লালমনিরহাট বার্তা
গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন যেমন ছিল
বার্তা অনলাইন ডেস্ক | ২৩ ডিসে, ২০২৩, ৮:৪২ AM
গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন যেমন ছিল

অসহযোগ আন্দোলন সফল করতে গণসংযোগ করছে বিএনপি

সব ধরনের ভ্যাট-ট্যাক্স, বিল প্রদান স্থগিত করতে আহ্বান জানিয়েছে দলটি

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি। একইসঙ্গে সরকারকে “সবক্ষেত্রে” অসহযোগিতা করার জন্য জনগণকে অনুরোধ করেছে দলটি।

বুধবার (২০ ডিসেম্বর) এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এ আহ্বান জানান দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।

ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী নির্বাচন বর্জন ও অসহযোগ আন্দোলন সফল করতে গণসংযোগ শুরু করেছে দলটি। সব ধরনের ভ্যাট-ট্যাক্স,ইউটিলিটি বিল প্রদান স্থগিত করতে দেশাবসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দলটি।

বিএনপির অসহযোগ আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণার পর থেকেই এ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের জানার আগ্রহ বেড়েছে। চলুন জেনে নেওয়া যাক অসহযোগ আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে-

অসহযোগ আন্দোলন বা সরকারকে অসহযোগিতা করার আন্দোলনের সূত্রপাত প্রায় শত বছর আগে। মহাত্মা গান্ধী নামে পরিচিত মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ব্রিটিশ শাসনামলে মুসলিমদের খেলাফত আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ঘোষণা করেছিলেন অসহযোগ আন্দোলনের। ১৯২০ সাল থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত চলেছিল সে আন্দোলন।

এমন আন্দোলনের পেছনে ছিল বেশ কিছু ঘটনাপ্রবাহ যা ভারতীয়দের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী ক্ষোভ বাড়িয়ে তুলেছিল।

প্রথম অসহযোগের প্রেক্ষাপট

অসহযোগ আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল ব্রিটিশদের প্রণয়ন করা রোলাট আইন থেকে যেটি ভারতীয়দের কাছে কালো আইন নামে পরিচিত। এমনিতেই নানা কারণে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের মধ্যে ক্ষোভ দানা বাঁধছিল। এর মাঝেই ১৯১৯ সালের ১০ই মার্চ পাস করা হয়েছিল রোলাট আইন।

রাষ্ট্রদ্রোহী কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত কোনো ব্যক্তিকে বিনা বিচারে কারারুদ্ধ বা বন্দি করার জন্য সরকারকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল সে আইনে।

অমৃতসরে রোলাট আইনের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের ডাক দেন ড. সাইফুদ্দিন কিচলু এবং ড. সত্যপল। এই দুজন নেতা যারা হিন্দু-মুসলিমদের ঐক্যের প্রতীক ছিলেন। এই দুই নেতাকে পাঞ্জাবের গভর্নর স্যার মাইকেল ও ডায়ারের নির্দেশে গ্রেপ্তার করা হয়।

দুই নেতার মুক্তির দাবিতে ১৯১৯ সালের ১০ই এপ্রিল ডেপুটি কমিশনারের বাড়ির দিকে মার্চ করে যায় বিক্ষুব্ধ প্রতিবাদীদের একটি অংশ। তাদের ওপর গুলি চালানো হয়, হতাহতের ঘটনাও ঘটে সেখানে।

তবে আরও বড় ঘটনাটা ঘটে এর কয়েকদিন পর। বৈশাখী উদযাপনের জন্য ১৩ই এপ্রিল একটি জমায়েত হওয়ার কথা ছিল। তবে ব্রিটিশরা সেটিকে রাজনৈতিক সমাবেশ হিসেবে দেখেছিল বলে ভারতের পুরনো নথিপত্রে উল্লেখ রয়েছে।

“বেআইনি জমায়েত” না করার বিষয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডায়ারের নির্দেশ থাকলেও জালিয়ানওয়ালাবাগে মানুষ এক হয়েছিল। সেখানে দুটি বিষয়ে আলোচনার উদ্দেশ্য ছিল, ১০ই এপ্রিলের গুলি চালানোর নিন্দা জানানো ও তাদের নেতাদের মুক্তির অনুরোধ। তবে বিষয়টি ভালোভাবে নেননি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডায়ার। সেনাসহ জালিয়ানওয়ালাবাগে হাজির হয়ে কোনো সতর্কবাণী ছাড়াই গুলি চালানোর নির্দেশ দেন তিনি।

জেনারেল ডায়ার ও ডেপুটি কমিশনারের দেয়া তথ্যে সেদিন আনুমানিক ২৯১ জনের মৃত্যুর কথা বলা হয়। তবে বিভিন্ন প্রতিবেদনে সে সংখ্যা পাঁচ শতাধিক পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়েছে।

এই গণহত্যার দুই দিন পর লাহোর, অমৃতসর, গুজরাতসহ পাঁচটি অঞ্চলে সামরিক আইন জারি করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল কেউ বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে অংশ নিলেই যেন ভাইসরয় তাকে সরাসরি কোর্টমার্শালে বিচার করতে পারেন।

এমন হতাহতের ঘটনা ভারতে ছড়িয়ে পড়লে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার নাইটহুড উপাধি বর্জন করেন।

মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন এর পরের বছর শুরু হলেও সেটির মূল প্রেক্ষাপট ছিল এই ঘটনাবলী।

খিলাফত আন্দোলনের সঙ্গে সম্মিলিত অসহযোগ

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের পরাজয় এবং ভাঙনের প্রেক্ষাপটে ইসলামের পবিত্র স্থানসমূহের ওপর খলিফার অভিভাবকত্ব নিয়ে ভারতে আশঙ্কা দেখা দেয়। গ্রেট ব্রিটেন ও ইউরোপীয় শক্তির হাত থেকে তুর্কি খিলাফত ও সাম্রাজ্যকে রক্ষার জন্য ১৯১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শুরু হয় খেলাফত আন্দোলনের।

নিজ অঞ্চলে তুরস্কের সুলতান কর্তৃত্ব হারান এবং মুসলিমদের জন্য এটি চিন্তার বিষয় ছিল কারণ মুসলিমরা তাকে খলিফা বা নেতার দৃষ্টিতে দেখতেন।

ব্রিটিশ এবং তাদের মিত্র দেশগুলো যেন তাদের সিদ্ধান্ত বাতিল করে সুলতানের কর্তৃত্ব ফিরিয়ে দেয় সেই দাবিতে মুসলিম লীগ ও ভারতীয় ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টির শীর্ষ মুসলিম নেতারা একত্রিত হয়ে খিলাফত কমিটি গঠন করে।

১৯২০ সালের মাঝামাঝির দিকে মহাত্মা গান্ধীও সমর্থন জানিয়ে তাদের সঙ্গে যোগ দেন।

গান্ধীর মূল ইস্যু রোলাট আইন থেকে শুরু করে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড হলেও এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে তিনি তার অহিংস আন্দোলনে যেমন মুসলিমদের একটা বড় অংশের সমর্থন পেয়ে যান, আবার তার বদৌলতে মুসলিমরাও হিন্দুদের সমর্থন লাভ করেন।

খিলাফত আন্দোলনের প্রতি গান্ধীর সমর্থনের বিনিময়ে খিলাফত নেতৃবৃন্দ গান্ধীর অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। খিলাফতের ইস্যু ভারতের স্বরাজ ও স্বদেশি ইস্যু থেকে আলাদা হলেও ব্রিটিশদের বিপক্ষে হিন্দু-মুসলিম একত্র হওয়ার দিকটি আন্দোলনকে আরো শক্তিশালী করে তোলে।

১৯২০ সালের ১ ও ২ জুন খিলাফত কমিটি এক সম্মেলন আহবান করে যেখানে অসহযোগের প্রস্তাব গৃহীত হয়। অগাস্ট মাসের ১ তারিখ গান্ধীর নেতৃত্বে খিলাফত কমিটি হরতাল ঘোষণা করে। সেসময়ই আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলনের।

ওই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতায় কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনে আন্দোলনের কর্মসূচি আরও বিস্তৃত হয়।

বাংলাদেশের লেখক ও গবেষক মুনতাসীর মামুনের লেখা প্রবন্ধ সেই অসহযোগ আন্দোলনের ভিত্তির জায়গাগুলো ছিল এমন-

--সরকার প্রদত্ত সব উপাধি, সামাজিক পদ ও স্থানীয় সরকারের পদ থেকে পদত্যাগ

--সরকারি দরবার বা সরকারি সম্মান আয়োজন বর্জন

--সরকারি সাহায্য প্রাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বর্জন ও “জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান” স্থাপন

--আদালত বর্জন ও সালিশি আদালত প্রতিষ্ঠা

--ইরাকে সামরিক-বেসামরিক পদে চাকরি অস্বীকার

--বিধান পরিষদের নির্বাচন বর্জন, যারা বর্জন করবে না তাদের ভোট না দেওয়া

--বিদেশি দ্রব্য বর্জন বা বয়কট।

কংগ্রেসের অসহযোগের প্রস্তাব ১৯২১ সালের জানুয়ারি মাস থেকে সর্বভারতে বেশ কিছুটা সাফল্য অর্জন করতে শুরু করে। অসংখ্য শিক্ষার্থী স্কুল-কলেজ পরিত্যাগ করে দেশব্যাপী গড়ে ওঠা আট শতাধিক জাতীয় প্রতিষ্ঠানে যোগ দেয়। অসহযোগে সক্রিয় হয়ে ওঠে পাঞ্জাব, মুম্বাই, উত্তর প্রদেশ, বিহার, ওডিশা ও আসাম অঞ্চল। তবে সবচেয়ে সফল হিসেবে দেখা হয় বিদেশি বস্ত্র বর্জনকে।

এসময়ের মধ্যে আর একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। ১৯২১ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রিন্স অব ওয়েলস এডওয়ার্ড ভারত সফর করেন। তিনি আশা করছিলেন তার সফর আনুগত্যের ভাব সৃষ্টিতে সহায়তা করবে এবং গান্ধীর আন্দোলন থিতু হবে। কিন্তু তাকে বোম্বেতে (বর্তমান মুম্বাই) স্বাগত জানানো হয় দেশব্যাপী হরতালের মধ্য দিয়ে।

যেখানেই তিনি যাচ্ছিলেন রাস্তাঘাট জনশূন্য আর দরজা-জানালা বন্ধ রেখে বিরূপ সংবর্ধনা জানানো হয়। অন্যদিকে আইন অমান্য করার বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারও আন্দোলনকারীদের গ্রেপ্তার করতে থাকে।

তবে অসহযোগ আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ৪ তারিখের একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে। ক্ষুব্ধ জনতার একটি দল বিহারের গোরখপুরে চৌরি-চৌরা পুলিশ স্টেশনে আগুন দেয়, যেখানে ২৩ জন পুলিশ সদস্য মারা যায়।

অহিংস আন্দোলনের নেতা গান্ধী এই সহিংসতার ঘটনা মেনে নিতে পারেননি। ১২ই ফেব্রুয়ারি অসহযোগের সমাপ্তি টানেন তিনি। এতে আন্দোলনকারীরা তার ওপর ক্ষুব্ধ হন। ওই বেছরের ১৬ই ফেব্রুয়ারি মহাত্মা গান্ধী তার একটি লেখায় উল্লেখ করেন, অসহযোগ প্রত্যাহার না করা হলে অন্যান্য জায়গায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ত।

এল. বি/ এস. এফ

এই বিভাগের আরও খবর