লালমনিরহাট বার্তা
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগ, পাকিস্তান সৃষ্টি
বার্তা ডেস্ক | ১১ এপ্রি, ২০২৩, ৮:৫২ AM
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগ, পাকিস্তান সৃষ্টি

মওলানা ভাসানীর বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন:

১৯৩৭ সালে ভারত শাসন আইনে ভারতে দুটি বৃহৎ জাতিগোষ্ঠীর আলাদা রাষ্ট্র কাঠামোর যে পরিকল্পনা স্যার ক্রীপস মন্ত্রী মিশন প্রস্তাব কাঠামোর যে পরিকল্পনা লর্ড মাউন্ড ব্যাটন এর কাছ থেকে তা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে অনেকটা বাস্তবায়িত হলো। মুসলিম লীগ নেতারা তাদের মনমত যেমন খুশী একটি উদ্ভট রাষ্ট্র কাঠামোর পরিকল্পনা করলেন। যেখানে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে পাকিস্তন নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে, বাকীটুকু ভারতীয় প্রজাতন্ত্র হবে। কিন্তু মওলানা ভাসানী চাইলেন বৃহত্তর সিলেট বাংলাদেশের সঙ্গে থাকুক। কিন্তু কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ তা চাইলেন না। ফলে মওলানা ভাসানীর প্রতি কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ ক্ষেপে যান। তাই তারা মওলানা ভাসানীকেঈ গ্রেফতার করে আসাম কারাগারে নিক্ষেপ করে। সিলেটে গণভোট শেষ হলে সিলেট ভারতের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি পাবার পর ও পাকিস্তান সৃষ্টির পর সিলেট সীমান্ত দিয়ে মওলানা ভাসানীকে জেলখানা থেকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ১৯৪৭ সালে মওলানার ভাসানী আবার প্রথমে নিজ জেলা সিরাজগঞ্জ ও পরে টাঙ্গাইলের কাগমারীতে ফিরে এলেন। যে টাঙ্গাইলের মাটি থেকে তিনি সন্তোষের জমিদার জাহ্নবী চৌধুরানীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে গ্রেফতারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে আসমরে ধুবড়ী, ঘাগমারায় বসতি স্থাপন করেন। সেখানে জঙ্গল কেটে বাড়ি-ঘর নির্মাণপূর্বক বসবাস শুরু করেন। লোকে জায়গার নতুন নামকরণ করল হামিদাবাদ।

আসামে অবস্থানকালীন ভাসানীর জনহিতকর কর্মকান্ড:

১৯২৬ সালে মওলানা ভাসানীর কৃষক প্রজাদের নিয়ে সাংগঠনিক তৎপরতা ও সামন্ত বাদ বিরোধী আন্দোলন দেখে জমিদাররা রীতিমত ভয় পেয়ে যান। কি করে ভাসানীর মুখ বন্ধ করা যায়, কি করে কৃষক সমিতি সংগঠিত করার কাজ বন্ধ করা যায়, তাই সামন্ত প্রভুদের ভাবনা। নচেৎ কৃষক লাঠিয়াল বাহিনির হাতে প্রাণটা যেতে পারে। জমিদারদের অভিযোগে বাংলার গভর্ণর মওলানা ভাসানীকে বাংলাদেশে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে ও বাংলা থেকে বহিস্কারের আদেশ দেন। পরে মওলানা ভাসানী বাংলা থেকে আসামের ঘাগমারায় জঙ্গল পরিস্কার করে বাড়ি ঘর নির্মাণ পূর্বক বসবাস করতে থাকেন। অতি অল্প দিনেই তার জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। লোকে ঘাগমারার নতুন নামকরণ করেন মওলানা ভাসানীর নামে হামিদাবাদ। মওলানা ভাসানী সেখানে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মক্তব, মসজিদ ও দাতব্যখানা প্রতিষ্ঠা করেন। অল্পকাল পরেই তিনি চলে যান ধুবড়ীর ভাসান চরে। সেখানেও গড়ে তুলেন বহু স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মক্তব ও দাতব্য চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান। তার বহু ভক্ত অনুরক্তর সংখ্যা বেড়ে যায়। দূবদূরান্ত থেকে লোকজন তার কাছে আসে তাবিজ-কবজ ও পানি পড়ার জন্য। মওলানা ভাসানী যেহেতু একজন আধুনিক প্রগতিশীল চেতনার মানুষ, তাই তিনি পানি পড়ার পাশাপাশি লোকজনকে ঔষধ কিনে খেতে বলেন। লোক তাকে ডাকতে থাকেন ভাসানচরের মওলানা বলে। সেই থেকে তার নামের সঙ্গে মওলানা ভাসানী বিশেষণটি যুক্ত হয়ে আছে। এক বাক্যে মওলানা ভাসানী নামেই মানুষ তাকে চেনে, জানে ও তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন।

মওলানা ভাসানীর লাইন প্রথা বা বাঙাল খেদাও এর বিরুদ্ধে আন্দোলন:

১৯৩৫ সালে আসামে বসবাসরত বাঙালিদের বিভাজনের যে কুখ্যাত আইন লাইন প্রথা আসাম সরকার শুরু করেন মওলানা ভাসানী তার বিরুদ্ধে তীব্র গণআন্দোলন শুরু করেন। আসামের এই কুখ্যাত নীতির বিরুদ্ধে জনগণকে সাথে নিয়ে এক দুর্বার গণআন্দোলান গড়ে তুলেন তিনি। মওলানা ভাসানীর ডাকে লক্ষ লক্ষ মানুষ ভাসানচরের মওলানা ভাসানীর বাড়ির কাছে এক বিশাল গণজমায়েতে অংগ্রহণ করে পুরো ভাসানচর দখল করে নেয়। মওলানা ভাসানীর এই আন্দোলনকে দমন করতে আসামী প্রাদেশিক সরকারের পুলিশ বাহিনি নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে ঘটনাস্থলেই ৭ জন নিহত হন এবং ২৫ জন আহত হন। শুধু তাই নয় সরকারি বাহিনি ভাসনচরের বাঙ্গালিদের বাড়ি ঘর সকল অবকাঠামো ক্ষেতের ফসল হাতি নামিয়ে সব ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়। মওলানা ভাসানী আসাম চাষী মজুর সমিতি গঠন করেন। আসাম সরকারের এ সকল দমন নীতি প্রতিহত করার লক্ষ্যে দুর্বার গণআন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন। মওলানা ভাসানী আসাম কৃষক সমিতির সভাপতি এবং নুরুল হক নামের একজন স্থানীয় কৃষক নেতা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আসামের গোয়াল পাড়ার হিন্দু জমিদার ঘটালেন আরেক কাÐ। সে তার এলাকার মুসলমান প্রজাদের কাছ থেকে হলফ নামা লিখিয়ে নেয় যে, তার এলাকায় কোন মুসলমান প্রজা গো হত্যা করলে তার সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে। মুসলমান প্রজাদের উপর এমন ধর্মীয় নিপীড়ন আসামের লাইন প্রথা আন্দোলনের বিরুদ্ধে আরেক মাত্রা যোগ হলো। আসামের হিন্দু নেতাদের এমন সাম্প্রদায়িক মানসিকতার ফলে বাঙাল খেদাও আন্দোলন যেন নিচে পড়ে গেল। এই ইস্যুতে আসামের বাঙালিদের পক্ষে জনমত গড়ে উঠে। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক আসাম কোর্টে কুখ্যাত লাইন প্রথার বিরুদ্ধে মামলা করলে আসাম কোর্ট নির্যাতিত মানুষের পক্ষে আদালতে রায় প্রদান করেন। মওলানা ভাসানীর আন্দোলন সার্থক রূপ লাভ করে। কোর্ট আরও বলেন বাঙাল খেদাও আন্দোলন অনৈতিক, বেআইনী ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন। ১৯৩৭ সালে আসাম প্রাদেশিক নির্বাচনে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ ৩৪ টি আসনের ৩১ টিতে জয় লাভ করে। মওলানার সুযোগ্য নেতৃত্বই আসামী মুসলিম লীগের জয়লাভের মূল কারণ। মওলনা ভাসানী আসামী প্রাদেশিক আইন সভার সদস্য নির্বাচত হন। তার আপসহীন নেতৃত্বেই সে যাত্রায় আসামের কৃষক বাঙালিগণ আসাম সরকারের বিতরণের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল। ১৯৪৭ সালে দেশে ফিরেন মওলানা ভাসানী। সিলেট আসেন হিন্দু মুসলিমকে বাংলাদেশে যুক্ত রাখার পক্ষে রায় দিতে বলেন। গণভোটের আগে আসামী পুলিশ তাকে সিলেট থেকে গ্রেফতার করেন এবং ২১ মে মুক্তি দেয়। পুনরায় তাকে ১৪ আগস্টের পূর্বে আবার গ্রেফতার করেন। ১৯৪৮ সালের আসাম প্রাদেশিক সরকারের আদেশে দেশে ফিরে যাওয়ার শর্তে সিলেট সীমান্তে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। তিনি বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার টাঙ্গাইল মহুকুমার কাগমারীতে বসবাস করতে থাকে।

মওলানা ভাসানীর টাঙ্গাইলের উপ-নির্বাচনে অংশগ্রহণ:

১৯৪৮ সালে মওলানা ভাসানী বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার টাঙ্গাইল মহুকুমার কাগমানীতে বসবাস করতে থাকেন। তখন পূর্ব পাকিস্তানের মূখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন যেহেতু প্রাদেশিক আইন সভার সদস্য ছিলেন না। তাই তিনি টাঙ্গাইলের উপ-নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী হলেন। কিন্তু টাঙ্গাইলের জনগণ যেহেতু তাদের প্রিয়নেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীকে প্রার্থী ঘোষণা করেন, তখন খাজা নাজিম উদ্দিন নিজে প্রার্থী না হয়ে করটিয়ার জমিদার খুররম খান পন্নীকে মুসলিম লীগের প্রার্থী ঘোষনা করলেন। নির্বাচনে জনগণের প্রার্থী মওলানা ভাসানী বিপুল ভোটে পূর্বপাকিস্তান প্রাদেশিক আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন। প্রথম অধিবেশনেই মওলানা ভাসানী জনগণের পক্ষে অবস্থান নিয়ে জোরালো ভাষণ প্রদান করেন। তার বাজেট বক্ততায় মওলানা ভাসানী বলেছিলেন,“যে বাজেট পেশ করেছেন মাননীয় অর্থ সচিব, তাতে আমলাদের ভোগ বিলাসের জন্য সবকিছু করেছেন। দেশের মেরুদন্ড কৃষক মজুর যারা দিন রাত হাড়ভাঙ্গা খাটুনী খেটে রাজস্ব জোগায় তাদের জন্য কিছুই করেননি। শতকর চারজন লোক শহরে বাস করে তাদের পানীয় জলের জন্য ১০ লক্ষ টাকা বরদ্দ করেছেন; কিন্তু চার কোটি ষাট লাখ গ্রামবাসীর জন্য কোন পানীয় জলের জন্য কোন ব্যবস্থা করেননি। উত্তরবঙ্গে ১৯৪৪-৪৫ সালে পুলিশ খাতে ব্যয় বরাদ্দ করা হয়েছিল ৩ কোটি ২ লাখ ১৪ হাজার টাকা, আর আমাদের মননীয় অর্থসচিব পুলিশের খাতে ব্যয় বরাদ্দ করেছেন ৩ কোটি ৭৭ হাজার টাকা। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তা করতে বদ্ধপরিকর। পূর্ব পকিস্তানর উপর যারা শত্রæতা করে একে ধ্বংস করতে চেষ্টা করবে পূর্ব পাকিস্তানের আবাল বৃদ্ধ বনিতা কৃষক মজুর সকলে সংঘবদ্ধ হয়ে লড়বে এবং পাকিস্তানকে রক্ষা করবে। পুলিশের ব্যয় বৃদ্ধি করে স্বাধীন পাকিস্তানকে রক্ষা করা অত্যন্ত লজ্জাকর বিষয়। দেশের শিল্প কৃষি নৈতিক চরিত্র ও সর্বপ্রকার উন্নতি নির্ভর করে সে শিক্ষায় সেই শিক্ষাখাতে যথেষ্ট টাকা বরাদ্দ করবেন এবং এই বাজেট রহিত করে নতুন আকারে আনয়ন করবেন।” (মওলানা ভাসানী প্রদত্ত বাজেট বক্তৃতার অংশ বিশেষ ১৯৪৮)। মওলানা ভাসানী যেহেতু আপাদমস্তক গণমানুষের নেতা তাই যেখানেই গিয়েছেন সেখানেই জনস্বার্থের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।

(৮) মওলানা ভাসানীর আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা:

মুসলিমলীগের শাসকগণ ক্ষমতাসীন হয়েই পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুয়ের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ করতে থাকেন। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি এবং সামাজিক রীতিনীতির প্রতি পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠী প্রথম আঘাত হানে। তারা বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা হবে উর্দ্দু। যা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ মেনে নিতে পারেন নাই। ১৯৪৮ সালে প্রাদেশিক পরিষদে ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত তার প্রতিবাদে করেন। মওলানা ভাসানীর বুঝতে পারেন যে, ১৯৪০ সালে লাহোরে যে পাকিস্তানের জন্য শেরে বাংলার নেতৃত্বে তার প্রস্তাব করলেন। যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কোন অধিকার ও স্বাধীনতা থাকবে না। তখন মওলানা ভাসানী পূর্ব পাকিস্তানে একটি শক্তিশালী বিরোধী দলের অস্তিত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। সেই লক্ষ্যে তিনি মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশ নিয়ে কাজী বশির হুমায়ুন মিয়ার বাড়িতে রোজ গার্ডেন, ঢাকায় মওলানা রাগবী আহসান এম এলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৪৯ সালের ২৩ শে জুন মওলানা ভাসানী সভাপতি, সহ-সভাপতি আতাউর রহমান, আলী আহমদ খান, সাখাওয়াত খান, আব্দুস সালাম খান, সাধারণ সম্পাদক মোঃ শামছুল হক যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ও খন্দকার মোশতাক আহমেদ, কোষাধ্যক্ষ ইয়ার মোহাম্মাদ খান। আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হবার পর মুসলিম লীগ সরকারের প্রতি মওলানা ভাসানী অনাস্থা জ্ঞাপন করে বিবৃতি প্রদান করেন। এতে নবগঠিত আওয়ামী মুসলিমলীগ ও তার প্রধান মওলানা ভাসানীর প্রতি মুসলিম লীগ সরকার ক্ষেপে যান। ১৬ অক্টোবর মওলানা ভাসানীকে পাকিস্তান সরকারের পুলিশ গ্রেফতার করে। যা ছিল একেবারেই বেআইনী। মওলানা ভাসানীর জনপ্রিয়তাকে সরকার ভয় পেয়ে সহ্য করতে পারতো না।(চলমান...)

এই বিভাগের আরও খবর