লালমনিরহাট বার্তা
মিশরের সাথে বঙ্গের আত্মীয়তার যোগসুত্র তৈরী করেছিল বুড়ি তিস্তা
শমশের আলী, বিশেষ প্রতিনিধি | ৬ আগ, ২০২৩, ১১:০৪ AM
মিশরের সাথে বঙ্গের আত্মীয়তার যোগসুত্র তৈরী করেছিল বুড়ি তিস্তা

প্রায় দুই শত বছরেরও আগে মিশর থেকে সওদাগর হযরত শাহ এসেছিলেন ৯টি বাণিজ্যিক নৌকায় ঢেউ টিনের চালান নিয়ে নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলায় বুড়ি তিস্তা নদীর পাড়ে ভোগডাবুড়ি বন্দরে। সেই সব আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক নৌকা মেঘনা ও যমুনা নদী দিয়ে বুড়ি তিস্তায় প্রবেশ করতো।

তাঁর চতুর্থ প্রজন্মের বেশ কতক পরিবার এখানে শাহ পাড়ায় বসবাস করছে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বয়োজৈষ্ট জনাব ইব্রাহীম শাহ (১০৫) জীবিত আছেন। তিনি বাপ-দাদার কাছ থেকে শুনা ইতিহাসের কিছুটা বর্ণনা করেন। একটি প্রচীন কুয়ার গায়ে লাগানো ১লা জৈষ্ঠ ১৩২৬ বাংলা তারিখের একটি ফলকে উল্লেখ আছে এটি তৈরী করেছিলেন শ্রী নাহির উদ্দিন শাহ (তখন ভারতবর্ষে সকল ধর্মের মানুষের নামে সম্মানসূচক শ্রী ব্যবহার করা হতো)। তার ফলক থেকে অনুমান করা যায়, কুচবিহারের রাজা ইন্দ্রজিতের আমলে ভোগডাবুড়ি একটি জেলা ছিল। রাজনৈতিক সীমানার বিবর্তনের ফলে ভুগডাবুড়ি এখন নীলফামারী জেলার অন্তর্গত এটি ইউনিয়ন। উল্লেখ্য যে, সেই রাজার আমলেই অত্র অঞ্চলে ছিটমহালের উদ্ভব হয়।

তাঁদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, হযরত শাহ এখানে আসার পর প্রতিবছর স্থানীয় লোকদের নিয়ে মহা-ভোজের আয়োজন করতেন। একদা ভোজের অনুষ্ঠানে তিস্তা-বুড়ি নামের জীর্ণশীর্ণএকবৃদ্ধা শরিরের দুর্গন্ধ ও অসুস্থতা নিয়ে খাবারের ঘরে প্রবেশ করলে, লোকজন তাকে লম্বা বাঁশ দিয়ে দিয়ে গুতো মেরে ওখান থেকে বের করে দেয়। এই ঘটনার পরই নদীতে প্রচন্ড ঘুর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়, তখনই প্রতিটি নৌকা তিনবার পাক খেয়ে নদীতে তলিয়ে যায়। এভাবে ৯টি নৌকা একে একে তলিয়ে গেলে হযরত শাহ ও তার সঙ্গিরা আর তার দেশে ফিরে যেতে পারিনি। তবে, এইসব নৌকার একটিতে হযরত শাহ’রতাঁর দুটি পালক পুত্রও ছিল। লেকামুখে শুনেছিলেন, পুত্রদ্বয় কয়েক ক্রোশ দুরে কোন এক পরিবার নদী থেকে উদ্ধার করে নিজেরাই পালক হিসাবে গ্রহণ করেছিল। তারপর এই পরিবারের সাথে পালক পুত্রদ্বয়ের আর কোন যোগাযোগ হয়নি। স্থানীয়দের ধারণা যে, ঐ জীর্ণশীর্ণ বৃদ্ধার অভিশাপে এমনটি হয়েছিল।

হযরত শাহ অনেকবার এই এলাকায় থেকে চলে যাওয়ার মনস্থ করেন, কিন্তু মিশর থেকে কোন বাণিজ্যিক নৌকা না আসায় দেশে ফিরে যাওয়া হয় নি। তারপর মিশর থেকে নিয়ে আসা টিন বিক্রির টাকা দিয়ে তিনি অনেকখানী জমি কিনেছিলেন। তখন থেকেই শাহ পরিবার সওদাগর থেকে কৃষক বনে যায়। অবশেষে তারা এখানিই বিয়ে করে সংসারি হয়। তাদের বসবাসের গ্রামটি শাহপাড়া হিসাবে পরিচিত।

সেই আমলে বুড়ি তিস্তা নদীর পানিতে সেচ দিয়ে জমিতে চাষাবাদ হয়েছে। এই নদীই ছিল মৎস্য সম্পদে ভরপুর, অনেক জেলে পরিবার ছিল। যাতায়াতের অন্যতম উপায় ছিল নদীপথ। শুধু বিশুদ্ধ খাবার পানির জন্য ছিল কুয়া।

আরও আগের কথা এই বুড়ি তিস্তা ছিল মূল তিস্তা। যার উৎস্য সিকিমের পানহুরি পার্বত্য এলাকা। প্রায় সাড়ে চারশত বছর আগে ঘটে যাওয়া প্রলঙ্কারী ভূমিকম্পের ফলে, তিস্তা নদী দু’ভাগ হয়ে যায়। তিস্তা নদীর গতিপথও পরিবর্তিত হয়ে যায়। ভূমিকম্পের ফলে তখনকার বন-জঙ্গল মাটিতে তলিয়ে যায়। কয়েক বছর আগে একটি পুকুর খনন কালীন একটি বৃহদাকারের পুরনো শালগাছের গুড়ি পাওয়া গিয়েছে। এখনো নদীরতলদেশে খুঁচে খুঁচে শালের গুড়ি খোঁজা হচ্ছে। এই শালকাঠ অনেক শক্ত ও মজবুত, অনেক দামে বিক্রি হয়। তারই একটি টুকরা ওখানে আমরা দেখতে পেয়েছি।

শাহ পাড়ার লোকজনের মতে, ছোট বেলায় তারা এই নদীতে গোছল করতো, এখন ভাবায় যায় না। বড় বড় বোয়াল মাছ, তা এখন একেবারেই নাই। এখন কোন সওদাগর আসে না, ছোট নৌকাই চলে না। প্রায় ৬০ বছর আগে থেকেই একটির পর এটি বাঁধ নির্মাণের ফলে বুড়ি তিস্তা এখন মরা তিস্তা হয়ে গেছে। নদীতে পানি না থাকার কারণে এলাকা মরুময় দেখা যাচ্ছে। মাছ, গবাদী পশু-পাখির পরিমান অনেক কমেছে। এখন হাইব্রিড হাস-মুরগী ও গরু-ছাগলের চাষ হচ্ছে।

চিলা পাড়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ ও ভারতের রাজনৈতিক সীমানা বুড়ি তিস্তাকে দু’ভাগ করেছে। সেই সীমানার আইল থেকে মাত্র ১০০ গজ দুরের বসতি জনাব ইসমাইল হকের। দু’দেশের সীমানা নিয়ে অমিমাংসিত কিছুটা থাকায়, এখানে ভারত কাঁটা তারের বেড়া স্থাপন করেনি। বাংলাদেশের সীমানা জুড়ে রয়েছে কৃষি ক্ষেত। ক্ষেতের আইলই দু’দেশের কৃষকের সম্পর্কের বাধা হিসাবে কাজ করে। আমার সাথে সহকর্মী জনাব কায়কোবাদ হোসেন ছিলেন, তিনি নদীর সীমান সংক্রান্ত কিছু তথ্যের জন্য নিকটে কর্মরত কয়েকজন কৃষকের কাছে যেতেই, তারা বলে উঠলো আপনি এখনই চলে যান, এটা ভারত। জলদি চলে যান, নাহলে আমাদের সীমান্ত প্রহরীরা এসে আমাদেরকে অবান্তর অনেক কিছুই জিগ্যেস করবে এবং আমরা বিপদে পড়ে যাব। একথা শুনামাত্রই কায়কোবাদ দৌড়ে ৫ সেকেন্ডে এপাড়ে চলে আসলো আর আমাকেও ওখানে যেতে বারণ করলো।

তারা মূলত: হলদীবাড়ি এলাকার বসিন্দা, সীমান্ত ঘেঁষে তাদের জমি রয়েছে। সেখানেই ফসলে কীটনাশক ও সার প্রয়োগসহপরিচর্যা করছে। সীমান্ত প্রহরায় নিয়োজিত বাহিনী তাদেরকে এই পাড়ের কোন লোকের সাথে কথা-বর্তা বলা নিষেধ করে থাকে। দুই হাত দূরত্বে দুই দেশেরএকই ভাষাভাষী দু’জন কৃষক মাঠে কাজ করলেও কথা বলতে ভয় পায়। যদি কথা বলতেইহয় তাহলে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতি অবলম্বন করেই অনেক কাট-খড় পুড়িয়ে সামনা-সামনি কথা বলা বা দেখা করা যেতে পারে। আইনের সুতা দু’জনকে মাত্র দু’হাত পথ পেরুতে দেয় নি। এমনকি মাঠে কর্মরত কোন কৃষকেল জীবন সংকটাপন্ন হলেও সীমানার ওপারের কৃষক তাকে কোন ভাবেই সহায়তা করতে পারে না। মনে হলো, এখানে মানবাধিকার রাষ্টশক্তির কাছে পুরোপুরি জিম্মি।

যাহোক, ইসমাইল হকের মতে, ১৯৪৭ সালের পর থেকে বুড়ি-তিস্তার গতি স্তিমিত হতে থাকে। ৩০/৩৫ বছর আগেও শীতকালে নৌকা চলতো এখন বর্ষা কালেও সবখানে নৌকা চালানো যায় না। কারণ হিসাবে তারা বাঁধ দিয়ে পানি অন্যধারায় প্রবাহ করাকে দায়ী করছে। প্রথমত: বুড়ি-তিস্তার পানি বর্তমান তিস্তা নদীতে সংযুক্ত করা হয়েছে, তার উপরে হলদিবাড়িতে বাঁধ দিয়ে রাস্তার তৈরীর ফলে নদীতে কোন স্রোত নাই। শুধু বর্ষা কালে বৃষ্টি পানি বহনকারী খাল হিসাবে কাজ করে। পানি প্রবাহ না থাকায় পলি জমি নদীর তলদেশ উঁচু হয়েছে আবার গত ২০-২৫ বছর যাবৎ শীতকালে ইরি ধানের আবাদ করার জন্য টিলার মাটি দিয়ে তলদেশ উঁচু করা হয়েছে। এসবের ফলে নদীর নব্যতা কমেছে প্রায় ২০ ফুট। ভূমির খতিয়ানে তা খাস হলেও দখলী শর্তে মৌসুমী ধান চাষ চলছে মাত্র। নদীর অস্তিত্ব বিলীন হয়েগেলেও দখলদাররা দেশের অন্য এলাকার মত এখানেও জমির মালিকানা প্রতিষ্ঠায় মরিয়া হতে পারে। নদীর সীমানা নিয়েও জনমনে বিভ্রান্তি আছে। সঠিক তথ্য জনগণের কাছে নাই।

স্থানীয়দের মতে; এখানে আর মাছ পাওয়া যায় না বল্লেই চলে, আগের তুলনায় মাত্র ৫ভাগ তাও ছোট জাতের মাছ পাওয়া যায়। কমপক্ষে ১০ প্রজাতির মাছ আর এখানে নাই। আগে যারা মাছধরে জীবিকা নির্বাহ করতো তারা এখন কৃষি শ্রমিক ও ভ্যান চালক। নদী মরে যাওয়ার পর থেকে কৃষিকাজে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বেড়েছে। সেই পানি ব্যবহার করলে খেতে সার বেশি ব্যবহার করতে হয়, পানিতে আয়রন থাকে, তাছাড়াও ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের কারনে ফসলের উৎপাদন ব্যয়ও বেড়েছে। আবার ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও নিম্নগামী। এলাকাবাসীর মতে, তিস্তা আর বুড়ি তিস্তার উৎপত্তি স্থল এক তবে, গাইন ডোবা এলাকায় দুভাগ হয়ে পড়ে। সেখানে ১৯৫০ সালের দিকে বাঁধ দেয়ার কারণে পানি এপারে কম আসে, যা আছে তা বৃষ্টির পানি। তারপর আবার ১৯৮১ সালের দিকে হলদীবাড়িতে নতুন রাস্তা নদী পার করলে আবার পানির স্রাতে বাধাপ্রাপ্ত হয়, এই বাঁধকে স্থানীয়রা জাদুর বাঁধ বলে জানে। বুড়ি তিস্তা দেবীগঞ্জ উপজেলায় করেতোয়া নদীতে মিশেছে। করোতোয়ার অবস্থা অনুরূপ হওয়ায় সেখান থেকে কোন পানি উজানে আসছে না। তবে, বুড়ি তিস্তার আরেকটি শাখা জলঢাকার শৌলমারীতে তিস্তা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। তিস্তা বাধের কারণে সেখানেও কম পানি থাকে।

নদীর প্রবাহ স্তিমিত হওয়ার সাথে সাথে স্থানীয় জনগণের মাঝে নদী নিয়ে জানাশুনার পরিধি কম পরিলক্ষিত হয়েছে। বুড়ি তিস্তা নিয়ে সঠিক তথ্য অধিকাংশই দিতে পারেন নি। কেউ কেউ বলেছেন, তিস্তা মিশেছে করোতোয়ার, তবে বাস্তবতার সাথে মিল রেখে তথ্য বা ধারনা দিতে পারে নি। আর দীর্ঘ দিনের স্তব্ধতায় অনেক তথ্য বিলুপ্ত হয়েছে। আবার স্কুল-কলেজে নদী সম্পর্কে ক্যারিকুলাম না থাকায় শিক্ষিতরা নদীর উল্লেখ যোগ্য তথ্য রাখে না তবে পত্রিকা ও টিলিভিশনের কারণে তিস্তা চুক্তির বিষয়ে ভালই জানে।

উল্লেখ্য যে, হলদীবাড়ি জেলার মধ্য হুদুমডাঙ্গা হয়ে, ডিমলা উপজেলার পশ্চিম ছাতনাই ইউনিয়নের পূর্বপার্শ্বে তিস্তা আর পশ্চিম পার্শ্বে বুড়ি তিস্তা পবেশ করেছে। মাত্র ৫ কি.মি. অতিক্রম করেই আবার হলদীবাড়ি জেলার দক্ষিণ সামিলাবাস এর উপর দিয়ে, ডোমার উপজেলার গোমনাতি ইউনিয়নের উত্তর দিক থেকে প্রবেশ করেছে।

শুধুমাত্র বৃষ্টির পানি বহণের জন্য এই নদীটির অস্তিত্ব বিরাজমান থাকায়, কিছু দুরে দুরে এলজিইডি ব্রীজ নির্মান করেছে। শীতকালে দেখলে এই ব্রীজ তৈরীর যৌক্তিকতা নিয়ে যে কেউ প্রশ্ন করতে পারে। তবে স্থানীয় জনগণ ব্রিজের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। বর্ষাকালে এসব ব্রীজ তাদের দরকার হয়।

পানি প্রবাহ না থাকায় জনগণ খুবই উদ্বিগ্ন। তাদের দৈনদিন কাজের প্রকৃতি পাল্টেছে। উফসী জাতের আমদানীর কারণে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে উৎপাদন ব্যয়ও বেড়েছে। স্বাস্থ্য পরিচর্যার অবনতি হয়েছে অনেকখানী। খাদ্য তালিকায় পরিবর্তন এসেছে। নদীমাত্রিক দেশে পানির জন্য মূল্য দিতে হয়। বর্ষায় প্লাবণের ক্ষতির তুলনায় সবদিক বিবেচনায় তারা সারা বছর পানি প্রবাহ থাকাটা অনেক লাভজনক মনে করে। ভূগর্ভস্থ পানি প্রাপ্যতা একসময় কমে আসবে, এখানে উজানের পানি প্রবাহ নাই, শুধু বৃষ্টির উপর নির্ভরশীলতা।

পানি প্রবাহ নিশ্চিত করতে সরকারের কি কি পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ উপস্থিত লোকজনকে এমন প্রশ্ন করা হলে, উত্তর আসলো; সরকারের পক্ষে আদৌ কি সম্ভব? কখনোই না। জনগণের একাংশ বলেন, সরকার এখানে রাবার ড্যাম হোক বা স্লুইস গেট একটা নির্মাণ করলে আমরা শীতকালে কৃষির জন্য পানি পেতাম। আবার কারো কারো মতে, নদীর গভীরতা বাড়িয়ে জলাধার নির্মাণের করলে ভাল হয়।

প্রবাদ আছে, আমরা বায়ুর সমুদ্রে বসবাস করার কারণে বায়ুর অস্তিত্ব বা গুরুত্ব অনুধাবণ করতে পারি না, তেমনি মাছও অনুধাবন করে না পানির গুরুত্ব। তখন অনুধাবিত হয় যখন মাছ চলে আসে ডাঙ্গায়। আমরা কি ডাঙ্গার মাছ হওয়া অবধি অপেক্ষা করবো? নাকি, নদী মাত্রিক দেশে, নদ-নদী নিয়ে সোরগোল বা গণগবেষণা চলমান রাখতে সংশ্লিষ্টদের সচেষ্ট করবো।

(এখানে উল্লেখিত সকলতথ্য ১৯শে এপ্রিল ২০১৫ তারিখে একটি গবেষণার জন্য সংগ্রহ করা হয়েছিল)

লেখক: সদস্য সচিব, নদী অধিকার মঞ্চ

এই বিভাগের আরও খবর