লালমনিরহাট বার্তা
করোনা-উত্তর বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্য
বার্তা ডেস্কঃ | ৯ অক্টো, ২০২১, ১০:৩৯ AM
করোনা-উত্তর বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্য
অদৃশ্য শত্রু, অণুজীব করোনার আক্রমণকে আমরা দুইভাবে প্রত্যক্ষ করেছি। একদিকে ‘থ্রেট’ হিসেবে দেখেছি, আরেক দিকে দেখেছি ‘লস’ হিসেবে। আবার কোনো কোনো মর্মান্তিক ঘটনাকে একই সঙ্গে ‘লস’ ও ‘থ্রেট’ হিসেবে প্রত্যক্ষ করেছি। সাধারণত যাপিত জীবনের ‘থ্রেটফুল ইভেন্ট’ চাপ তৈরি করে মনে; ভয়-উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বা অ্যাংজাইটি। একই সঙ্গে রোগপ্রতিরোধের ক্ষমতা কমিয়ে দেয়, সংকট মোকাবিলা করার সামর্থ্যও। মনোযোগের ঘাটতিসহ স্মরণশক্তি কমতে থাকে, সমস্যা সমাধানের ক্ষমতাও। ‘লস’-এর কারণে মনে হাহাকার জাগে, হতাশা সৃষ্টি হয়; চূড়ান্ত পর্যায়ে বিষাদ হানা দেয় মনে, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জীবন অনিশ্চিত ধোঁয়াশায় ঢেকে যায়। মূল কথা ‘থ্রেট’ ও ‘লস’-এর সম্মিলিত আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়েছে বিশ্ব জুড়ে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য।

করোনার বিধ্বংসী ছোবলে কীভাবে মানুষ সংক্রমিত হয়েছে, কীভাবে মারা গেছে, লাশ বহন করা হয়েছে কীভাবে, স্বজনবিহীন লাশ কবরে/শ্মশানে চলে যাচ্ছে কীভাবে, প্রায় স্বজনহীন জানাজা ছাড়া লাশ কবরে চলে গেছে কীভাবে, নিজেকে কীভাবে আড়াল করেছি আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে—এসব কথা মনে পড়বে। মনে পড়লে আমরা মানসিকভাবে আক্রান্ত হব। আমাদের মধ্যে বিষণ্নতা হানা দিতে পারে। এ ধরনের উদ্বেগজনক পরিস্থিতি দীর্ঘকাল চলার কারণে কিংবা চলতে থাকলে ক্রমান্বয়ে মানুষ বিষণ্নতার দিকে ঝুঁকিতে পড়বে, পড়ছে। পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজ-অর্ডারেও ছেয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যেতে পারে জীবনের আনন্দময় অধ্যায়। যথাসময়ে যথাযথ চিকিৎসা না পেলে দিনে দিনে পরিস্থিতি জটিল হতে থাকবে।
করোনাকালে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে বিশ্ব জুড়ে। বিধ্বংসী এ ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা দুষ্কর। বহু মানুষ চাকরি হারিয়েছেন, হারাচ্ছেন। বহু ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠান বসে গেছে, একদলের চাকরি চলে যাচ্ছে—বিশ্ব জুড়ে দলে দলে কর্মজীবী মানুষ বেকার হয়েছে। আর এসব উদাহরণই সৃষ্টি করেছে বিষণ্নতা।

করোনাকালে ঘরে ঘরে চলেছে পারিবারিক সহিংসতা। নারী নির্যাতন বেড়েছে, শিশু নির্যাতন বেড়েছে, যৌন নিপীড়ন বেড়েছে। মানুষের সহিংস আচরণ বেড়েছে। এই আচরণ ভোগ করতে করতে মেয়েদের অধিকাংশই বিষণ্নতা রোগে আক্রান্ত হয়েছে, পুরুষরাও এ আক্রমণ থেকে রেহাই পায়নি। বিষণ্নতার সঙ্গে থাকতে পারে বিরক্তি কিংবা ভয়ের অনুভূতি। দৈহিক উপসর্গের সমাহারও।
বিষণ্নতা রোগে অ্যাংজাইটি উপসর্গও থাকতে পারে, কান্নার অভিব্যক্তিও। বিষণ্ন রোগী নেতিবাচক চিন্তার জালে জড়িয়ে যায়। সে নিজেকে জীবনের সব ক্ষেত্রে পরাজিত ভাবে। ভাবে অন্যরা তার পরাজয় দেখছে। কোনো অবস্থাতেই আত্মবিশ্বাস খুঁজে পায় না। অপরাধবোধেও আক্রান্ত হতে পারে রোগী। নিজেকে সবকিছুর জন্য দোষী ভাবতে পারে। আগের সামান্য ভুল কিংবা তুচ্ছাতিতুচ্ছ অসততার জন্য নিজেকে দুষতে থাকে। দীর্ঘ বছর ধরে রোগীর মনেই ছিল না ঘটনাগুলো, কিন্তু দেখা গেল বিষণ্নতায় আক্রান্ত হলে সে বিষয়গুলো ফুলে-ফেঁপে মর্মযাতনা বাড়িয়ে তোলে। খুঁটিনাটি এ ধরনের তুচ্ছ ঘটনা মনে করতে থাকলে, ঐ ঘটনাগুলোর নেতিবাচক বিশ্লেষণে সার্বক্ষণিক ডুবে থাকলে, বিষণ্নতা রোগ হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়। বিষণ্ন মন শুধু খুঁজে বেড়ায় অতীতের অসুখী ঘটনাগুলো।

যদিও মানসিক রোগ, তবু দেখা যায় এ রোগের দৈহিক উপসর্গ ব্যাপক যাতনা তৈরি করে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিষণ্ন রোগীদের দৈহিক উপসর্গ বেশি দেখা যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দৈহিক উপসর্গের দাপট বিষণ্ন মেজাজের তীব্রতাও ছাড়িয়ে যায়। বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক এসব উপসর্গের দেহগত প্যাথলজি বা ত্রুটি খুঁজে পান না। মাথাব্যথা, পুরো দেহে ব্যথা এবং দেহের বিভিন্ন অর্গানে বহুমাত্রিক উপসর্গের দীর্ঘ প্রভাব দেখা যেতে পারে। ফলে রোগীরা বারবার মেডিক্যাল চিকিৎসার জন্য ফিজিশিয়ানদের কাছে ছুটতে থাকে। প্রাথমিকভাবে রোগ ধরা না পড়লেও রোগীর আর্থিক ক্ষতি বাড়ে, যাতনা ও দুর্দশা আরো বেড়ে যায়।

অধিকাংশ বিষণ্ন রোগী ঘুমের সমস্যার কথা বেশি গুরুত্ব দেয়। স্বপ্ন কিংবা দুঃস্বপ্নে ভোগে। ঘুম থেকে উঠে তৃপ্তি বোধ করে না। অতৃপ্ত ঘুমের কারণে প্রতিদিন কাতর থাকে। অনেকে আবার বেশি ঘুমায়। অধিকাংশ রোগীর ক্ষুধা মরে যায়, ওজন কমে যায়। ব্যতিক্রমধর্মী কোনো কোনো রোগী বেশি খেতে পারে। তাদের ওজনও বেড়ে যেতে পারে। যৌন ইচ্ছা ও আগ্রহ কমে যেতে পারে। মেয়েদের মাসিকের নানা সমস্যা হয়।

বিষণ্নতার কারণে কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। দেহের গতি কমে যেতে পারে। কেউ কেউ আবার অস্থিরতায় ভুগতে পারে। ভেতরের অস্থির মন তার গতিবিধির স্থিরতা নষ্ট করে দিতে পারে। এ সময় যে-কেউ রোগীর অস্থির চিত্তের অবস্থা বাইরে থেকে দেখতে পারে। এ ধরনের অবস্থাকে বলা হয় অ্যাজিটেটেড ডিপ্রেশন (Agitated Depression)।

বিষণ্ন রোগীদের মধ্যে অবসেশন কিংবা অ্যাংজাইটি দেখা যায়। এমনকি সাইকোটিক উপসর্গও দেখা দিতে পারে। গুরুতর বিষণ্ন রোগীর ১৫ শতাংশের এ ধরনের উপসর্গ দেখা যায়। ভ্রান্ত, অলীক বিশ্বাস তাদের মনে স্থায়ীভাবে গেঁথে যেতে পারে। তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে পারে, সাজাই আমার প্রাপ্য। কোনো যুক্তি দিয়ে তার বিশ্বাস থেকে তাকে টলানো যায় না। রোগী আরো বিশ্বাস করতে পারে, তার দেহের সব ধরনের কাজ ব্যাহত হচ্ছে। কখনোই আর তা ভালো হওয়ার নয়। ধ্বংস হয়ে গেছে তার সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কাজ।
বাংলাদেশে এর আগে আত্মহত্যার হার ছিল প্রতি বছর প্রায় ১০ হাজারের কাছাকাছি। করোনার এক বছরে সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৪ হাজারের ওপরে। বিষণ্নতাকে দূর করে আত্মহত্যা-প্রতিরোধকে গুরুত্ব দিতে হবে মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত পেশাজীবীদের। একই সঙ্গে আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতির জন্য গ্রহণ করতে হবে নানা উন্নয়নমুখী কর্মসূচি। পরিস্থিতি যথাযথভাবে মোকাবিলা করার জন্য সর্বপ্রথম জরুরি বিষয় হচ্ছে ব্যক্তির সচেতনতা, পরিবারের সচেতনতা। নিয়মিত এক্সারসাইজ, ইয়োগা, মেডিটেশন করতে হবে। নিশ্চয়ই আমরা করোনাসৃষ্ট উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, মনস্তাত্ত্বিক ট্রমা-পরবর্তী পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজ-অর্ডার ও বিষণ্নতাকে হটিয়ে আনন্দময় জীবনের পথে পা বাড়াতে পারব আবার। অনেকে ট্রমা বহন করবে দীর্ঘদিন। পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেসের দীর্ঘমেয়াদি যাতনা ধীরে ধীরে তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেবে। অস্থিরতা উদ্বেগ, মনোযোগের ঘাটতি, শব্দ-কথাবার্তা সইবার শক্তি কমে যাবে অনেকের। দুঃস্বপ্নে বারবার ভয়াবহ ঘটনাগুলো মনে হানা দেবে, কোনো ‘কিউ’ সামনে এলে সঙ্গে সঙ্গে পুরোনো ঘটনাটা মনের মধ্যে জেগে উঠবে। ঘুমের সমস্যাও শুরু হয়ে যাবে ভুক্তভোগীর। এসব থেকে বাঁচতে হলে এখন যারা ভয়াবহ ঘটনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, তাদের ইমোশনাল রিলিজ হওয়া দরকার, সাইকোলজিক্যাল ফাস্টএইড দরকার, দরকার ক্রাইসিস ইন্টারভেনশনও। এসব চিকিত্সাসেবা গ্রহণ করলে পরবর্তী সময়ে বিষণ্নতা রোগ, পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজ-অর্ডার অথবা অ্যাডজাস্টমেন্ট ডিজ-অর্ডারে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা কমে আসবে।

মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকার অর্থ হচ্ছে নিজের মধ্যে স্বস্তি থাকা, নিজের সামর্থ্যগুলো শনাক্ত করা, প্রতিদিনের চাপ মোকাবিলা করার ক্ষমতা অর্জন করা, প্রতিদিনের কাজগুলো ঠিকমতো পালন করা এবং নিজের দক্ষতাকে শানিত করে পরিবার, সমাজ ও দেশের জন্য কিছু করা।

এ দুর্যোগকালীন দেহ ও মন সুস্থ রাখার জন্য নিয়মিত এক্সারসাইজ, পুষ্টিকর খাদ্যগ্রহণ এবং সামাজিক সংযোগ বজায় রাখা জরুরি।

করোনার অভিঘাতে সৃষ্ট ক্ষতি, ভয়, আতঙ্ক, বিষণ্নতা দীর্ঘায়িত হয়েছে, হচ্ছে। তাছাড়া বিশ্ব জুড়ে অর্থনৈতিক বৈষম্য-বিপর্যয়ও বিষণ্নতার বড় ঝুঁকিপূর্ণ কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ভয় জয় করতে হবে, নতুন কর্মোদ্দীপনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার মনোবল বাড়াতে হবে। মনের নেতিবাচক চিন্তা শাসন করে ইতিবাচক ভাবনায় ঋদ্ধ হতে হবে। সর্বোপরি অর্থনৈতিক বিপর্যয়ও কাটিয়ে ওঠার উদ্যোগ নিতে হবে। হতাশ না-হয়ে কোভিড-উত্তর শারীরিক ও মানসিক যাতনা, সমস্যা মোকাবিলার জন্য চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে।
বিশ্ব জুড়ে যে অসম অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং বৈশ্বিক সম্পদ, টিকা নিয়ে যে-বৈষম্য তৈরি হয়েছে তার থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বিশ্বের নেতৃবৃন্দকে আহ্বান জানিয়েছে ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেন্টাল হেলথ’, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’, ইউনিসেফসহ মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী সব স্টেকহোল্ডার। সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিশ্ব জুড়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার বৈষম্য রোধ করার আহ্বান এসেছে। চিকিত্সা গ্যাপ পূরণের ডাক এসেছে। মেডিক্যাল শিক্ষা কারিকুলামসহ চিকিত্সকদের প্রশিক্ষণ যুগোপযোগী করার পরামর্শ দিয়ে বলা হয়েছে শিশু-কিশোর-বৃদ্ধ সবার মানসিক স্বাস্থ্যকে বিশেষ বিবেচনায় উন্নয়নের উদ্যোগ নিতে হবে। প্রতিটি রাষ্ট্র এনজিও এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর উদ্দেশে বলা হয়েছে : বিশ্ব জুড়ে বৈষম্য দূর করে, এমন নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে, মানুষের মানবাধিকার উন্নত করার কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতে হবে। কাউকে পেছনে রেখে নয়, উন্নত ডিজিটাল প্রযুক্তির ছোঁয়া ছড়িয়ে দিতে হবে বয়োজ্যেষ্ঠসহ অনুন্নত বিশ্বের মানবগোষ্ঠীর জন্য। (সুত্র: ইত্তেফাক)

লেখক: জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক
এই বিভাগের আরও খবর