লালমনিরহাট বার্তা
বাংলাদেশের ভোট পদ্ধতিতে কিছু সংস্কারের প্রস্তাব
মোঃ ইয়ার আলী | ৩০ সেপ, ২০২৩, ৪:৩০ AM
বাংলাদেশের ভোট পদ্ধতিতে কিছু সংস্কারের প্রস্তাব

বাংলাদেশে নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে বিতর্ক যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাতে হাটি হাটি পা পা করে গড়ে উঠা দেশের উন্নয়ন আবার হঠাৎ করে ধ্বংস হওয়ার পথে এসে দাঁড়িয়েছে। সমস্যার মূল কারণ হলো নির্বাচন ব্যবস্থার অশুদ্ধতা বা অসচ্ছতা ।বিদ্যমান নির্বাচন ব্যবস্থায় যে সমস্যাগুলো রয়েছে, সে সমস্যাগুলোর মূলের কারণ সমূহ কেউ পর্যালোচনা করতেছে না । শুধু নির্বাচন পরিচালনা কারীর যোগ্যতা ,অভিজ্ঞতা ও স্বচ্ছতা নিয়েই প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। পদ্ধতি নিয়ে কেউ আলোচনা করতেছে বলে মনে হচ্ছে না ।

বাংলাদেশের জন্মকাল থেকেই ক্ষমতাসীন সরকারগন নিজেরাই ভোটে জয়লাভ করার জন্য সমস্ত প্রকার পলিসি ও ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে বলে দেখা যাচ্ছে । তাদের সমস্ত পলিসির মূলে একটাই উদ্দেশ্য থাকে যে কিভাবে তারা নিজেদেরকে জিতিয়ে আনবে।তাদের জেতার এই মানসিকতা থেকেই সমাজে এক ধরনের সুবিধাভোগী লোক জন্ম নেয় ।যারা সরকারের এই দৃষ্টিভঙ্গিটাকে/উদ্দেশকে শতপ্রণোদিত হয়ে বাস্তবায়নের জন্য সহযোগিতা করে থাকে। তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই নির্বাচন ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আসবে বলে মনে করা যায়। সুবিধাভোগীরা তাদের অন্যায় কাজের বিনিময়ে কিছু অর্থ ,কিছু স্বার্থ ,ভবিষ্যতে কিছু ক্ষমতা পাওয়ার লোভ লালসাকে কাজে লাগায় বা ভবিষৎ সুবিধা গ্রহণ করার আশা করে থাকে ।এই সুবিধা যারা তাদেরকে প্রদান করে ,তারা কিন্তু দলের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করে না বরং কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তটাকে অমান্য করে ।কিন্তু কেন্দ্র যখন দেখে যে, কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অমান্যকারী ভোটে জয়লাভ করেছে ,তখন তারা এই অমান্যটাকে চেপে যায় বা ভুলে যায় এবং এর কোন বিচার করে না । এখান থেকেই সমাজের সুবিধাভোগীরা মনে করে নিয়েছে যে , যেনতেনভাবে নির্বাচনে জিততে পারলেই বৃহত্তর স্বার্থে তাদের অপরাধ ক্ষমা করে দেওয়া হবে । অপরপক্ষে জয়ী প্রার্থী যাদের কারণে নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন তাদেরকে পুরস্কৃত করেন ।এই পুরস্কার তাদের কাছে অর্থের বিনিময়ে হতে পারে , কাজের বিনিময়ে হতে পারে, চাকরির বিনিময়ে হতে পারে অথবা ক্ষমতা প্রদানের মাধ্যমে হতে পারে । বাংলাদেশে সুবিধা ভোগীরাই আইন অমান্যকারী হয় ।তাদেরকে ঠিক করতে পারলেই এদেশে নির্বাচন ব্যবস্থা সঠিক পদ্ধতিতে হতো এবং নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে এত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো না । তাই নির্বাচন ব্যবস্থা পরিশুদ্ধ করার জন্য আমি কয়েকটি সমস্যাকে প্রত্যক্ষভাবে চিহ্নিত করেছি ।আশা করি এই সমস্যাগুলি সকলেই বিবেচনা করবেন এবং এর থেকে সমাধানের পথ খুঁজে পাবেন। এতে বাংলাদেশের জন্য একটি দীর্ঘস্থায়ী স্বচ্ছ নির্বাচন ব্যবস্থা চালু হবে এবং দেশটা বিপদের হাত থেকে রক্ষা পাবে ।

(১) প্রথম সমস্যা হল ভোটের দিন ভোটার স্লিপ প্রদান নিয়েঃ সাধারণত ভোটের দিন প্রত্যেকটা পার্টির পক্ষ থেকে আলাদা আলাদা ভাবে ভোটার স্লিপ প্রদান করে থাকে। এতে প্রথমেই ভোটারকে পক্ষের লোক হিসাবে চিহ্নিত করা হয় ।যদি ভোটার স্লিপ দেওয়ার পদ্ধতি বন্ধ করে দেওয়া হয় ,তাহলে ভোট কেন্দ্র যাওয়ার পূর্বেই ভোটারকে কোন পক্ষের লোক হিসেবে কেউ আইডেন্টিফাইড বা চিহ্নিত করতে পারবে না ।ফলে ভোটের এলাকায় একটি নিরপেক্ষ পরিবেশ বজায় থাকবে । এই কাজটি নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে নিয়োগকৃত লোকজনই করবে ।

(২) উন্মুক্ত স্থানে ভোটের বাক্স স্থাপন করাঃ এতে একজন ভোটার সকলের সামনেই উন্মুক্ত স্থানে ভোটের বাক্সে তার স্লিপ/ ব্যালট বাকসে প্রদান করে ফিরে আসতে পারবে ।যা দূর থেকে দেখা যাবে ।এতে ভোটারকে কেউ প্রভাবিত করতেছে কিনা সে বিষয়ে ধারনা পাওয়া যাবে ।যখন বুথের ভিতর ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা থাকে তখন কাউকে কাউকে প্রভাবিত করার ব্যাপারে দেখা যায় বা সন্দেহ সংশয় সৃষ্টি হয় যে ,কেউ মনে হয় বুতে প্রভাব বিস্তার করতেছে ।

(৩) ভোট প্রদান পদ্ধতিঃ ভোটাররা যখন ভোটকেন্দ্রে যাবে তখন তারা তাদের নাম যাচাই করে আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে ভোটের বাক্সে বা মেশিনে টিপ দিয়ে যদি ভোটের স্লিপ বের করতে পারেন ।তাহলে তিনি ভোটের স্লিপে সিল মেরে উন্মুক্ত অবস্থায় ভোটের বাক্সে ঢুকায় দিয়ে বের হয়ে আসতে পারবেন ।এতে আর কখনো জাল ভোটের সুযোগ সৃষ্টি হবে না । সাধারণত পাসপোর্ট অফিসে ব্যবহৃত হাতের টিকসই দেওয়া মেশিন অথবা এটিএম বুথের মতো মেশিন ভোট কেন্দ্রে ব্যালট বের করার জন্য যথেষ্ট । পূর্বের প্রিন করা কোন ব্যালট পেপার ভোটকেন্দ্রে থাকবে না শুধুমাত্র এটিএম বুথ মেশিন থেকেই ব্যালট পেপার বের হতে হবে।এর জন্য অন্য কিছু ব্যবস্থা করার দরকার নেই। এক্ষেত্রে সবাইকে আইডি নাম্বার মুখস্ত রাখতে হবে অথবা আইডি কার্ড সাথে নিয়ে যেতে হবে ।আইডি কার্ডের নাম্বার বসায়ে ভোটের বাক্স থেকে তার নামের অংশ বের করবে এবং আঙ্গুলে ছাপ প্রদান করে ব্যালট পেপার বের করবে।

(৪) পুলিং এজেন্ট সিস্টেম বা পদ্ধতি বাতিল প্রসঙ্গেঃ বর্তমানে পুলিং এজেন্ট পদ্ধতি ভোটকেন্দ্রের ভেতরে একটা আতঙ্ক বা সন্ত্রাসের নাম ।সাধারণত পোলিং এজেন্ট নিয়েই ভোটকেন্দ্রে যত অভিযোগ সৃষ্টি হয় অন্য কোন বিষয় নিয়ে এত অভিযোগ সৃষ্টি হয় না ।কারণ ক্ষমতাসীনরা বা ক্ষমতাধরদের ভোট সেন্টার নিয়ন্ত্রণ মানেই হলো বিপরীত পক্ষের পুলিং এজেন্টকে বের করে দেওয়া । আর দুর্বল ক্যান্ডিডেটরা এজেন্ট রাখায় ব্যার্থ হয়ে তাদের এজেন্ট বের করে দেওয়া দিয়েছে মর্মে অভিযোগ দায়ের করা । বেশিরভাগ সময় পুলিং এজেন্টরা বিপরীত পক্ষের এজেন্টদেরকে বের করে দিয়ে নিজেরাই সীল মারে বা সিল মারার ব্যবস্থা করে অথবা পুলিং অফিসারদের নিকট থেকে ব্যালট পেপারস ছিনতাই করে থাকে। যেটা বাইরে থেকে দেখা যায়না । তাই সকল পক্ষ থেকেই পুলিং এজেন্ট পদ্ধতি বাতিল হওয়া উচিত। এতে ভোট সেন্টারের ভিতরে পুলিং এজেন্ট নামে কোন প্রকার সন্ত্রাসী ,মস্তান বা বাহিরে লোকের আগমন ঘটবে না ফলে ভোটাররা নির্ভীগ্নে তাদের ভোট প্রদান করতে পারবে ।

(৫) ভোট গণনা পদ্ধতিঃ আমাদের দেশে সাধারণত ভোট শেষে সন্ধ্যাবেলা বা রাতের বেলা নির্ধারিত কামরায় প্রিজাইডিং অফিসারের উপস্থিতিতে ভোট গণনা শুরু হয় ।কিন্তু এই ভোট গণনার পদ্ধতি নিয়েই

যত অবিশ্বাস,সন্দেহ, সংশয় জন্ম নেয় । তাই এই ভোট গণনার পদ্ধতি সংশোধন হওয়া দরকার । নির্ধারিত কামরার বাইরে খোলা জায়গায় চতুর্দিকে পুলিশের বা নিরাপত্তা রক্ষির প্রহরায় ভোট গণনা পদ্ধতি চালু করা উচিত ।এতে দূর থেকে সবাই পর্যবেক্ষণ করতে পারবে আর ক্যামেরার/মেবাইলের মধ্যে ভিডিও করতে পারবে ।ফলে যেকোনো আপত্তি দেখা দিলে ভিডিওকে আবার রিভিউ করতে পারবে ।

(৬) ভোটের ফলাফল ঘোষনাঃ সাধারণত যে সমস্ত জায়গায় সন্ত্রাসীরা ভোটকেন্দ্র দখল করে ,সেই সমস্ত জায়গায় ভোটকেন্দ্রে ভোটের ফলাফল প্রকাশ করতে দেয় না। আর এই ফলাফল উপজেলা কেন্দ্র পর্যন্ত পৌঁছিতে পৌঁছিতে উল্টে যায়। তাই সকল অবস্থায় ভোটকেন্দ্রেই ফলাফল প্রদান করতে হবে এবং লিখিত আকারে প্রকাশ করতে হবে। ভোটের ফলাফল প্রিজাইডিং অফিসার সকলের সামনেই স্বাক্ষর প্রদান করে অনলাইনে প্রেরন করবেন এবং প্রার্থী পক্ষের সকল লোকের হাতেই এই কপি পৌঁছে দিয়েই তিনি অফিসিয়াল দায়িত্ব শেষ করবেন ।

(৭) ভোটের ফলাফল প্রকাশের সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়াঃ ভোটের ফলাফল বিলম্বে প্রকাশ নিষিদ্ধ করতে হবে । সবাইকে একটা নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই ফলাফল প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে । সাধারণত প্রার্থীর পক্ষে প্রার্থীর নিজস্ব /নিকটতম ভোট কেন্দ্রের ভোটের ফলাফল পরে প্রকাশ করা হয় ।কারণটা হলো প্রার্থী যদি অন্য জায়গায় ফেল করে তাহলে নিজস্ব এলাকার ভোট সেন্টারের ভোটের ফলাফল জোর করে হোক ,গন্ডগোল করেই হোক অথবা ঘুষ দিয়ে হোক ফল পরিবর্তন করার চেষ্টা করে থাকে ।এই পরিবর্তনের মাধ্যমেই সে জয়লাভ করার জন্য চেষ্টা করে। তাই সকলকেই একই সঙ্গে একই সময়ের মধ্যেই ভোটের ফলাফল প্রকাশ করতে হবে ।

(৮) ভোটের ফলাফল প্রকাশে উদ্ধতন কর্তৃপক্ষের চাপ কমানোঃ কেন্দ্রীয়ভাবে ভোটের গণনা করা হলে ভোটের ফলাফল পরিবর্তনের জন্য উদ্বতন কর্তৃপক্ষ তার নিম্নস্ত কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করে থাকে । যেমন ডিসি সাহেবরা উপজেলা নির্বাহী অফিসার, এসপি সাহেব ওসি সাহেবকে এই চাপ দিয়ে থাকে ।তাই এই চাপ থেকে বাঁচার জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে ভোটের গণনা করা উচিত নয় । এতে প্রশাসনের উদ্বতন কর্তৃপক্ষ তখন তার নিম্নস্ত কর্তৃপক্ষকে ফোন করে ভোটের ফলাফল পাল্টে দেওয়ার জন্য প্রেসার সৃষ্টি করতে পারবে না ।যেহেতু নিম্নস্ত কর্মচারীগণ উর্ধতন কর্তৃপক্ষর অবৈধ আদেশ লংঘন করতে ভয় পায় । তাই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে কখনোই ভোট সেন্টারে প্রভাব বিস্তার করতে দেওয়া যাবেনা । যদি নিচেই ভোট গণনা শেষ হয় , ফলাফল প্রকাশ হয় তাহলে উদ্বোতন কর্তৃপক্ষ আর চাপ সৃষ্টি করতে পারে না ।

(৯) কেন্দ্রীয় এবং জেলা পর্যায়ে সার্ভার স্থাপনঃ এই পদ্ধতিতে যখনই কোন লোক ভোট প্রদান করবে তখনই তার ভোটের সংখ্যাটি/ ডাটা কেন্দ্রীয় সার্ভার এবং জেলা পর্যায়ে (প্রয়োজনে উপজেলা পর্যায়ে) সার্ভারে যোগ হবে ।ফলে ভোট গণনার ক্ষেত্রে কোন কারচুপি হলেও সেক্ষেত্রে সার্ভারের সঙ্গে

নির্বাচন কমিশন সহ নির্বাচনে জড়িত সকল কর্তৃপক্ষ হিসাব মিলায়ে নিতে পারবে।

(১০) নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালঃ বাংলাদেশে নির্বাচন ব্যবস্থায় যদি কেউ অনিয়ম দেখে এবং অনিয়মের বিচার চাওয়ার জন্য কোর্টে নালিশ দাখিল করে ,তাহলে এই বিচার প্রক্রিয়া সম্পাদন করতে পরবর্তী ভোট এসে যায় ।এতে প্রত্যেকটা লোক এই নির্বাচনের ট্রাইব্যুনালকে কোন ভয় করে না। এতে তার মধ্যে যেকোনোভাবেই হোক ভোটে জিতে আসার স্পৃহা বলবৎ থাকে এবং মামলা হলে ততদিনে তার নির্বাচনকালীন মেয়াদ শেষ হবে এই ভরসায় মামলা কে সে কোনই তোয়াক্কা করে না । এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কারো কোন বিষয়ে ট্রাইব্যুনালে মামলা হলে সেই সিট হ্যাঙ্গিং করে রাখা যেতে পারে অথবা বিচারের মেয়াদ ৯০ দিন করা যেতে পারে ।

(১১) প্রার্থীর নির্বাচন করার সময়সীমা নির্ধারণ করাঃ এই পদ্ধতি যদি সংযোজন করা যায় ,তাহলে যদি একজন প্রার্থী পরপর দুইবারের বেশি ভোটে দাঁড়াইতে না পারে তাহলে, তার মধ্যে স্থানীয়ভাবে প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব হবে না। অথবা ভোটে জয়লাভের জন্য কোন স্থায়ী মস্তান/ সুবিধাবাদী গ্রুপ তৈরি করা সুযোগ হবে না ।

যদি এই বিষয়গুলি বিবেচনা করত এবং নির্বাচন পলিসিতে অন্তর্ভুক্ত করত। তাহলে হয়তো দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব হতো ।

 প্রোপাইটার, আলি বাবা থিম পার্ক ও আলী ফ্রুটস এন্ড ভেজিটেবল কোল্ডস্টোরেজ, মোবাঃ ০১৭১৬৬৪২৩৪৩।  

এই বিভাগের আরও খবর