লালমনিরহাট বার্তা
তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে বাংলাদেশ -ড. বদিউল আলম মজুমদার
বার্তা ডেস্কঃ | ১০ সেপ, ২০২২, ৮:০২ AM
তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে বাংলাদেশ -ড. বদিউল আলম মজুমদার

বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন বুদ্ধিজীবী ড. আকবর আলি খান পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে শেষ পর্যন্ত চলে গেলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মুজিবনগর হয়ে আমলার জীবনের রাস্তায় হেঁটে তার শেষ ঠিকানা ছিল সেই শিক্ষালয়ই।

কয়েক সপ্তাহ আগে যখন ড. আকবর আলি খানের গুলশান-১-এর নতুন বাসায় সর্বশেষ দেখা হয়, আশা করেছিলাম, আলোকবর্তিকা হয়ে তিনি আরও বেশ কিছুদিন দ্যুতি ছড়াবেন সবার মাঝে। সেটা আর হলো না। তিনি চলেই গেলেন। যে কোনো মৃত্যুই অপূরণীয়, কিন্তু কিছু কিছু মৃত্যু গোটা জাতির জন্য এক অভাবনীয় শূন্যতা তৈরি করে দেয়। ড. আকবর আলি খান তেমনই একজন, যার মৃত্যু শুধু একজন ব্যক্তির মৃত্যুই নয়, একটি প্রতিষ্ঠানের বিদায়।

রাষ্ট্র বিনির্মাণে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সক্রিয় ছিলেন ড. আকবর আলি খান। অভিভাবকতুল্য এই মানুষটিকে আমরা সব সময় পাশে পেয়েছি সহযাত্রী হিসাবে। ইতিহাস থেকে শুরু করে অর্থনীতি হয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাসহ সুশাসন থেকে বনলতা সেন-সব দিকেই নজর ছিল এই প্রাজ্ঞ, সাহসী ও নীতিবান মানুষটির। কঠিন বিষয়কে অতি সহজে বলার কাজটিও নখদর্পণে ছিল তার।

`উন্নয়নশীল দেশের জনগণকে তাদের সরকারকে বলতে হবে : হুজুর আমরা আপনার কাছে উপকার চাই না, শুধু মেহেরবানি করে আপনার শুয়রের বাচ্চাদের সামলান’-এটি ড. আকবর আলি খানের ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ বইয়ের একটি লাইন মাত্র। ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ ছাড়াও তিনি আমাদের অর্থনীতি, ইতিহাস, জনপ্রশাসন, সাহিত্য ও পানিসম্পদ বিষয়ে অসামান্য কিছু গ্রন্থ উপহার দিয়েছেন, লিখেছেন অসংখ্য প্রবন্ধ-নিবন্ধ।

তিনি এই প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা ও লেখনী শক্তির মাধ্যমে আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের সচেতন করা থেকে শুরু করে চিন্তার খোরাক সৃষ্টিসহ তাদের বিবেক জাগ্রত করার চেষ্টায় আজীবন নিয়োজিত ছিলেন।

ড. আকবর আলি খানের সঙ্গে আমার শেষ কথা হয় গত সপ্তাহে, ৩৯ জন বুদ্ধিজীবীর ইভিএম নিয়ে প্রদত্ত বিবৃতি সম্পর্কে। তিনি বিবৃতিতে শুধু স্বাক্ষর করতে সম্মতই হননি, অন্য কয়েকজনের স্বাক্ষর নেওয়ার জন্যও আমাকে পরামর্শ দেন। এভাবেই তিনি দেশে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন।

ব্যক্তিগতভাবে তিনি আমার একজন একান্ত হিতাকাঙ্ক্ষী, অভিভাবক এবং সুজনের একজন একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। গত ১৮ জুন সুজনের অষ্টম জাতীয় সম্মেলনে তার অসুস্থ শরীর নিয়ে উপস্থিত হন। সে অনুষ্ঠানে এথেন্সের ইতিহাসবিদ এবং বিখ্যাত পেলোপোন্নেসিয়ান যুদ্ধের জেনারেল থুসাইদাইদসের একটি উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছিলেন-‘The secret to happiness is freedom, and the secret
to freedom is courage.’ অর্থাৎ সুখের উৎস হলো স্বাধীনতা ... আর স্বাধীনতার উৎস হলো সাহস।

ড. আকবর আলি খানের জীবনের দিকে তাকালে আমরা এ উক্তির পরিপূর্ণ প্রতিফলন দেখতে পাই। তিনি শুধু বীর মুক্তিযোদ্ধাই ছিলেন না, সব রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তিনি আজীবন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠ ছিলেন। এরই প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই হাসান মশহুদ চৌধুরী, সুলতানা কামাল ও শফি সামির সঙ্গে তার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসাবে পদত্যাগের মাধ্যমে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা। তার এই কাজ আমাদের সব সময় মনে করিয়ে দেবে কী করে প্রচলিত চিন্তাকে চ্যালেঞ্জ করতে হয়।

প্রসঙ্গত, এ মাসের শেষ সপ্তাহেই ‘বণিক বার্তা’র পক্ষ থেকে ড. আকবর আলি খানকে সম্মাননা প্রদানের কথা। এ উপলক্ষ্যে তার সুপারিশে বণিক বার্তা কয়েকজনকে তার সম্পর্কে লেখার অনুরোধ করে, যার মধ্যে আমিও একজন। এ বিষয়ে ড. আকবর আলি খানের সঙ্গে কয়েক সপ্তাহ আগে আমার কথা হয়। তখন তিনি আমাকে তার বেডরুমে বসিয়ে বলেছিলেন, এ লেখাগুলো তার জন্য হবে Obtituary বা মৃত্যুবার্তা। অলৌকিকভাবেই যেন তিনি তার আশু মৃত্যুর অনুমান করছিলেন!

ড. আকবর আলি খানের প্রয়াণে বড় করে দুঃখ-বেদনা প্রকাশ করার চেয়ে তার সমগ্র জীবনের কাজ, মুক্তিযুদ্ধসহ সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার অবদান, দেশপ্রেমিক আমলা হিসাবে সফলতা এবং সর্বোপরি গণতন্ত্র থেকে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তার সোচ্চার ভূমিকাকে জাতি মনে রাখবে সবসময়। তাই ড. আকবর আলি খানের এই চলে যাওয়াকে আমরা ‘বিদায়’ বলব না। বরং তিনি ফিরে ফিরে জীবনানন্দের এই বাংলায় আসবেন আমাদের মাঝে নানাভাবে, নানা সময়ে, নানা সংকটে, নানা চেহারায়।

আমার মতে, তার প্রতি আমাদের সবার শ্রদ্ধা জানানোর প্রকৃত উপায় হবে আগল ভেঙ্গে অকুণ্ঠ চিত্তে সত্য প্রকাশ করা, যা আকবর আলি খান করে গেছেন তার লেখায়-কথায়-সক্রিয়তায়। ড. আকবর আলি খান, আপনার কাছে বাংলাদেশ কৃতজ্ঞ থাকবে নিশ্চয়।

এই বিভাগের আরও খবর