লালমনিরহাট বার্তা
শিশুর যত্ন ও বিকাশ
ড. প্রবীর রায় | ৫ জুন, ২০২৪, ৯:৩৭ AM
শিশুর যত্ন ও বিকাশ

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুযায়ী মানুষ সুস্থ রূপে আত্মপ্রকাশ করে প্রধানত তিনটি বিকাশের সমন্বয়ের উপর ভিত্তি করে, তা হল: শারীরিক বিকাশ, মানসিক বিকাশ ও সামাজিক বিকাশ। শিশুদের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। আমরা সাধারণত শিশুর শারীরিক বিকাশে যতটা মনোযোগ দিই, ঠিক ততটাই মানসিক বিকাশের ব্যাপারে মনোযোগ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি না। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ যে, শিশু মানসিকভাবে সুস্থ না হলে তার পরিপূর্ণ বিকাশ ক্রমান্বয়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়। শিশুর বেড়ে ওঠা এবং পরিপূর্ণতা লাভের জন্য, জন্মের প্রথম সাত আট বছর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রথম তিন বছর বুদ্ধি ও বিকাশের জন্য সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সময় বলে ধরা হয়। এই সময়কালে শিশুর মস্তিষ্ক নমনীয় থাকে এবং দ্রুত বিকাশ লাভ হয়। শিশুর ভালো-মন্দ অভিজ্ঞতাগুলো মস্তিষ্কের বৃদ্ধির উপর সর্বদা কড়া দৃষ্টি রাখে। তাই এই এই সময়কালে বাবা-মাকে খুব যত্নের সাথে শিশুর লালন পালন করা প্রয়োজন।

মানসিক বিকাশের শ্রেণীবিন্যাস

শিশুর মানসিক বিকাশ চার স্তরে বিভক্ত:

1. প্রথম স্তর - সেন্সরিমোটর স্টেজ [০ - ২ বছর]: এই স্টেজে একটি শিশু ইন্দ্রিয় ও বডি মুভমেন্টের সাহায্যে কোন এই স্টেজে একটি শিশু ইন্দ্রিয় (চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা,ও ত্বক) এবং বডি মুভমেন্টের (শরীরের নাড়াচাড়া) সাহায্যে কোন বস্তু সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে। এই সময় শিশুকে খেলনা দেওয়া হলে সে হাত বাড়িয়ে ধরতে চায়, মুখ দিয়ে স্বাদ গ্রহণ করতে চায় এবং ছুড়ে ফেলে শব্দ শুনতে চায়। যদি এই সময় তার হাত থেকে খেলনা সরিয়ে নেওয়া হয় তাহলে সে কান্না শুরু করে দেয়।

2. দ্বিতীয় স্তর - প্রি-অপারেশনাল স্টেজ [২ - ৭ বছর]: এই বয়সে শিশুরা নিজে যুক্তি বোঝেনা ও তার সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারেনা।

3. তৃতীয় স্তর - কংক্রিট অপারেশনাল স্টেজ [৭ - ১১ বছর]: এই বয়সে শিশুর মধ্যে যৌক্তিক চিন্তাভাবনা আসা শুরু হয়।

4. চতুর্থ স্তর - ফরমাল অপারেশনাল স্টেজ [১১ বছর ও তার ঊর্ধ্বে]: এই স্তরে শিশু তার শৈশবকাল পেরিয়ে কৈশোরে পদার্পণ করে, সঙ্গে সঙ্গে তার চিন্তাভাবনা, বিচার বিশ্লেষণ করার জ্ঞানার্জনের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, পাশাপাশি আবেগ-অনুভূতি সম্পর্কে ধারণা জন্মায়। এই সময়কাল থেকে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মতো চিন্তার জগতে প্রবেশ শুরু।

যে সকল শিশুর মানসিক বিকাশ খুব ভালো তারা উপরোক্ত স্তর গুলো দ্রুত অতিক্রম করার সক্ষমতা অর্জন করে। অপরদিকে যে সকল শিশুর মানসিক বিকাশ কিছুটা স্লথ তাদের এক স্তর থেকে অন্যস্তরে পৌঁছাতে বিলম্ব হবে।

শিশুর মানসিক বিকাশে অভিভাবকের করণীয়:

• সুস্থ পরিবেশ: প্রতিটি শিশু বড় হয় একটি নির্দিষ্ট পরিবেশের মাধ্যমে, যা পরবর্তীতে তার ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন ঘটায়। সুস্থ এবং সুন্দর পরিবেশে বেড়ে ওঠা শিশুর ব্যক্তিত্ব হয় সুন্দর ও নিরাময়।

• সৃজনশীল খেলনা: বয়স উপযোগী শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সঠিক সৃজনশীল ও আবিষ্কারধর্মী খেলনা নির্বাচন করা প্রয়োজন। এতে শিশুর সৃজনশীলতা বিকশিত হবে এবং পাশাপাশি বুদ্ধিও বাড়বে।

• ছবি আঁকা: বৈজ্ঞানিকভাবে সত্য যে শৈশবে শিশুরা ছবি আঁকার মাধ্যমে বুদ্ধিমান ও মেধাবী হয়। কোন শিশু যখন অভিনব চিন্তার মাধ্যমে ছবি আঁকে বা শিল্পচর্চা করে তখন তার সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায়। ফলে নিজেদের সমস্যা সমাধান করার ক্ষমতা বাড়ে এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সক্ষম হয়।

• সংগীত চর্চা: শিশুর মানসিক বিকাশে সংগীত চর্চা এক অনন্য উপকরণ। বিভিন্ন ধরনের রাগ প্রধান বা ক্লাসিকাল সংগীত শ্রবণে মস্তিষ্ক থেকে ডোপামিন নামক নিউরোট্রান্সমিটার বা রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত হয় যা শিশুর শেখার আগ্রহ বহু গুন বাড়িয়ে তোলে।

• কাজ করতে উৎসাহ দেওয়া: শিশুর নিজের কাজ নিজে করতে উৎসাহ দেওয়া খুব প্রয়োজন। এতে শিশু দায়িত্ব নিতে শেখে, যেমন স্কুলের হোমওয়ার্ক, নিজের বই গোছানো ইত্যাদি। নিজের কাজ করার আনন্দে পরবর্তীতে সে একজন দায়িত্ববান নাগরিক হয়ে ওঠে।

• বই পড়া: অতিরিক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহারের পরিবর্তে বই শিশুর মনের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে। শৈশব থেকে নিয়মিত শিক্ষামূলক বই এর পাশাপাশি গল্পের বই পড়ার অভ্যাসে শিশুর মানসিক বিকাশ প্রসারিত হয়, জ্ঞানের পরিধি বাড়ে, মনের ভাব প্রকাশের ক্ষমতা অর্জন এবং বুদ্ধিমত্তাও বৃদ্ধি পায়।

• ভয় দেখানো থেকে বিরত থাকা: আজকাল অনেক অভিভাবকরা ভয় দেখিয়ে শিশুকে শান্ত করার চেষ্টা করে (যেমন ভূতের ভয়, শাস্তির ভয়, মারের ভয় ইত্যাদি)। ভয় দেখানোর ফলে শিশুর মনের গভীরে আতঙ্ক সৃষ্টি হয় এবং শিশুর স্বাভাবিক বিকাশে বাধা সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে। পরবর্তীতে সেই ভয় অন্যরূপ ধারণ করে ট্রমাতে পরিবর্তিত হতে পারে। ফলস্বরূপ নানান মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারে ও আত্মবিশ্বাস টোলে যেতে পারে। পাশাপাশি সৃজনশীলতার বিকাশও ব্যাহত হতে পারে।

• সমবয়সীদের সাথে তুলনা থেকে বিরত থাকা: প্রতিটি শিশুই তার নিজস্ব ক্ষমতা ও গুণ নিয়ে পৃথিবীতে আসে। প্রত্যেক শিশুর ক্ষমতা ও গুণ স্বতন্ত্র। সুতরাং সবার মধ্যে একই রকম প্রতিভা থাকবে এরকম ধরে নেওয়াটাই ভুল। অথচ অভিভাবকরা প্রায় সময় কারণে অকারণে অন্য শিশুর সঙ্গে তুলনা টানে। ফল হতে পারে মারাত্মক, শিশুর আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরার সম্ভাবনা থাকে। শিশুর পড়াশোনার রেজাল্ট নিয়ে অতিরিক্ত প্রত্যাশা না করে তাদের ধারণক্ষমতা অনুযায়ী প্রত্যাশা করা বাঞ্ছনীয়।

• অভিভাবকদের সংযত থাকা: শিশুর সামনে অভিভাবকদের ঝগড়া বা মারামারি থেকে বিরত থাকা উচিত। এতে শিশু মনে গভীর প্রভাব ফেলে, নানান মানসিক রোগের স্বীকার হয়।

• আদর ও শাসন: অতিরিক্ত প্রশ্রয় দিলে শিশুর নিজস্ব বিকাশের ভারসাম্য নষ্ট হয় ও অপরের উপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। অতিরিক্ত চাওয়া পাওয়ার আনন্দ এক নিমেষে জেদ, রাগ ও ভাঙচুরে পরিবর্তিত হয় যখন তা মেটানো না হয়। অপরদিকে অতিরিক্ত শাসন, শৃঙ্খলাবোধ শিশুর মানসিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়।

• সবার সাথে খেলাধুলা: অভিভাবকরা অজান্তেই তাদের শিশুদের শৈশব চুরি করে ফেলছে। আজকাল প্রায় শিশুরা হয় স্কুল ছুটির পর পরই বা স্কুল থেকে ফিরেই প্রাইভেট টিউশন পড়তে যায়। বাড়ি ফিরে সাথীদের সাথে মিলেমিশে খেলার পরিবর্তে মোবাইল বা ল্যাপটপে মন দেয়। একসাথে খেলাধুলা করলে শারীরিক এবং মানসিক দু 'ধরনেরর উন্নতি হয়। মিলেমিশে থাকার ক্ষমতা, কমিউনিকেশন স্কিল ও লিডারশিপ স্কিল বাড়ে।

প্রতিটা শিশুই জাতির ভবিষ্যৎ। তাকে যত্নে লালন পালন করার দায়িত্ব অভিভাবকদের। শিশুর আচরণে যদি কোন অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করেন সাথে সাথে প্রশিক্ষিত সাইকোলজিস্টের পরামর্শ নিন। বাবা-মায়ের স্নেহ ভালোবাসা ও সান্নিধ্য শিশুর মানসিক বিকাশে ত্বরান্বিত হয়, সুন্দর নাগরিক রূপে আত্মপ্রকাশ করে।

(লেখক- ভারতের কলকাতার ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট)

এই বিভাগের আরও খবর