কৃষক, মজুর,কামার, কুমার, জেলে, তাঁতি, মেথর তথা সর্বস্তরের নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষকে মওলানা ভাসানী যে অন্তর দিয়ে ভালোবাসতেন এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। মওলানা ভাসানীর সারাটি জীবন ছিল সংগ্রামে ভরা। যেখানেই অন্যায়-অবিচার দেখতেন সেখানেই তিনি ঝাঁপিয়ে পড়তেন। সারাজীব- তিনি দুঃস্থ ও অসহায় মানুষের পাশে থেকেছেন। বিলাস বিভবকে তুচ্ছ জ্ঞান ভাবতেন। জমিদার-মহাজন তথা ধনিক-বণিক শ্রেণি কর্তৃক প্রজারা, কৃষকেরা তথা গরির মানুষেরা কিভাবে নির্যাতিত হতো, তা তিনি অনুভব করতেন। তাই তো তিনি- ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে আসাম প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনে তাঁর স্বরচিত ‘আর কত কাল’? নামক কবিতাটি পাঠ করেছিলেন। কবিতাটি নিম্নে ছাপানো হলো:
আর কত কাল ?
রৌদ্রে পুুড়িয়া বৃষ্টিতে ভিজি’ কৃষকেরা চষে জমি
বুকের রক্ত ঘাম হয়ে ঝরে সারাটি অঙ্গ চুমি।
কাঠোর শ্রমের অর্জিত ধন প্রজার ফসল রাশি।
খাজনার দায়ে নি’ছে জমিদার জোঁকের মতন চুষি
জমিদারের খানা ইমারৎ উঠিয়াছে আজ গড়ি
প্রজার অস্থি মাংস ত্বকের সুদৃঢ় ভিত্তি পরি।
চাষার রক্তে পুষ্টি হয়েছে যতো সব জমিদার।
পল্লীতে তাই উঠিয়াছে আজ মরণের হাহাকার।
মহাজন আসে সঙ্গে লইয়া নিলামের পরওয়ানা।
উচ্ছেদ হলো ঋণদায়ে কতো আস্তানা।
ধনীর ফীটন মটর চলেছে গরিবের বুক পিষে
এতটুকু যদি প্রতিবাদ করে ধরিয়াছে টুটি ক’ষে ।
চালহীন ভাঙ্গা কুঁড়েঘর আর বুক ভাঙ্গা হাহাকার
এটুকু লয়েও বাঁচিবার আজ নাই তার অধিকার।
তাদেরই হুকুমে জুতা বহি’ চলে হতভাগ্যের দল
ছেঁড়া কাপড়ের টুকরা পরণে সম্বল আঁখিজল।
একদল শুধু খাটিয়া খাটিয়া অনাহারে দিবে প্রাণ
আরদল শুধু হুকুম করিবে, ভুঁড়ি মোটা গদিয়ান।
এই প্রভুদেরি পদতলে আনি যাহারা যোগায় ভাত
হাড়ভাঙ্গা শ্রম বিনিময় লাভে তাহারাই পদাঘাত।
ঘরে ঘরে আজ করে হাহাকার উৎপীড়িতের দল
খোদার আরশ কাঁপে থরথর,দুনিয়াটা টলমল।
মানুষের প্রতি মানুষের এই এত বড় অপমান
আর কত কাল? জাগো, সবে মিলে করো এর অবসান।
মানুষ তোমরা! শির উঁচু করো, সম্মুখে দেখ চাহি
দুয়ারে তোমার পয়গাম আসে সাম্যের গান গাহি।
সঙ্ঘবদ্ধ হও সবে আজ, বুকে আনো হিম্মৎ
বিজয় ধ্বনিতে ধসিয়া পড়ুক জালিমের ইমারৎ।
বিশেষ দ্রষ্টাব্যঃ আসাম প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনে ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে তৎকর্তৃক পঠিত ও ভাসানী গবেষক ড. লাইলি উদ্দিন কর্তৃক সংগৃহীত। সূত্রঃ ভাসানীর কথা, সম্পাদনাঃ আজাদ খান ভাসানী।