজে বের করতে হবে। ‘জেলিফিস প্যারেন্টিং’-এর বৈশিষ্ট্যে পরিবারগুলোকে সাবধান হতে হবে। বাংলাদেশের কৃষ্টিতে বসবাস করে পশ্চিমা কৃষ্টির লালন ও চর্চ্চা আমাদের জন্য খুবই সাংঘর্ষিক। এটা প্রক্রিয়া দিন দিন সামাজিক দূরত্ব বাড়াচ্ছে। অপরদিকে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেও ‘জেলিফিস প্যারেন্টিং’-এর আবহে ‘জেলিফিস টিচিং ও লার্নিং’সেটাও অতি সাংঘর্ষিক হিসেবে আবির্ভূত হয়ে পড়েছে। পশ্চিমা বিশ্বে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীর সাথে বসে দামী ওয়াইন খায়। সেটা তাদের কৃষ্টির চলমান ধারা। আমাদের দেশজ সংস্কৃতির লালন করে আমাদেরকে নিজেকে বেঁচে থাকার সঠিক উপায় খুঁজে নিতে হবে।

তা-না করায়, ‘পান থেকে একটু চুন খসা’-র মতো ছোট সমস্যা হলেই নানা কারণে সেটাকে আরো বেশী জটিল থেকে জটিলতর করে তোলা হচ্ছে। বিশেষ রাজনৈতিক চাপ ও আবহের মধ্যে দায়িত্বে থেকে পুলিশের পক্ষে এধরণের সামাজিক সমস্যা নিরসন অসম্ভব। যা আমাদের আর্থ-সামাজিক ও পারিবেশিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করার জন্য খুবই ভয়ংকর রূপে ধেয়ে আসছে।

শিশুকে হাঁটতে শেখান, হাঁটা শিখলে নিজে নিজে চলতে দিন। কোথাও পড়ে গেলে সে যেন নিজেই উঠে দাঁড়াবার শক্তি অর্জন করে আবার গা ঝাড়া দিয়ে সোজা হয়ে উঠে হাঁটতে পারে সেই অনুপ্রেরণা দিন। বাংলাদেশে একদিকে অতি আদর অন্যদিকে অতিদারিদ্র ওদেরকে দিশেহারা করে অবৈধ পথ বেছে নিতে বাধ্য করছে। যেটা ইতোমধ্যে কিশোর গ্যাং নামে অতি মারমুখী চরিত্র ধারণ করে সমাজে বিষবাষ্প ছড়ানো শুরু করেছে। আপনার আমার উঠতি ছেলেমেয়েরা যেন ভুলপথে পা না বাড়ায় সেজন্য প্রতিটি পরিবারকে সতর্কতা অবলম্বন করার বিকল্প নেই।

‘জেলিফিস প্যারেন্টিং’-এর আবহে ‘জেলিফিস টিচিং লার্নিং ও সার্ভিসিং’কোনটাই আমাদের সমাজের পরিবেশ উপযোগী হতে পারে না। আমাদের নিজস্ব কৃষ্টি ও স্বকীয়তা থেকে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবন যাপনের দিকে এগিয়ে আসতে হবে। ভালভাবে বেঁচে থাকতে হলে একটি ‘ট্রান্সফরমেটিভ চেঞ্জ’ও লিভিং উইথ হারমোনি’-র বিচারে সবাইকে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবন বেছে নিতে হবে। অসামঞ্জস্যপূর্ণ সবকিছুই পরিহার করতে হবে। নিজের জীবনের রূপকার নিজেকেই হবার চেষ্টা করতে হবে।

সেটা দ্রুত করতে না পারলে সমাজ আরো বেশী অস্থির হয়ে পড়বে এবং অবাধ্য ও বেপরোয়া কিশোর গ্যাংয়ের মতো একটি সংক্রমিত সমস্যা সিংহভাগ জনমনে ভয়ংকর সমস্যা হিসেবে অশান্তি ছাড়াতেই থাকবে বৈ-কি?

(লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন) 

fakrul@ru.ac.bd

এই বিভাগের আরও খবর