লালমনিরহাট বার্তা
ফারাক্কা লংমার্চ ও নয়া বাংলাদেশ
আজাদ খান ভাসানী | ১৫ মে, ২০২৩, ১১:২৩ AM
ফারাক্কা লংমার্চ ও নয়া বাংলাদেশ

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। অথচ নদী নিয়ে আমাদের সুদূরপ্রসারী কোন পরিকল্পনা নেই। যে নদী সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ হিসেবে আমাদের দু'কূল ঢেলে দিয়েছিল, সেই নদীই আবার গলার ফাঁস হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী প্রায় প্রত্যেকটি সরকার নদী ব্যবস্থাপনায় উদাসীনতা দেখিয়েছে। উপরন্তু আমাদের পররাষ্ট্রনীতি ভারতের কাছ থেকে অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করতেও ব্যর্থ হয়েছে। ভারত আন্তর্জাতিক রীতিনীতি, আইন কানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অভিন্ন নদীতে বাংলাদেশের অধিকার অগ্রাহ্য করে চলছে।

স্বাধীন বাংলাদেশে অভিন্ন নদীতে ভাটির দেশের অধিকার নিয়ে সোচ্চার হয়েছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তিনি ১৯৭৬ সালের ১৬ মে ফারাক্কা লংমার্চের ডাক দিয়ে প্রকৃতিবাদীদের পক্ষে বিশ্বজনমতের কাছে মানবতার এক অনন্য গীতিকাব্য রচনা করেছিলেন। তিনিই প্রথম ফারাক্কা মিছিলের মাধ্যমে আমাদের দেশকে মরুকরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন বাংলাদেশের জন্য ফারাক্কা বাঁধ হিরোশিমা-নাগাসাকির চেয়েও ভয়াবহ ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতি ডেকে আনবে। অনেকের কাছেই তখন তার এই দূরদর্শীতা বাড়াবাড়ি মনে হয়েছিল। কিন্তু আজ দেশের প্রতিটি দেশপ্রেমিক জনতাই এ ব্যাপারে শঙ্কিত। মওলানা ভাসানী যা বলেছিলেন পরিস্থিতি আজ তার চেয়েও ভয়াবহ।

যে ভাসানী স্বাধীনতার কথা বলতে গিয়ে ভারতের 'দালাল' গালি হজম করেছেন; দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে সেই ভাসানীই ‘জলদেবতা’ হয়ে ‘জলজল্লাদ’ এর বিরুদ্ধে ফারাক্কায় লংমার্চের ডাক দিলেন। তখন তিনি অসুস্থ। আহমেদ ছফার ভাষায়- ‘পেশাবের বেগ তিনি ধরে রাখতে পারছেন না, বেদনায় তার সমস্ত মুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের সর্বনাশ ঘটছে এটা তার চেয়ে কেউই আর এতো স্পষ্ট করে বোঝে নি। ফলে জীবনের শেষ সেকেন্ডগুলো তিনি হিসাব করে খরচ করছিলেন।’ ৯৬ বছর বয়সেও বাংলার প্রমিথিউস সকল বিভেদ, অনৈক্য ও জড়তা ভেঙ্গে সার্বভৌমত্ব রক্ষার আন্দোলনে শরিক হবার ডাক দিয়ে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণকে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো নিয়ে গিয়েছিলেন ফারাক্কার প্রান্তরে। স্পষ্টত তিনি এই মিছিলকে জতীয় জাগরণ ও জাতীয় ঐক্যের সংগ্রাম বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। ফারাক্কার রাজনৈতিক গুরুত্ব ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের রক্ষাকবচ বলে উল্লেখ করেছিলেন। ফারাক্কার প্রাণঘাতি ব্যারাজ ধ্বংস করে দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তের দুই পাশের মানুষ, পশুপাখি, জীব-অনুজীব-অর্থাৎ দৃশ্যগ্রাহ্য বা দৃশ্যের বাইরে থাকা সকল প্রাণের রক্ষা এবং তাদের হেফাজত নিশ্চিত করার জন্য এক অভূতপূর্ব মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। যা আজও ফারাক্কা লংমার্চ নামে খ্যাত।

ভাসানীর এই ডাক কেবল ফারাক্কার ন্যায্য হিস্যা আদায়ের ডাকই নয়; এই ডাক জুলুমের বিরুদ্ধে মজলুমের টিকে থাকার ডাক। মাথা নত না করার ডাক। অধিকার আদায়ে বিশ্বজনমতের ডাক। কিন্তু দুঃখের বিষয়, মওলানার মৃত্যুর পর সেই ঐক্য ধরে রাখা যায়নি। উজানের দেশ ভারতকে ভাটির দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে পানি ব্যবহার নিয়ে ন্যায্য চুক্তিতে বাধ্য করার জন্য যে জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা ছিল তা আজ অবধি গড়ে তোলা যায়নি।

আমরা জানি পাখি ও নদীর কোনো সীমান্ত নেই। তাই পানির দাবিকে যারা ভারত বিরোধিতা বা ভারত প্রীতির দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে নাকে তেল দিয়ে ঘুমানোর কথা ভাবছেন তাদেরও ঘুম একদিন হারাম হয়ে যেতে পারে মিঠা পানির অভাবে অথবা লবণাক্ত আর বানের পানির দাপটে। আমাদের এই সমস্যাকে কেবলমাত্র রাজনৈতিক সমস্যা বলেও পাশ কাটিয়ে যাবার পথ নেই। কারণ আমরা যাদেরকে আমাদের রাজনৈতিক প্রতিভু বানিয়ে তুষ্ট মনে দায়িত্বের শেষ ভাবছি, তাদের বেশীরভাগই পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশে বিকল্প আবাসন গড়ে তুলেছে। তাই এই সমস্যা নিরসনে এ দেশের কৃষক, শ্রমিক, খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষকেই ভাবতে হবে। ঐক্যবব্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আমরা যারা ভাবছি, এ দায়িত্ব আমাদের নয় তারাই এ দেশের সিংহভাগ মানুষ। দায়িত্বটা তাই আমাদেরকেই কাঁধে নিতে হবে। বিশেষ করে ভারতের অভ্যন্তরেই যখন ফারাক্কা বাঁধের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে কথা উঠেছে। প্রতিবাদ হচ্ছে। জনমত গঠন হচ্ছে।

মনে রাখতে হবে এ লড়াই কোনো দেশ বা জাতীর বিরুদ্ধে নয়। এই লড়াই মানুষ এবং প্রকৃতির বিরুদ্ধাচারণের বিরুদ্ধে প্রকৃতিবাদীদের লড়াই। ভারতের নিপীড়িত জনতা আমাদের পাশে থাকবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। দু’ভাবে আমরা এ ব্যাপারে সোচ্চার হতে পারি। ১) দেশের অভ্যন্তরে প্রবল জনমত গঠন করে, ২) কুটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী লোয়ার রাইপেরিয়ান দেশের সম্মতি না নিয়ে আন্তর্জাতিক নদীর প্রবাহ বন্ধ করা যায় না। পৃথিবীর কোন দেশই আন্তর্জাতিক আইন, কনভেনশন, চুক্তি এবং জনমত উপেক্ষা করে প্রতিবেশী দেশের উপর পানি আগ্রাসন চালাতে পারে না। এটা পরমাণু সন্ত্রাসের চেয়ে কম নয়।

২০১৪ সালের ১৭ আগস্ট ‘আন্তর্জাতিক নদীধারা সনদ’ কার্যকর হয়েছে। এই সনদের ৭.১ ধরায় বলা হয়েছে যে, উজানে কোন দেশ আন্তর্জাতিক নদীর পানি এমনভাবে ব্যবহার করতে পারবে না যাতে ভাটির দেশের কোনো ক্ষতি হয়। অববাহিকার এসব দেশের ক্ষতি ও ক্ষতিপূরণ, পানি ব্যবহার নিয়ে বিরোধ, আন্তর্জাতিক আদালত, পরিবেশ রক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে নির্দেষনা রয়েছে ওই সনদে। ধারা ৭.২ তে বলা হয়েছে যে, উজানের দেশের পানি ব্যবহারের ফলে ভাটির দেশের ক্ষতি হয় তাহলে তাকে (ভাটির দেশকে) ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তবে বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, কোন এক অজানা কারণে বাংলাদেশ আজও ওই সনদ অনুসমর্থন করেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সনদটি আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানিপ্রবাহ ব্যবহারে একটি মানদণ্ড। এতে অভিন্ন নদীর পানি ব্যবহারের সার্বিক নির্দেশনা রয়েছে। এছাড়া আর্বিট্রেশন বা আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার সুযোগও রয়েছে। সনদটি কার্যকর হওয়ায় ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সংযুক্ত নদীগুলো থেকে প্রবাহিত পানির ন্যায্য হিস্যা না পেলে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বিষয়টি উত্থাপন করতে পারবে বাংলাদেশ। এর মাধ্যমে নদীবিষয়ক অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার সুযোগও থাকবে।

খোদ ভারতের আদালতেই ফারাক্কা ব্যারেজের ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে ১৩ হাজার কোটি টাকার মামলা হয়েছে। ফারাক্কা ব্যারাজ ভাঙার দাবিতে বিহার রাজ্যেও তীব্র প্রতিবাদ হয়েছে। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী তিস্তার পানি চুক্তি না হওয়ার সমালোচনা করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের পরিবেশবাদীরা উচ্চকণ্ঠ হচ্ছেন। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশ আজ অকাল বন্যা আর নিদারুণ খরায় মাতম করছে। ভারত শুধু ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করেই ক্ষান্ত হয়নি উজানের প্রায় প্রতিটি নদীর প্রবাহ কোন না কোনোভাবে রুদ্ধ করে চলেছে। তিস্তা চুক্তি না করে মরার ওপর খারার ঘা হিসেবে নতুন করে পানি সরিয়ে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এতে করে ভবিষ্যত বাংলাদেশের জন্য আরও ভয়াবহ পরিবেশগত বিপর্যয়ের আশংকা রয়েছে।

প্রশ্ন হলো, স্বাধীনতা লাভের এতকাল পরেও কেন আমরা আমাদের পানির ন্যায্য হিস্যা নিয়ে জনমত গড়ে তুলতে পারলাম না? সেই কবে মওলানা ভাসানী পথ দেখালেন আমরা কেন সেই পথে অগ্রসর হতে পারলাম না। এক সরকার আসে অন্য সরকার যায়। কিন্তু ক্ষমতার স্বার্থে কেউ ঝেড়ে কাশে না। একদল প্রকাশ্যে অন্যদল পর্দার অন্তরালে ভারতের কৃপাদৃষ্টি প্রত্যাশায় থাকে। আমরা যেমনি নাচাও তেমনি নাচি; বর্ষায় ডুবি আর খরায় পুড়ি।

সবিশেষ ফারাক্কা আন্দোলনকে যারা কেবল একটি দিবস বলে চালিয়ে দিতে চান, তারা এখনও বুঝে উঠতে পারেননি এর অন্তর্নিহিত সক্ষমতা। তা না হলে আজও বাংলার আপামর জনসাধারণ ধারণ করতো না ফারাক্কার চেতনা। ত্রিশ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার মালিকরা আজ বুঝতে পারছেন স্বাধীনতা কেবল ভৌগলিক অখণ্ডতার আকাঙ্খা নয়। অধিকার নিয়ে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার নামই স্বাধীনতা। ‘ফারাক্কা সমস্যা’কে উপজীব্য করে সাবেক মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তা ডুয়ান ইভান্স তার সারা জাগানো উপন্যাস ‘নর্থ ফ্রম ক্যালকাটা’ লিখেছেন। পানি সমস্যাকে ঘিরেই এই উপন্যাসের কাহিনী। বস্তুত এই উপন্যাসের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতিতে ক্ষমতার ভারসাম্যের লড়াই; পানি ও প্রাণসম্পদের ওপর কৌশলগত ও নিরাপত্তাজনিত নিয়ন্ত্রণ কায়েমের রাজনৈতিক ভাষ্য প্রতিভাত হয়েছে। পৃথিবীর মানচিত্রে আমরা এমন একটা জাতি যারা কোনদিন কারও শান্তি বিনষ্ট করিনি। কারও ভূখণ্ডে শোষণ জুলুম আধিপত্য লাভের চেষ্টা করিনি। তাই অন্য কোনো রাষ্ট্র সে যত শক্তিশালীই হোক না কেন আমাদেরকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না। সময়ের প্রয়োজনে ফারাক্কা আন্দোলনের চেতনার ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েই আমাদের ঐক্য নতুন করে প্রতিষ্ঠিত হবে। নদী ও পানি নিয়ে আমাদের আজকের যে সংকট; নয়া বাংলাদেশ বিনির্মাণে তা সম্ভাবনা হিসেবে আবির্ভূত হবে। আর সে দিন বেশি দূরে নয় যেদিন একটি হাত বল্লমের মতো ঝলসে উঠে বলবে, 'খামোশ'। জেগে উঠবে হক ইনসাফের নয়া বাংলাদেশ।

লেখক: আজাদ খান ভাসানী, সভাপতি, মওলানা ভাসানী কৃষক সমিতি, সদস্য সচিব, ভাসানী পরিষদ ও প্রকল্প সমন্বয়ক, ভাসানী গবেষণা প্রকল্প।

এই বিভাগের আরও খবর