লালমনিরহাট বার্তা
নেতৃত্ব শূন্যতার দিকে বাংলাদেশ ?
ইয়ার আলী | ৯ মে, ২০২৪, ৬:৩৪ AM
নেতৃত্ব শূন্যতার দিকে বাংলাদেশ ?

ভুমিকা-একটি দেশ পরিচালনার জন্য এক দিনই কোন নেতা তৈরি হয় না। তিলে তিলে অনেক ঘাত প্রতিঘাত সহ্য করে রুট পর্যায়ে থেকে একজন নেতা আস্তে আস্তে গড়ে উঠে। শুধু মাত্র তাদের দ্বারাই একটি রাষ্ট্র বা একটা দেশ সুন্দরভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয় এবং রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা করা যায়।

পৃথিবীর প্রতিটা দেশেই রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যক্তিগণ একেবারেই রুট লেভেল বা গ্রাম্য লেবেল থেকেই উঠে আসে। অনেক ক্ষেত্রে যারা হঠাৎ করে এসে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে পরিচালনা করার চেষ্টা করে থাকে, তারা কখনোই প্রথমের দিকে রাষ্ট্রকে সঠিক ভাবে সুন্দরভাবে পরিচালনা করতে পারে না। রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের পারদর্শী হতে বেশ সময় লেগে যায়।তাদের রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে সহায়তা গ্রহণ করতে হয়। যদি রাজনৈতিক বুদ্ধি পরামর্শ সহায়তা ভুল পথে পরিচালিত হয় তাহলে তিনি/তারা চলতি পথেই ধ্বংস হয়ে যান। পৃথিবীতে এর নজির যথেষ্ট রয়েছে এমনকি বাংলাদেশেও এই নজির রয়েছে। তাই রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য ঝানু রাজনীতিবিদ বিচক্ষণ ব্যক্তি অবশ্যই দরকার। বর্তমানে রাজনীতির অবস্থা হচ্ছে:-

“আমরা হতে যাচ্ছি মেধাশূন্য জাতি, রাজনীতিতে নাই এখন আদর্শের নীতি। সমাজের ভালো মানুষ করছেনা রাজনীতি, দুষ্ট লোকেরা ঘোষণা দিয়ে করে রাজনীতি” বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট- বেশ কিছুদিন থেকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট পর্যবেক্ষণ করে অনুধাবন হচ্ছে যে, এদেশ পরিচালনার জন্য বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ছাড়া তেমন কোন ঝানু রাজনীতিবিদ দেখা যাচ্ছেনা।সে কথাটি গতকাল প্রধানমন্ত্রী তার নিজের মুখ দিয়েও প্রকাশ করেছেন। যে উনার বিকল্প হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনা করার মত কোনো লোক তিনি দেখেন না। বাস্তবেও গভীরভাবে দেখলে বিকল্প লোক এই মুহূর্তে দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে যারা ঝানু রাজনীতিবিদ হিসেবে মানুষের কাছে অধিক পরিচিত, তারা অনেকেই ইতিমধ্যেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন অথবা অনেকেই বিদায় নেওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছেন। বার্ধক্য তাদেরকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরেছে যে তারা আর দেশ সেবার বা পরিচালনার কোন শারীরিক ক্ষমতা রাখেন না। বাংলাদেশে ঝানু এবং দেশ পরিচালনায় অভিজ্ঞ ব্যক্তিগণের তালিকায় যাদের নাম বেশী মনে করা হয় তার মধ্যে- বর্তমান প্রধানমন্ত্রী -শেখ হাসিনা সাবেক প্রধানমন্ত্রী -বেগম খালেদা জিয়া অন্যতম।

কিন্তু দুজনেরই বয়স এখন ৯০ এর কাছাকাছি।পৃথিবীতে তাদের বয়সসীমা সীমাবদ্ধতার একটা পর্যায়ে এসে গেছে।

অন্যান্য রাজনীতিবিদ হিসেবে যাদের নাম জনগণ জানে, তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী যারা বয়সের একবারে শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে। বাংলাদেশ জাতীয়বাদী দলের পক্ষ থেকে রফিকুল হক, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার চলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতেছে প্রায়। এমনকি বর্তমান সেক্রেটারি জেনারেল ফখরুল ইসলাম সাহেব তিনি নিজেও অসুস্থ স্বাস্থ্যগত কারণে প্রায়ই দল থেকে অবসর নেওয়ার চিন্তা করে যাচ্ছে। আর জনাব রেজভী সাহেব বার্ধক্য আক্রান্ত। উভয় দলের মধ্যে অন্যান্য যারা রয়েছে তারা কোন না কোন দোষে দোষী সাব্যস্ত । জনগণ তাদের ব্যাপারে বিভ্রান্তিতে রয়েছে। জাতীয় পার্টির কিছু নেতা অভিজ্ঞ পলিটিশিয়ান হিসেবে বাংলাদেশে পরিচিত থাকলেও তাদের রাজনৈতিক আইডেন্টিটি যেহেতু ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে, সে কারণে তারাও জনমনে আর বিশ্বাসে জায়গায় থাকতে পারতেছে না, বিধায় তাদের কোন নেতার রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে সুযোগ হবে বলে মনে হয় না। ঝানু রাজনীতিবিদ হিসেবে রাশেদ খান মেনন এখনও চলাচল করার মতো শক্তি রাখে কিন্তু তার রাজনৈতিক শক্তি একেবারেই ক্ষীন। রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রায় অযোগ্য। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে ধর্মীয় আদর্শবাদী রাজনৈতিক দল গুলোর মধ্যে উপযুক্ত ঝানু রাজনীতিবিদ হিসেবে যারা ছিলেন তারা সকলেই আজকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। এখন যারা রয়েছেন তারা সবাই নবীন এবং রাষ্ট্র পরিচালনার সার্বিক যোগ্যতা রয়েছে কিনা তা এখনো প্রমাণিত হয়নি।

নতুন নেতা কেন হচ্ছে না- নতুন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কেন তৈরি হচ্ছেনা। এই বিষয়টি আজকে ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার মনে হয় যে সমস্ত কারণে নতুন কোন আদর্শবান রাজনীতিবিদ বা ব্যক্তি তৈরি হচ্ছেনা তার অন্যতম কারণ গুলোর মধ্যে হলো:-

১) বিদ্যমান দলগুলোতে দলীয় প্রধানের পদ দীর্ঘদিন থেকে একই ব্যক্তির হাতে থাকার কারণে নতুন কোন নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে না।

২) দলীয় প্রধান ছাড়াও দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়ে পরিবর্তন হচ্ছে না ।সিলেকশন প্রক্রিয়া ব্যক্তির ইচ্ছা এবং আনুগত্যের উপরে নির্ভর করে বিধায় এই এক্ষেত্রে তোষামোদকারীরাই নির্বাচিত হয়ে থাকে,অভিজ্ঞরা বাদ পড়ে যায়।

৩) নেতৃত্ব তৈরি করার ক্ষেত্রগুলো সীমিতি হয়ে আসছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরীর ক্ষেত্র গুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।বিভিন্ন ছাত্র ইউনিয়ন নির্বাচন সমূহের মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরি করা হতো।যারা পরবর্তী জীবনে বৃহত্তর রাজনীতিতে নেতা হিসেবে পরিলক্ষিত হত।কিন্তু সেটাও দীর্ঘদিন হতে বন্ধ রাখা হয়েছে।এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখন আর রাজনীতি করাই যাচ্ছে না । এক্ষেত্রে নেতা তৈরীর কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে ।যে কারণে দেশে যোগ্য সৎ নৈতিক নেতা তৈরি হওয়ার জায়গা পাচ্ছে না।

৪) বাংলাদেশের নির্বাচন পদ্ধতি নেতা তৈরির প্রতিবন্ধক হিসেবে দাঁড়িয়েছে। কারণ সারা বছর যারা মাঠে ময়দানে রাজনীতি করে,ভোটের সময় তাদেরকে মনোনয়ন না দিয়ে হঠাৎ করে বড় ব্যবসায়ী বা বড় আমলা বা বাইরে থেকে লোক নিয়ে এসে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে ।এতে অরাজনৈতিক ব্যক্তিরা নির্বাচিত হচ্ছে আর রাজনীতিবিদদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। মনের দুঃখে রাজনীতিবিদরা রাজনীতি ছেড়ে এখন সমাজ বা সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

৫) নতুন করে যারা রাজনীতিতে আসছে তাদের জনসেবার মানসিকতার পরিবর্তে

অর্থনৈতিক ফায়দা হাসিলের মনোবৃত্তি বেশি করে কাজ করছে। যার কারণে তারা রাজনীতি নিয়ে পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে না,বিধায় একজন ঝানু রাজনীতিবিদ হিসেবে নিজেকে জাহির করতে পারতেছে না।উল্টো তারা একজন ঝানু অর্থ পাচারকারী হিসেবে বা অর্থ সংগ্রহকারী হিসেবে সমাজের কাছে পরিচিত লাভ করতেছে।

৬) অবসরপ্রাপ্ত আমলা বা বড় বড় ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক পদ দখল করলেও মানুষের মধ্যে বা মানুষের মনের মধ্যে কোন প্রকার প্রভাব বিস্তার করতে পারতেছেনা ।যে কারণে তাদেরকে রাজনীতিবিদ হিসেবে এখন মানুষ মনে করতে পারতেছে না ,বরঞ্চ উল্টো “রাজনৈতিক ব্যবসায়ী” হিসেবে মনে করতেছে ।যারা এই কাজে জড়িত তাদের দাঁড়া রাষ্ট্রের নির্বাহী কাজ অসম্ভব হবে।

৭) রাজনীতিবিদদের মধ্যে সহযোগিতা সহমর্মিতা আগে যেভাবে বিদ্যমান ছিল এখন তা নেই। রাজনীতির মাঠ এখন হিংসা ,ঘৃণা ব্যক্তি আক্রোশের জায়গায় পরিণত হয়েছে বিধায় একজন আরেকজনকে কখনোই বিশ্বাসের জায়গায় নিতে পারতেছে না।বিশ্বাসহীনতা কখনোই বড় রাজনীতিবিদ তৈরি করতে পারে না।

রাজনীতিতে সহমর্মিতা এবং ভালোবাসার উদাহরণ হিসেবে দেখা যায় যে,বাংলাদেশের স্বাধীনতায় অবিশ্বাস করার পরেও শাহ আজিজুর রহমান, আব্দুস সবুর খান, আব্বাস আলী খান সহ আরো অনেকে বাংলাদেশের পরবর্তী রাজনীতিবিদদের রাষ্ট্র পরিচালনায় যথেষ্ট সহযোগিতা এবং বুদ্ধি পরামর্শ প্রদান করেছিলেন।আজকে তাহা একেবারেই অনুউপস্থিত। রাজনৈতিক মাঠে রাষ্ট্র পরিচালনায় রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে এখন আর কোন লোক অবশিষ্ট নাই। আমলাদের নিয়ে রাজনৈতিক উপদেষ্টা তৈরি করতে হচ্ছে। যা রাজনৈতিকভাবে একটি রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য অনৈতিক।

বাংলাদেশে আদর্শবান রাজনীতিবিদের সমস্যা ভবিষ্যতে দেশকে অন্ধকারে ঠেলে দিতে পারে। এমনকি দেশের অযোগ্য নেতৃত্বের কারণে সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘিত হতে পারে। এ অবস্থায় দেশবাসীকে এখনই ভাবতে হবে ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য ভবিষ্যৎ নেতা তৈরি করার মাঠ কখনোই বন্ধ করে দেওয়া উচিত নয়। নেতৃত্ব যদি যোগ্য না হয় রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব যদি হুমকির মধ্যে থাকে তাহলে কোন উন্নয়নেই স্থিতিশীল থাকতে পারে না।তাই উন্নয়ন করার সঙ্গে সঙ্গেই দেশের সার্বভৌমত্বকে টিকে রাখার জন্য যোগ্য নেতৃত্ব সকল জায়গায় থাকার জরুরী প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।

নেতৃত্বশূন্য অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কি-

১) বাংলাদেশকে নেতৃত্বশূন্যতার হাত থেকে বাঁচার জন্য প্রথমেই বিদ্যমান দলসমূহের মধ্যে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি চালু করা উচিত। দলের বা পার্টির নেতৃত্ব তৈরি করার ক্ষেত্রে সেলেকশন পদ্ধতি এখনই বন্ধ করে দেয়া উচিত। তোষামোদ কারীর চেয়ে প্রতিযোগী রাজনীতিবিদ তৈরি করতে হবে এবং বুদ্ধিমান রাজনীতিবিদদের মাঠে রাখতে হবে।

২) বাংলাদেশে সকল রাজনীতিবিদদের নির্বিঘ্নে রাজনীতি করার অধিকার দেওয়া উচিত। যাতে সকলের মধ্যেই দেশ প্রেম দেশের প্রতি ভালোবাসা জন্ম নেয় এবং যেভাবেই হোক রাষ্ট্র পরিচালনার মত যোগ্যতা সৃষ্টি হয়।

৩) দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনীতি মুক্ত করা থেকে সরে আসা উচিত এবং রাজনীতি করার জন্য সেখানে অবশ্যই স্পেস দেওয়া উচিত। এমন কি ছাত্র ইউনিয়নগুলোকে পুন জীবিত করা উচিত।এতে দেশের রাজনীতির নতুন নতুন রাজনীতিবিদ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে।

৪) ভোটের মাঠে মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে মনোনয়ন বাণিজ্য নয়।স্থানীয় নেতৃত্বের মধ্য হতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সিলেকশন করে বা নির্বাচন করে তাদেরকেই মনোনয়ন দেওয়া উচিত ।উড়ে এসে জুড়ে বসে লোকদেরকে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হচ্ছে বলে মনে হয় না।

৫)আমলা,ব্যবসায়ী এবং অন্যান্য পেশাদারী লোকজন যারা রাজনীতির মাঠে আসতে চায়, তাদেরকে গ্রাম পর্যায়ে বা রুট লেভেলে রাজনীতি করে সেখান থেকেই প্রতিযোগিতা করে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা উচিত বলে মনে হয় ।এতে তারাও প্রশিক্ষিত হয়ে রাজনীতি করতে পারবে।

৬) রাজনীতিতে যারা অর্থনৈতিক সুবিধা হাসিলের জন্য অংশগ্রহণ করে,তাদেরকে সিলেকশন করে চিরতরে রাজনীতি থেকে বহিষ্কার করা উচিত এবং কোন দলই যেন তাদেরকে অন্তর্ভুক্ত না করে সে ব্যাপারে একটি আন্ত দলীয় চুক্তি হওয়া উচিত।

৭)একই ব্যক্তি বারবার যেন একই পদে আসতে না পারে সেই ব্যাপারে দলের গঠনতন্ত্র শোধন হওয়া উচিত।

৮) সর্বোপরি বাংলাদেশ একটি মুসলিম প্রধান দেশ। সেই কারণে এদেশে রাজনীতিবিদদের মধ্যে ধর্মীয় নৈতিকতা এবং ধর্মীয় জবাবদিহিতার বিষয়টি জাগ্রত করা উচিত।যাতে দেশ প্রেমকে তারা ঈমানের অংশ হিসেবে মনে করে।দেশকে কখনোই চুরি ডাকাতি বা অনৈতিকতার জায়গায় বসাতে না পারে।

দেশের সার্বিক কল্যাণই আমাদের কাম্য দেশ শান্তিতে থাকলে নাগরিক হিসেবে আমরা শান্তিতে থাকতে পারবো এই প্রত্যাশায়।

(লেখক: চেয়ারম্যান আলিবাবা থিম পার্ক লিমিটেড)

এই বিভাগের আরও খবর