লালমনিরহাট বার্তা
মওলানা ভাসানীর ইউরোপ সফর -আলরুহী
বার্তা ডেস্ক | ১৯ এপ্রি, ২০২৩, ৫:০৭ AM
মওলানা ভাসানীর ইউরোপ সফর -আলরুহী

মওলানা ভাসানী ১৯৫৪ সালের ২৮ মে বিশ্বশান্তি সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে স্টক হোম গিয়েছিলেন। পুরো ৭ মাস ইউরোপের বিভিন্ন দেশ সফর করেন তিনি। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন রাজনীতিবিদ অধ্যাপক মুজাফফর আহমেদ, লেখক রাজনীতিবিদ খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস। মওলানা ভাসানীর ইউরোপ সফরের অনবদ্য বর্ণনা পাওয়া যায় তাঁর সফরসঙ্গী লেখক খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াসের “ভাসানী যখন ইউপোপে” গ্রস্থে। “ইউরোপের সংবাদ পত্রে তুমুল বিতর্ক মওলানা ভাসানীকে নিয়ে। কেউ বললেন, মিঃ মৌলানা একজন অনলবর্ষী বক্তা। তার বক্তৃতায় আগুনের হল্কা বের হয়। আর কেউ বললেন, পূর্বাকাশের তিনি এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। সংগ্রামী জনতার আশা আকাক্সক্ষার প্রতীক। পূজিপতিরা বললেন, মিঃ মৌলানা একজন কমুনিস্ট সাম্যবাদে বিশ্বাসী। আর বুদ্ধিজীবিরা বললেন, তিনি ইসলামী সাম্যবাদের নতুন প্রেরণা, এক নয়াবার্তা বাহক। লন্ডন থেকে স্টক হোম আর স্টক হোস থেকে রোম। সর্বত্র সাংবাদিক ছাত্র শ্রমিক মধ্যবিত্ত ঘিরে ধরলেন তাদের প্রাণপ্রিয় নেতা মিঃ মৌলানাকে। তাঁকে এক নজর দেখতে আর জানতে চান। চোখে মুখে জ্বলন্ত বিশ্বাস নিয়ে মওলানা ভাসানী ঘোষণা করলেন, এজিদ নমরুদের জালেম বংশধরদের বিরুদ্ধে সারা দুনিয়ায় মজলুমদের বেঁচে থাকার যে সংগ্রাম চলছে পাকিস্তানের সে সংগ্রামে শরীক আমরা। আমরা সকল দেশের সকল মানুষের বন্ধুত্বকামী। যুদ্ধ আর ধ্বংস আমাদের কাম্য নয়। আমরা চাই শান্তি আর সৃষ্টি। এই হচ্ছে আমার ইসলামের মূল শিক্ষা। এই হচ্ছে পাকিস্তানবাসীর জীবন দর্শনের প্রাণ কথা।” পাকিস্তানের কোন জননেতা এমন দৃঢ় আওয়াজ আর তোলেননি, দুনিয়ার মানুষ শোনেনি কখনো। তাই বিম্ময় বিস্ফোরিত চোখে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন তখনকার পৃথিবীর সেরা মনীষীরা মিঃ মৌলানাকে জানতে। এলেন এটলী, এলেন বিভান, এলেন হারবার্ট মরিসন, মরগান ফিলিন্স, আর সেই সঙ্গে এলেন নোবেল প্রাইজপ্রাপ্ত দার্শনিক লেখক লর্ড ব্রাটান্ড রাসেল। আরো এলেন তৎকালিন ইংল্যান্ডের দুই শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী নিউ স্টেটম্যান এন্ড নেশন পত্রিকার সম্পাদক কিংসনে মার্টিন। মিঃ মওলানার সাক্ষাতের জন্য এলেন চিলির কবি পাবলোনেরুদা, রাশিয়ার লেখক ইলিয়া ইরেনবুর্গ আর তুরস্কের দার্শনিক রাজনীতিক নাজিম হিকমত। তারা বললেন পাকিস্তানের মাটির মানুষের নেতাকে আগে দেখবার সৌভাগ্য হয়নি, প্রথম দেখলাম। ইউরোপের মানুষ যুক্তিবাদী ভাবপ্রবনতা সেখানকার সমাজ থেকে প্রায় নির্বাসিত। কাজেই লক্ষ্য করেছি সর্বত্র মওলানা ভাসানীকে জানবার এই যে, আকুল আগ্রহ তার পেছনে কোন উচ্ছ্বাস নেই। যে মানুষটি এক শক্তিশালী শাসক গোষ্ঠীকে আমুল উৎখাত করতে পারেন, রাষ্ট্র বিজ্ঞানের প্রাচ্য ও পাশ্চত্য থিওরী মিলিয়ে তাঁরা তাকে স্টাডি করতে চান। এরিস্টল থেকে হেগের কার্ল মার্কস থেকে হ্যারল্ড লাসকি পর্যন্ত সকল দার্শনিককে এনে জড়ো করেছেন, রাষ্ট্র বিজ্ঞানের শিক্ষক শিক্ষাথীরা। কিন্তু তারা নিরাশ হয়েছেন, তারা মওলানাকে কোন ফরমুলায় ফেলতে পারলেন না। বিভিন্ন মহলের গবেষণা, কথাবার্তা, আলাপ আলোচনা প্রচুর। ইতিহাসের পাতা উল্টিয়ে পাল্টিয়ে কেউ কেউ প্রচেষ্টার চালালেন মওলানা ভাসানীকে একজন জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে প্রমাণ করতে। চীনের ডাঃ সানিয়াত সেন, ভারতের ওহাবী আন্দোলনের নেতা সৈয়দ আহমদ বেরেলভী ও ভারতের জাতীয়তাবদী আন্দোলনের সুরোধা মহাত্মা গান্ধী, মিশরের সাদ জগলুল পাশা, তুরস্কের কামাল আতাতুর্কের সঙ্গে দাড় করালেন মওলানা ভাসানীকে। কিন্তু দেখলেন, তাদের সঙ্গে তার অনেক ব্যবধান। পার্থক্যটা মৌলিক। এবার আনলেন রাশিয়ার লেনিন, চীনের মাওসেতুং আর ভিয়েতনামের হোচিমিনকে। কিন্তু তবুও ব্যবধান। তাদের সঙ্গেও তার মিল নেই। পুরোপরি বিলাতের এক কমুনিস্ট নেতা মওলানাকে জিজ্ঞাসা করলেন আপনি তাহলে কি চান? সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতা , মওলানার উত্তর। তিনি একটু ব্যাখ্যা দিয়ে বলনে, “আল্লাহর দুনিয়ায় সকল মানুষের সমান অধিকার। আল্লাহর নিয়ামত পৃথিবীর ধনভান্ডার, জগতের ঐশ্বয্য আল্লাহর সৃষ্টির জন্যই উৎসর্গীকৃত। মানুষ রাজা হয়েছে মানুষ বিত্তশালী হয়েছে অপর মানুষকে প্রবঞ্চিত করে। মানুষে মানুষে এই কৃত্রিম অসাম্য তার জন্য দায়ী যে বিধান সমাজ ব্যবস্থা তার উৎপাটন আল্লাহরই নির্দেশ। তারপর মৈত্রী কি? মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত। আল্লাহর সের জীব। এর চেয়ে বড় সম্মান মানুয়ের আর হতে পারে না। কিন্তু সে সম্মানের অবমাননা মানুষ নিজেই করছে যুগে যুগে। হিটলার মুসোলিনী সে অপমানের জ্বলন্ত স্বাক্ষর। তারা শেষ হয়েছেন, কিন্তু তাদের প্রেতাত্মারা আজও দুনিয়ার বুকে বিভীষিকা সৃষ্টির অপচেষ্টায় বিভর। ঐশ্চর্যের ঝলকানি আর প্রতাপের দম্ভ ফ্যাসিস্ট শক্তি দুর্বল রাষ্ট্রগুলিকে তাকের বুটের সঙ্গে বেধে আবার সদর্পে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। মানুষ আর তার সভ্যতার বিরুদ্ধে সে এক চ্যালেঞ্জ। আগন্তক সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে মওলানা ভাসানী বলেন, আমার চিন্তা জীবনাদর্শের সঙ্গে আপনাদের মনে কুমিউনিস্টদের যদি মিলে যায় তবে দুঃখিত বা আনন্দিত হবার কিছু নেই। আপনারা যদি সাম্য মৈত্রি স্বাধীনতার শত্রদের সাথে হাত মেলান তবে আমার হাতে আপনাদের রেহাই নেই। কারো নেই। তবে আমার আদর্শের সহিত অন্য কারো আদর্শ যদি মিলে যায় এবং আমার সংগ্রামে কেউ যদি শরীক হতে চায় গভীর আনন্দে আমি তাকে আলিঙ্গন করে নেব। মওলানা ভাসানী আরো অনেক কথা সেদিন বলেছিলেন। সেদিন তাঁর বক্তব্যে ইউরোপের সাংবাদিক বুদ্ধিজজীবীগণ যে প্রাজ্ঞতা ও রাজনৈতিক প্রগাঢ় মহৎ ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য তআরা পেলেন তা তারা ভুলতে পারেননি। স্টক হোম বিশ্ব শান্তি সম্মেলনের সভাপতি মন্ডলির সদস্য ছিলেন মওলানা ভাসানী। কিন্তু পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে পূর্ব পাকিস্তানের যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙ্গে দেওয়ার প্রতিবাদে মওলানা ভাসানী লন্ডনে সাংবাদিক সম্মেলন করেন। যুক্তফ্রন্ট ভেঙ্গে দেওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানে অনেক ঘটনা ঘটে যায়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ১৩ সদস্যের নতুন মন্ত্রী সভা ও সরকার গঠিত হলে মওলানা ভাসানী ইউরোপ থেকে দেশে ফিরে আসেন। শহীদ সোহারাওয়ার্দী পাকিস্তান পন্থী ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সেবাদাসে পরিণত হলে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে তার বিরোধ চরম আকার ধারণ করে।(গ্রন্থ:-অনন্য মওলানা ভাসানী জীবন সংগ্রাম)

এই বিভাগের আরও খবর