লালমনিরহাট বার্তা
তিস্তা নদীর অর্থনীতি ও জনজীবন
বার্তা ডেস্কঃ | ৩১ আগ, ২০২২, ১:০৪ PM
তিস্তা নদীর অর্থনীতি ও জনজীবন

তিস্তা নদী বাংলাদেশের প্রধান প্রধান নদ-নদীর তুলনায় দৈর্ঘ্যে কিছুটা কম হলেও গুরুত্ব অনেক। চীনের তিব্বত এলাকা ঘেষে ভারতের অঙ্গরাজ্য সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন নামে তিস্তা নদীর কয়েকটি ছোট-বড় উৎস্য রয়েছে। সিকিম ও দার্জিলিং জেলার প্রধান ও অন্যতম নদী হচ্ছে তিস্তা। এই নদীর মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৪শত ১৪ কি.মি. তার মধ্যে সিকিমে ১৭০ কি.মি, পশ্চিমবঙ্গে ১২৩ কি.মি, এবং বাংলাদেশে প্রায় ১২১ কি.মি। তিস্তা সিকিম রাজ্য, দার্জিলিং ও কোচবিহার জেলার প্রধান নদী এবং সেই জন্য এই নদীকে ঐসব এলাকার জীবন রেখা বলা হয়।

বর্তমানে তিস্তা নদীর গড় প্রশস্ত প্রায় ৫/৭ কি.মি. হলেও গজলডোবা ব্যারাজে এই নদীর প্রশস্ত প্রায় ৯৩০ মিটার এবং ডালিয়া ব্যারাজে এই নদীর প্রশস্ত দৈর্ঘ্য প্রায় ৬৩০ মিটার রাখা হয়েছে। উভয় ব্যারাজ দিয়ে নদীর পানি কৃত্রিম খালের মাধ্যমে সেচ কাজে পানি সরবরাহ করা হয়। ফলে, বর্ষা মৌসুমে পানির প্রবাহে বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং শীত মৌসুমে পানি আটকে থকে। শীত মৌসুমে অবশিষ্টাংশ পানি বাংলাদেশে তিস্তা নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়। কিন্তু বর্ষাকালে বহুগুন পরিমানে পানি প্রবাহিত হওয়ায় নদীর দু’পাশ ভেঙ্গে-চুড়ে জনজীবন তছনছ হয়ে যায়।

পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে শুধু তিস্তা নদীর প্রবাহ না থাকায় শুষ্ক মৌসুমে ১৭ লাখ ২৯ হাজার একর জমিচাষাবাদ হুমকির মুখে। যার ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫শ’ কোটি টাকা। উপরন্তু প্রায় ২ হাজার ১৬শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত তিস্তা ব্যারাজ ও সেচ প্রকল্প তেমন কোনো উপকারে আসছে না।

বাংলাদেশ মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে তিস্তা নদীর ৪০টি দেশিয় জাতের মাছের প্রজাতি বিপন্নপ্রায়। অন্যদিকে, প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে তিস্তা নদীর ভাঙ্গনের ফলে কয়েক হাজার পরিবার একবারে নি:স্ব হয়ে যায়।

তিস্তাসহ সকল নদ-নদী প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট এবং প্রকৃতিক প্রক্রিয়া প্রবাহিত হয়ে থাকে। এই ধরনের সকল নদ-নদীই মিষ্টিপানির ভান্ডার এবংমানব-সভ্যতার ধারক ও বাহক। তাই আবহমানকাল থেকে নদ-নদীর গতি-প্রকৃতির সাথে মানিয়ে ভিন্ন ভিন্ন সভ্যতা ও নগরী গড়ে উঠেছে। তাছাড়া, নদ-নদীর পানির স্বভাবিক প্রবাহের সাথে জীবন রেখার সব ক্ষেত্রেই সম্পর্ক আছে, যেমন; পরিবেশ, প্রতিবেশ, বন, আবহাওয়া, কৃষি, মৎস্য, গবাদি পশু-পাখি, জনস্বাস্থ্য, জলজপ্রানী, ভূগর্ভস্থপানি, খাদ্যাভ্যাস, সংস্কৃতি, সভ্যতা, শিক্ষা, দক্ষতা, ব্যবসা, বাণিজ্য, ভূমি ব্যবস্থাপনা, ইত্যাদি। সার্বিক ভাবে এই নদী দেশের অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিরাট ভূমিকা রেখে আসছে। অথচ নদীভাঙ্গা পরিবারের জন্য কোন ক্ষতিপূরনের আইনি ব্যবস্থা নাই।

তিস্তা নদীর সার্বিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রবাহমান দেশ ও পক্ষের সাথে কোন প্রকারের সমঝোতা না হওয়ার ফলে, চলমান ক্ষতি রোধ করা যাচ্ছে না। উপরন্তু পক্ষ সমূহের মধ্যে অনাস্থা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতিসংঘ কর্তৃক ১৯৯৭ সালের আন্তর্জাতিক পানি প্রবাহ বিষয়ে একটি দলিল প্রণীত হয়েছে। বিশে^র ৩৬টি দেশের স্বাক্ষরের মাধ্যমে ২০১৪ সালে তা আইনে পরিণত হয়। দুর্ভাগ্যের বিষয়, যেসব দেশে নদ-নদীর সংখ্যা বেশি অর্থাৎ চীন, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, বার্মা, বাংলাদেশ এই আইনে স্বাক্ষর করেনি। ফলে আইনে উল্লেখিত নীতি ও পক্ষিয়-দ্বিপক্ষীয় বা ত্রিপক্ষীয় আলোচনায় স্থান পাচ্ছে না। যতদ্রæত সম্ভব বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশসমূহ আন্তর্জাতিক পানি আইনে স্বাক্ষর করা দরকার এবং এর নীতির আলোকে নদীর সার্বিক ব্যবস্থাপনার জন্য বহুপক্ষীয় চুক্তি হওয়া দরকার। তাহলে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় অনেক সমস্যার ইতিবাচক সুরাহা হতে পারে।

অন্যদিকে,ব্রিটিশ জমিদারী আমলে ১৮২৫ সালের প্রণীত সিকস্তি-পয়োস্তি বিষয়ক ভূমি আইনের ধারাবহিকতায় বর্তমান ভূমি আইনের ৮৬ ধারায় ক্ষতিপূরণ ছাড়াই সিকস্তি জমি খাস করার বিধান রাখা হয়েছে। যা বর্তমান সময় উপযুগি নয়। আবার সিকস্তি জমি পরবর্তি ৩০ বছরের মধ্যে স্বস্থানে প্রাকৃতিকভাবে জেগে উঠলে পূর্বের মালিকগণ কালেক্টরের মাধ্যমে জমি ফেরত পাবেন। কিন্তু সিকস্তি জমি পয়োস্তি হওয়ার পর তা পুর্বের মালিকগণকে ডেকে ফেরত দেয়া হয়েছে এমন ঘটনা জানা নাই। উপরন্তু পয়োস্তি জমি জরব দখল ও জাল দলিল হয়েছে এমন ঘটনা অহরহ।

নদীভাঙ্গার কারণে এমনিতে অনেক পরিবার তাৎক্ষনিকভাবে মাথাগোঁজায় ঠাঁই যোগাড়ে হিমসিম খায়। তারা ব্যবহার্য্য কিছু সম্পদ সাথে নিয়েঅন্যত্র চলে যায়। এই অবস্থায় জমির কাগজপত্র পরবর্তি ৩০ বছর কোথায় কিভাবে সংরক্ষন করবে? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, ৩০ বছরে মানুষের জীবনের অনেক কিছু বদলে যায়, জমির মালিকানার কাগজ তাবিজ বানিয়ে গলায় ঝুলিয়ে রাখলে কি তাদের জীবনের ৩০ বছরের ভোগন্তি থেকে মুক্তি পাবে? তাছাড়া, সে জমি ৩০ বছরের মধ্যে ফিরে পাবে তার নিশ্চয়তা কি?

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের গবেষণা প্রতিষ্ঠান “সিইজিআইএস”র প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিবছর নদী ভাঙ্গনে কমপক্ষে ১০ হাজার একর জমি সিকস্তি হয়। প্রতি বছর প্রায় ৩৮ হাজার পরিবার প্রত্যক্ষভাবে নদী ভাঙনের শিকার হয়। এর ফলে কৃষিজমি, বাড়ি-ঘর, বিভিন্ন প্রকারের সম্পদ নষ্ট হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে প্রাণহানী পর্যন্ত ঘটে। গরীব, ধনী নির্বিশেষে সবাই এ নদী ভাঙনের শিকার হয়। বিপন্ন জনগোষ্ঠীর কৃষি আয় কমে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত লোকেরা সম্পদ হারিয়ে জমানো সঞ্চয়ের ওপর হাত বাড়ায় এবং প্রায়শই নতুন ঋণে জড়িয়ে পড়ে। এভাবে লক্ষাধিক গৃহহীন পরিবার উন্মুক্ত আকাশের নিচে, পথের পাশে, বাঁধ, ফুটপাথ ও সরকারের খাস জমিতে এসে আশ্রয় নেয়।অনেক পরিবার তাদের স্ত্রী, বাবা, মা ও সন্তানদের নিয়ে অজানার উদ্যেশে পাড়ি জমায়। এ সকল পরিবার দেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ বিভিন্ন শহরের বস্তিতে ও ফুটপাতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। তারা কুলি,মুঠেমজুর,নির্মান শ্রমিক, পাহারাদাড়, রিকশা ভ্যান চালকসহ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হতে বাধ্য হয়। অথচ এই পরিবার গুলো কৃষি জমি চাষাবাদ করে সমৃদ্ধ জীবনযাপন করতো। নদী ভাঙ্গনের ফলে এই সকল পরিবারের স্ত্রীদেরকে কাজের বুয়া, কামালী ও শিশুদেরকে শিশু চাকরানী হিসাবে নিয়োজিত থেকে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। এদের জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠে। নির্যাতন নিপিড়ন এমন কি যৌন হয়রানীরও শিকার হয়। অনেকেই হত্যাকান্ডের শিকার হয়। তাদের পরিবার বিচার পায়না। আমরা জানি যে, নদীভাঙ্গন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, কখনো কখনো নদীপথে কৃত্রিম বাধা সৃষ্টি হওয়ায় কোথাও কোথাও অস্বাভাবিক ভাঙ্গনের উদ্রেগ হয়। অনেক ক্ষেত্রে নদী পাড়ের জনগোষ্ঠি এই অস্বাভাবিক ভাঙ্গনের শিকার হয়। ঘটনা যাহা হোক নদী ভাঙ্গনের ফলে মানুষ দারুনভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। অপরদিকে নদী ভাঙ্গনের ফলে সমুদ্বয় জমির মালিকানা সরকারের হয়ে যায়। যা এক ধরনের প্রাকৃতিক অধিগ্রহণ। অথচ এই অধিগ্রহনের কোন প্রতিদান না থাকায় ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের মধ্যে দীর্ঘ মেয়াদি চরম অমানবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব নদীভাঙ্গা পরিবারের ভবিষ্যৎ নিম্নমূখি হয়ে যায়। দেশের মহানগরী সমূহের মধ্যে অবস্থিত বস্তির মধ্যে এসব পরিবার আশ্রয় ও কাজের সন্ধানে দেশের ভিন্ন এলাকা থেকে চলে আসে। এসব বস্তিতে আশ্রয় নেয়া পরিবার আরো অনিশ্চয়তার মধ্যে পতিত হয় যেমন; বস্তিতে অগ্নিকান্ড, বিভিন্ন ধরনের দূর্ঘটনা, অভাবের কারণে মাদকদ্রব্য ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে যেতে বাধ্য হয়। যা তাদের পরিবারের সকল সদস্যের জন্য দুর্ভাগ্যজনক আবার, পুরো দেশের জন-নিরাপত্তা ও জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি সৃষ্টি করে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, নদ-নদী একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সম্পদ। জাতীয় সম্পদ রক্ষায় সকলের সম্মিলিত প্রয়াসের সাথে সাথে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবার সমূহের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটা অনস্বীকার্য্য যে, নদীপাড়ের কৃষক, জেলে ও খেটে খাওয়া পরিবারসমূহ বরাবরই জতীয় অর্থনীতিতে ও খাদ্যে সয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে। তাদের অবদান অব্যবাহত রাখতে তাদের বেঁচে থাকার সুরক্ষা দেয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু নদীপাড়ের জনজীবনের সুরক্ষার জন্য গৃহীত সকল প্রচেষ্টা ও বাজেটের বরাদ্দ ভেস্তে যাচ্ছে। দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতার আলোকে অবশ্যিকভাবে চলমান কার্যক্রম ধারার পরিবর্তন এবং জাতীয় সম্পদের ন্যায় ভিত্তিক ব্যাবহার নিশ্চিত কল্পে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের অধিকার নিশ্চিৎ করা দরকার।

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৩ ধারা অনুযায়ী দেশ ও দেশের সকল সম্পদের মালিক হচ্ছে, জনগণ। অতএব, দেশের কোন জনগণ ভূমিহীন থাকা অথবা সম্পদহীন হওয়া দেশের সংবিধানের পরিপন্থি। অন্যদিকে, রাষ্ট্রের জন্য কোন জমি অধিগ্রহণ করা প্রয়োজন হলে বাংলাদেশর ভূমি আইনের অধিগ্রহণ সংক্রান্ত ২০১৭ সালে সংশোধিত বিধি-বিধান অনুসারে স্থাবর-অস্থাবর সকল সম্পত্তির ক্ষতিপূরণসহ স্থানান্তর বাবদ ব্যায় প্রদান করা হয়। অথচ নদীর জন্য প্রকৃতিক নিয়মে জমি অধিগ্রহণ করে খাস করা হলেও তার বিপরিতে কোন ক্ষতিপূরনের বিধান নাই। যা জমি অধিগ্রহনের ক্ষেত্রে দ্বিমূখি নীতির প্রচলন। তাছাড়া, যে কোন প্রকারের দুর্ঘটনা ও সম্পদের সম্ভাব্য ক্ষতির ক্ষেত্রে বীমার প্রচলন থাকলেও প্রকৃতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য বীমার কোন প্রচলন নাই। ফলে, নদী ভাঙ্গনের কারণে প্রতিবছর হতদরিদ্র পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

অতএব, নদীর স্বাভাবিক প্রাবাহ অক্ষুন্ন রাখতে নদীর প্রবাহের উৎস্য থেকে শেষ পর্যন্ত সকল প্রকারের বাধা অপসারণসহ বাংলাদেশের সংবিধানের আলোকে, জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে একই নীতির অনুসরন করতে, দেশের জনগণকে হতদরিদ্র হওয়া থেকে বাঁচাতে, ভবিষ্যত প্রজন্মের ভবিষ্যত নষ্ট হওয়া রোধ করতে, দেশের হতদরিদ্র পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করতে, নদীপাড়ের কৃষক, জেলে ও খেটে খাওয়া মানুষের দীর্ঘ দিনের অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ ২০১৭ সালের বিধি-বিধান অনুসরনে নদীভাঙ্গা সকল পরিবারকে ক্ষতিপূরন প্রদান করার বিধান তৈরী করা রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব।

লেখকঃ গেরিলা লিডার ড. এস এম শফিকুল ইসলাম কানু। সভাপতি, তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদ, লালমনিরহাট ও শমশের আলী, সদস্য সচিব, নদী অধিকার মঞ্চ।

এই বিভাগের আরও খবর