লালমনিরহাট বার্তা
আসুন জেনে নিই গ্রাফিক্স কার্ডের আদ্যোপান্ত
বার্তা অনলাইন ডেস্কঃ | ৯ নভে, ২০২১, ৭:১০ AM
আসুন জেনে নিই গ্রাফিক্স কার্ডের আদ্যোপান্ত
আমরা সকলেই কম্পিউটার কিনতে যেয়ে যে জিনিসটির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেই তা হল গ্রাফিক্স কার্ড। যারা সময়মত গুরুত্ব দেন না, তারা পরবর্তীতে সাধের গেমগুলো খেলতে না পেরে এই ব্যাপারে মনোনিবেশ করেন। প্রযুক্তির দিন দিন উন্নতির কারণে তৈরী হচ্ছে নতুন নতুন অ্যাপ্লিকেশান বা গেমস। এসব চালাতে হলে ভালো মানের গ্রাফিকস কার্ড কেনার বিকল্প নেই। আজ আমি গ্রাফিক্স কার্ড এর সাথে জড়িত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে টিউন করছি। চলুন শুরু করে দেই।

প্রথম কথা: গ্রাফিক্স কার্ড কী?
গ্রাফিক্স কার্ড হল মাদারবোর্ড এর সাথে সংযুক্ত এমন একটি ডিভাইস যেটা এক বা একাধিক মনিটরে দেখার জন্য ভিডিও আউটপুট তৈরী করে, এবং অন্যান্য ডিভাইস যেমন ক্যাপচার কার্ড, টিভি, হোম থিয়েটার, মিউজিক সিস্টেম ইত্যাদি এ ভিডিও দেখানোর কাজে সাহায্য করে। আজকাল গ্রাফিক্স কার্ড এর সাথে ইন্টিগ্রেটেড সাউন্ড ডিভাইস থাকে। ফলে ভিডিও এর পাশাপাশি অডিও আউটপুটও পাওয়া যায়।

গ্রাফিক্স কার্ডে কী কী থাকে?
কোর ক্লক: আগেই বলেছি যে এটা ভিডিও আউটপুট দিয়ে থাকে। এই কাজের জন্য সকল গ্রাফিক্স কার্ডে থাকে একটি ‘কোর ক্লক’ যেটা মাদারবোর্ড এর আসল প্রসেসরের মতই কাজ করে এবং নিজস্ব ফ্রিকোয়েন্সি রয়েছে। এটাকে বলা হয় GPU বা Graphics Processing Unit. এর স্পীড ২৫০ মেগাহার্টজ থেকে ৪ গিগাহার্টজ পর্যন্ত হয়ে থাকে। এই GPU যেকোন ছবিকে প্যারালাল পদ্ধতিতে পিক্সেলের পর পিক্সেল আকারে সাজিয়ে ছবি তৈরী করে। পিক্সেল (Picture থেকে Pix আর Element থেকে el নিয়েই Pixel) হল যেকোনো ছবির ক্ষুদ্রতম অংশ যার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে, এবং তা লাল, নীল আর সবুজ ডট বা ফোঁটার সমন্বয়ে গঠিত।

ভিডিও বায়োস: মাদারবোর্ড এর বায়োসের মতই গ্রাফিক্স কার্ড এর বায়োস অন্যান্য ডিভাইস ও অপারেটিং সিস্টেম এর কার্নেলের সাথে সংযোগ রক্ষা করে। এখানে কার্ডের ভোল্টেজ, মেমরি, ফ্যান স্পীড ইত্যাদি নিয়ে সেটিংস দেওয়া থাকে। অবশ্য এগুলো পরিবর্তন করে আরো বেশী পারফরমেন্স পাওয়া সম্ভব।

ভিডিও মেমরি: র‍্যামের মতই গ্রাফিক্স কার্ডেও মেমরি থাকে যেটাকে ভিডিও মেমরি বলা হয়। বর্তমানে DDR ধরনের মেমরি নিয়ে গ্রাফিক্স কার্ড তৈরী করা হচ্ছে। DDR মানে হল Double Data Rate. অর্থাৎ গ্রাফিক্স কার্ডটি কি হারে ডাটা আদান প্রদান করবে তা নির্ভর করে এই মেমরি এর উপর। বিভিন্ন ধরনের মেমরি লেআউট রয়েছে। যেমন DDR, DDR2, GDDR3, GDDR3, GDDR5. মেমরির সাথে ক্লক স্পীডের সম্পর্ক আছে। নিচের ছকে দেখে নিন কোন ধরনের মেমরিতে ক্লক স্পীড আর ডাটা রেট কত।

ভিডিও আউটপুট: গ্রাফিক্স কার্ডের বাকি যা থাকে তা হল ভিডিও দেখানোর একটা ব্যাবস্থা। অর্থাৎ ভিডিও আউটপুট কোন মনিটর বা ডিসপ্লে ডিভাইস এ পাঠানোর উপায়। বিভিন্ন ইন্টারফেস আছে যার মাধ্যমে এটা করা হয়। চলুন দেখে নিই কিভাবে –

১. ভিজিএ: এটা Video Graphics Array এর ছোট্ট ফর্ম। এটা বহুল ব্যাবহৃত আর জনপ্রিয় একটি ইন্টারফেস। ১৫ পিন বিশিষ্ট সকেটের মাধ্যমে ভিডিও পাঠানো হয়। এটা RGB এর মাধ্যমে সিগনাল প্রেরণ করে।
২. এইচডিএমআই: সম্প্রতি এটা খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে কারন ক্ষুদ্র পোর্ট আর হাইডেফিনিশান আউটপুটের কারনে। প্রায় সকল গ্রাফিক্স কার্ডে অন্তত একটি এইচডিএমআই পোর্ট থাকে। High-Definition Multimedia Interface কে HDMI বলা হয়।
৩. ডিভিআই: Digital Visual Interface থেকেই ডিভিআই এসেছে। এটা ২৪ পিন বিশিষ্ট পোর্ট যা নয়েজ ছাড়া ছবি দেখাতে ব্যাবহৃত হয়। সকল এলসিডি ও এলইডি মনিটরে এটা থাকে কারণ ডিভিআই দিয়ে ফ্ল্যাট স্ক্রিনে ছবি অনেক ভালো দেখা যায়।
৪. এস-ভিডিও: Separated Video থেকেই বলা হয় এস-ভিডিও। বিভিন্ন ডিভিডি প্লেয়ার, টিভি ইত্যাদি এ ভিডিও দেখানোর জন্য এটা জনপ্রিয়। তবে আধুনিক গ্রাফিক্স কার্ডে এইচডিএমআই এর প্রসারের কারণে এটা আর ব্যবহার করা হয়না।

অন্যান্য যা যা থাকে:
কোর ক্লক খুব বেশি গরম হয়ে যাওয়ার কারণে ঠান্ডা করতে হিট সিঙ্ক বা ফ্যান ব্যাবহৃত হয়। হাই-এন্ড পিসি তে ঠান্ডা করতে লিকুইড কুলিং সিস্টেম ব্যাবহৃত হয়। কিছু কার্ডে পাওয়ার দেওয়ার জন্য আলাদা কানেক্টর থাকে। এখানে পাওয়ার সাপ্লাই থেকে জ্যাক লাগানো হয়।

গ্রাফিক্স কার্ড কোথায় কিভাবে লাগানো থাকে?
প্রথমদিকে ১৯৯৩ সালের দিকে গ্রাফিক্স কার্ড মাদারবোর্ড এ যে সকেটে লাগানো হত তার নাম ছিল পিসিআই বা Peripheral Component Interconnect. এটা প্যারালাল পদ্ধতিতে কাজ করত। পরে ইন্টেল ১৯৯৭ এ AGP (Accelerated Graphics Port) নামে পোর্ট তৈরী করে। এটা প্যারালাল পদ্ধতিতে কাজ করতে বলে অনেক ধীরগতির ছিল। অনেকে গ্রাফিক্স কার্ডকে এজিপি কার্ড বলেন যা সম্পুর্ণ ভুল কারণ এজিপিতে ৩টা খাঁজ থাকত আর বর্তমানে পিসিআই গ্রাফিক্স কার্ডে ২টা খাঁজ থাকে। ২০০৪ এর পর বাজারে নতুন পোর্টযুক্ত মাদারবোর্ড আসে যাকে পিসিআই-ই বলা হয়। PCI-e এর ফুল ফর্ম PCI-Express. উল্লেক্ষ্য যে PCIe পোর্টে শুধু গ্রাফিক্স কার্ড না, অন্যান্য সাউন্ড কার্ড, ল্যান কার্ড, ওয়াইফাই কার্ডও লাগানো হয়। একারণে অনেক মাদারবোর্ড এ একাধিক PCIe স্লট থাকে।

বিল্ট-ইন গ্রাফিক্স কার্ড নিয়ে কিছু কথা:
বলতে গেলে প্রতিটা মাদারবোর্ডেই বিল্ট-ইন জিপিইউ থাকে। এটা আসলে প্রসেসরের কিছু অংশ ব্যবহার করে ভিডিও প্রসেস করতে। আর ফিজিকাল র‍্যামের একটা অংশ ব্যবহার করে ভি-র‍্যাম হিসেবে। এটার কোর ক্লক স্পীড খুবই কম হয়। এই গ্রাফিক্স কার্ড দিয়ে চলার মত সকল কাজ করা গেলে কখনোই রিচ-অ্যাপ্লিকেশান চালানো সম্ভব নয়। তাই কম ক্ষমতার হলেও আলাদা গ্রাফিক্স কিনে নেওয়াই উত্তম।

গ্রাফিক্স কার্ড নির্মাতা প্রতিষ্ঠান:
ভেবে অবাক হবেন যে গ্রাফিক্স কার্ড নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অনেক। কি ভাবছেন? আজ পর্যন্ত এটিআই, এনভিডিয়া আর ইন্টেল এইচডি গ্রাফিক্স ছাড়া তো কিছুই শুনলাম না, এটা কি ধরনের কথা? আসলে আমি আপনি দুজনই সঠিক। জিপিইউ বা প্রসেসর চিপ তৈরী করে মুলত এএমডি, এনভিডিয়া আর ইনটেল। সেটাকে কাজে লাগিয়ে কার্ড বানায় এটিআই, এমএসআই, আসুস, বায়োস্টার, ফক্সকন, গিগাবাইট, এক্সএফএক্স, স্যাফায়ার ইত্যাদি কোম্পানি।

গ্রাফিক্স কার্ডের কতগুলো বিষয় যা দেখে কিনবেন:

ট্রানজিস্টর সংখ্যা: কার্ডে যত বেশি ট্রানজিস্টর থাকবে, নয়েজ তত কম হবে, ভিডিও তত বেশি ভালোভাবে ফিল্টার হবে।
ক্লক স্পীড: এটা যত ভালো এবং বেশি হবে তত ভাল পারফরমেনস পাবেন। এটার দিকে নজর দিন।
মেমরি: এটাও আগে আলোচনা করেছি। এখন ১ জিবি থেকে ৪ জিবি পর্যন্ত কার্ড পাওয়া যাচ্ছে। আপনার কাজের ধরন অনুযায়ী দেখুন কোনটা লাগে।
মেমরি টাইপ: DDR, DDR2, GDDR3, GDDR4, নাকি GDDR5 তা দেখে নিন। যত ভালো হবে, তত ভালো পারফরমেন্স পাবেন। অবশ্য GDDR5 এর দাম একটু বেশি। জেনে রাখুন যে আপনার মাদারবোর্ড এর র‍্যাম DDR2 না DDR3 তার সাথে এটার কোন সম্পর্ক নেই।
বাস স্পীড: মেমরি বাস হল প্রসেসরটি একবারে কতটুকু ডাটা নিয়ে কাজ করে। বাস বেশি হলে খুব দ্রুত আউটপুট পাবেন। আবার বাস খুব বেশি হলে পাওয়ার খরচ তো বেশি হবেই, তার উপর আপনার মনিটর ছোট হলে বাস অব্যাবহৃত থাকবে।
পিসিআই ভার্সন: আপনার মাদারবোর্ড এর স্লট কোনটি তা দেখে কিনবেন। ধরুন আপনার PCIe x8, কিন্তু আপনি PCIe x16 2.0 কিনে আনলেন। তাহলে সেটা কাউকে দিয়ে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
ডিরেক্ট এক্স সাপোর্ট: ডিরেক্ট এক্স হল মাইক্রোসফট এর অনন্য সংযোজন। নতুন নতুন হার্ডওয়্যার, ভিডিও এক্সিলারেশানের জন্য এটি অপরিহার্য। এর নতুন ভার্সন ১১। তাই গ্রাফিক্স কার্ড নতুন ভার্সন এর ডিরেক্ট এক্স সাপোর্ট করে কিনা দেখে নিন।
পিক্সেল শেডার: ভিন্ন মাত্রার পিক্সেল এবং আলোর তুলনামূলক প্রসেসিং এবং বৈশিষ্ট্য তুলে ধরতে পিক্সেল শেডার প্রয়োজন। আপনার গ্রাফিক্স কার্ড কত সাপোর্ট করে তা দেখে নিবেন। বর্তমানে এর ৫ ভার্সন রয়েছে।
ওপেন জি-এল: এটি হল ভিডিও প্রসেসিং-র জন্য অসংখ্য লাইব্রেরি ফাংশনের সমাহার, যেটা আউটপুটকে আরো দ্রুততর করে। কেনার সময় এটা সাপোর্ট করে কিনা এবং কত ভার্সন তা দেখে নিবেন।
অ্যান্টি-অ্যালাইজিং: এটা ব্যবহার করে ছবির ফেটে যাওয়া বা ঘোলাটে ভাব দূর করা যায়। বিভিন্ন গেম ও অ্যাপ এ এটা খুবই ব্যাবহৃত হয়। তাই এই ফিচার আছে কিনা দেখে নিন।
ম্যাক্স আউটপুট: আপনার মনিটর যদি ১৬০০ বাই ১২০০ রেজোলিউশানের হয় তাহলে নিশ্চয়ই ১০২৪ বাই ৭৬৮ আউটপুটের গ্রাফিক্স কিনবেন না। বর্তমানে সব কার্ডের আউটপুট ১৬০০ বাই ১২০০ থেকে ২৫৬০ বাই ১৬০০ এর মাঝে। তাই এটা আপাতত অত ভাবনার বিষয় না।
পাওয়ার ফ্যাক্টর: কার্ডটি কত ওয়াট সাপ্লাই চায় তা দেখুন। প্রয়োজনীয় পাওয়ার দিতে না পারলে কাজ করতে যেয়ে আটকে যাবে। ক্ষতিও হতে পারে। সাধারনত ৪০০ থেকে ৮০০ ওয়াট সাপ্লাই দরকার। লাগলে আপনার পিএসইউ আপডেট করুন।
মাল্টি আউটপুট: আপনি যদি একসাথে দুই বা ততোধিক মনিটরে দেখতে চান তাহলে এটা আপনার দরকার। খেয়াল করে দেখবেন যে প্রায় সব কার্ডেই দুই বা তিনের বেশি পোর্ট থাকে। এগুলো দেওয়া হয় যেন একই সাথে সকল মনিটরে দেখা সম্ভব হয়।
রিফ্রেশ রেট: আউটপুট কত রেটে পাবেন, অর্থাৎ মনিটরে কত হার্টজে ভিডিও আসবে তা দেখে নিন। এর ডিফল্ট মান ৬০। তবে সিআরটি মনিটরে ৬০ এর নিচে দাগ বা ফ্লিকিং দেখা যায়। কিছু মনিটর ৭৫ হার্টজ এর নিচে দেখাতে সক্ষম না। তাই আপনার মনিটর এর জন্য কোনটা দরকার তা দেখে নিবেন।
মাল্টি-জিপিইউ: এটা ডাই-হার্ড গেমারদের জন্য। যদি একটা ভিডিও কার্ড নিয়ে আপনার মন না ভরে তাহলে একের বেশি কার্ড লাগানো সম্ভব এরকম কার্ড কিনুন। আর সেই সাথে মাল্টি-জিপিইউ সাপোর্ট করে এরকম মাদারবোর্ডও কিনতে হবে আপনাকে। এনভিডিয়া আর এএমডি দুটাই মাল্টি-জিপিইউ সিস্টেম সাপোর্টেড চিপ তৈরী করে।
এনার্জি সেভিং: আপনার চিপটি কাজের পাশাপাশি দূর্ণীতি করে আপনার বিদ্যুৎ বিল উঠাচ্ছে কিনা তার দিকে খেয়াল রাখবেন। এই জন্য এনার্জি স্টারের রেটিং দেখে কার্ড কিনুন।
সফটওয়্যার সাপোর্ট: আপনি যে সিস্টেম এ কাজ করেন সেই সিস্টেমে কার্ড এর ড্রাইভার পাবেন কিনা তা দেখে নিন। এখন এএমডি উইন্ডোজ, লিনাক্স আর ম্যাকের জন্য অফিসিয়ালি ড্রাইভার দিচ্ছে। তাই পছন্দ আপনার।

গ্রাফিক্স কার্ড-সহ ল্যাপটপ কেনার সময় যা যা খেয়াল করবেন:
ল্যাপটপ চলে ব্যাটারীতে। তাই কার্ড যদি বেশি পাওয়ার খরচ করে তাহলে দ্রুত চার্জ শেষ হবে, ব্যাটারীও নষ্ট হবে। তাই ওয়েবসাইটে খুঁজে দেখে নিন কোনটার পাওয়ার কনজাম্পশান কেমন। যেমন এটিআই ৪৬৭০ এর চেয়ে ৫৪৭০ বেশি ভালো। কিন্তু ৪৬৭০ অনেক কম বিদ্যুৎ ব্যবহার করে। ল্যাপটপে গ্রাফিক্স কার্ড এর কারণে তৈরী হওয়া তাপ ঠিকমত বের হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত এয়ার ভেন্ট আছে কিনা বা সেগুলো সহজেই ব্লক হয়ে যায় কিনা। ল্যাপটপ এর গ্রাফিক্স কার্ড নষ্ট হলে ঠিক করা বেশ দূরুহ ব্যাপার। তাই ভালো রিভিউ এবং কনফিগারেশান দেখে কিনুন। সূত্র: টেকটিউনস।
এই বিভাগের আরও খবর