লালমনিরহাট বার্তা
মা-বাবার হত্যার বিচার পেতে আইনজীবী দীপঙ্কর
পায়েল সামন্ত কলকাতা | ২৭ জুন, ২০২৩, ১:২১ PM
মা-বাবার হত্যার বিচার পেতে আইনজীবী দীপঙ্কর

মা-বাবার মৃত্যুর বিচার পাওয়ার লক্ষ্যে পুত্র নিজেই হয়েছেন আইনজীবী। কিন্তু কাকদ্বীপের এক তরুণ এখনো সুবিচারের অপেক্ষায়।২০১৮ সালের ১৪ মে। রাত পোহালেই পঞ্চায়েত নির্বাচন। দক্ষিণ ২৪ পরগনার কাকদ্বীপের তরুণ কাজ থেকে ফিরে দেখেন, তার বাড়ি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এর ভিতরে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন মা ও বাবার পুড়ে কাঠ হয়ে যাওয়া দেহ। এভাবেই মৃত্যু হয়েছিল সিপিএমের সদস্য দেবু দাস ও তার স্ত্রী ঊষারানি দাসের।

বছর ১৯-এর সেই তরুণ এখন পশ্চিমবঙ্গের গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইয়ে অন্যতম প্রতীক হয়ে উঠেছেন। পাঁচ বছর পর সেই দীপঙ্কর দাস এখন কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী। অভিভাবকদের মৃত্যুর বিচার পেতে নিজেই বেছে নিয়েছেন আইনের পেশা। দীপঙ্কর ডয়চে ভেলেকে বলেন, "প্রথম থেকেই আইন পেশার প্রতি টান ছিল। পরে যখন মা-বাবাকে হারালাম, তখন আদালতের শরণ নিতে হয়েছিল। বিচার পেতে আইনজীবী হওয়ার ইচ্ছেটা বড় হয়ে দেখা দিল।"

আবার এসেছে আর একটা পঞ্চায়েত ভোট। নির্বাচন ঘোষণার পর ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে রাজনৈতিক হিংসায়। ২৪ বছরের দীপঙ্কর পাঁচ বছর আগের স্মৃতি হাতড়াচ্ছেন। বলেন, "নির্বাচন মানেই মৃত্যু, এটা কখনো কাম্য নয়। আমার সঙ্গে যা ঘটেছে, সেটা আর ঘটুক, তা চাই না। কারো ক্ষেত্রে ঘটলে তার পাশে দাঁড়াতে চাই।"

হিংসার পরম্পরা

দীপঙ্করের এই মন্তব্যই পশ্চিমবঙ্গের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের মনের কথা। এ রাজ্যে রাজনৈতিক হিংসার অতীত কয়েক দশকের। সেই পরিস্থিতির বদল ঘটেনি আজো। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় 'বদলা নয় বদল চাই'-এর ডাক দিয়েছিলেন। ২০১১ সালে বামফ্রন্টকে হারানোর পর। কিন্তু হিংসার পরম্পরা বদলায়নি। ২০২১ সালে বিধানসভা ভোটের ফল বেরোনোর পর রাজ্য জুড়ে ব্যাপক হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছিল।

এ সবের পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্যের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার আন্দোলন জোরালো হয়েছে। তবু 'গণতন্ত্র হরণের' অভিযোগের বিরতি নেই। হাওড়ার আনিস খানের মৃত্যুতে আঙুল উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধেই। রামপুরহাটের বগটুই গ্রামের নৃশংস ঘটনা ছাপিয়ে গিয়েছে সাম্প্রতিক অতীতের সব নজিরকে।

২০১৮-র পঞ্চায়েত ভোটে বিরোধীরা ৩৪ শতাংশ আসনে মনোনয়ন দিতে পারেনি। সেই সন্ত্রাসের অভিযোগ এবারও উঠছে। পাঁচ বছর পর দীপঙ্করের মন থেকেও ভয় কি পুরো দূর হয়েছে? তরুণ আইনজীবী বলেন, "আমার মা-বাবার মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী তারা এখনো কাকদ্বীপ এলাকায় বুক ফুলিয়ে ঘুরছে। পুলিশ তাদের প্রোটেকশন দিচ্ছে। আর আমাকে নিজের এলাকা ছেড়ে কলকাতায় থাকতে হচ্ছে।"

পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকা

কাকদ্বীপের ঘটনায় পুলিশ গোড়ায় তদন্ত করছে। তাতে অনাস্থা দীপঙ্করের। বলেন, "মা-বাবা খুন হওয়ার পরও থানা আমাকে ঘুরিয়েছে। মৃতদেহ হাতে দিতে চায়নি। তাদের দেহ সৎকারের জন্য আমাকে আদালতে আবেদন জানাতে হয়েছে। আদালতের নির্দেশে চার-পাঁচ দিন পর দেহ হাতে পাই।"

জঙ্গলমহলের কৃষক শিলাদিত্য চৌধুরী থেকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র, কত মানুষকে হেনস্থার অভিযোগ উঠেছে পুলিশ-প্রশাসনের বিরুদ্ধে। অম্বিকেশের বক্তব্য, "কার্টুন মামলায় আমাকে বছরের পর বছর হয়রানি করা হয়েছে। এমন মামলা দেয়া হয়েছে, তা আমার গোচরেই ছিল না। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছি, সেই সময় চুরি-ছিনতাইয়ের মামলা দিয়ে পুলিশ আমাকে নিখোঁজ বলে দাবি করেছে!"

আনিসের রহস্যমৃত্যুতে পুলিশের বিরুদ্ধেই অভিযোগ, তাই বার বার পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী দল সম্পর্কে অনাস্থা জানিয়েছে তার পরিবার। সেই 'সিট' এখন ভরসা দীপঙ্করের। চলতি বছরের গোড়ায় কলকাতা হাইকোর্ট তার মা-বাবার হত্যার অভিযোগ সিট গঠন করেছে।

তৃণমূল মুখপাত্র, আইনজীবী বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, "অভিযুক্ত সবসময় নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করে। মিথ্যা মামলার অভিযোগ তোলে বিরোধীরা। এটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তা ছাড়া তদন্তে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করে যা আইনবিরুদ্ধ। এটা আদালতও পারে না।"

নৈতিকতার মানদণ্ডে

সুবিচারের প্রত্যাশায় থাকা দীপঙ্কর নৈতিকতার প্রশ্নও তুলছেন। তার ভাষায়, "আদালত সিট গঠন করার পর রাজ্য সরকার তার বিরুদ্ধে আবেদন জানিয়েছে। সেই আবেদনে শুনানি এখনো হয়নি। কিন্তু এতে বোঝা যাচ্ছে, দুষ্কৃতীদের আড়াল করার চেষ্টা করছে সরকার।"

সম্প্রতি পূর্ব মেদিনীপুরের এগরার বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে পুলিশ লঘু ধারায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল। তখন দুষ্কৃতীদের আড়াল করার অভিযোগই তোলে বিরোধীরা।

মুদ্রার ওপিঠে

বিজেপি, বাম, কংগ্রেস বার বার বলছে, পুলিশি তদন্তে তাদের আস্থা নেই। অনেক ক্ষেত্রে আক্রান্তের পরিবারও একই কথা বলছে। আবার সিবিআই তদন্তের ক্ষেত্রে একই ভাবে অভিযুক্ত বিজেপি। তৃণমূল বার বার প্রশ্ন তুলেছে, সারদা-নারদ মামলায় অভিযুক্ত বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে কেন তলব করে না সিবিআই-ইডি?

বিজেপি মুখপাত্র সজল ঘোষ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "নারদ মামলায় তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়, অপরূপা পোদ্দারকেও তো সিবিআই ডাকেনি। আবার দেখুন কদিন আগে কর্নাটকে বিজেপি নেতার ছেলের বাড়িতে সিবিআই হানা দিয়েছিল। গরু পাচার মামলায় বিএসএফের কমান্ডান্টকে তারাই গারদে পুরেছে। সিআইডি যদি এ ভাবে কাজ করত, তা হলে কি আদালত একের পর এক মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিত?"

কবে শেষ প্রতীক্ষা

প্রিয়জনকে হারানোর পর বিচারের জন্য অপেক্ষা ফুরোচ্ছে না কত পরিবারের। সিপিএম সাংসদ, আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য ডয়চে ভেলেকে বলেন, "পুলিশকে যদি সরকার বলে যে শাসক দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যাবে না, তা হলে কীভাবে তদন্ত এগোবে? পুলিশ নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করতে পারছে না। বিচারের জন্য অপেক্ষা দীর্ঘায়িত হবে।"

তাই আক্ষেপ ঝরে পড়ে দীপঙ্কর দাসের কথায়। বলেন, "আমি যখন বাবা-মার হত্যার বিচার চাইছি, তখন রাজ্যের উচিত ছিল আমার পাশে দাঁড়ানো। সেটা না করে তারা 'সিট'-এর বিরোধিতা করছে। একজন বিচারপ্রার্থীর প্রতি কি এটা রাজ্য সরকারের সঠিক আচরণ? (সূত্রঃ ডয়চে ভেলে)

এই বিভাগের আরও খবর