লালমনিরহাট বার্তা
৯ই আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস
শমশের আলী, বিশেষ প্রতিনিধি | ৯ আগ, ২০২৩, ৪:০৫ AM
৯ই আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস

গত ২৩ ডিসেম্বর ১৯৯৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক ৯ই আগস্টকে আদিবাসী দিবস হিসাবে ঘোষণা করে, দিবসটি পালনের জন্য সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে আহ্বান জাানানো হয়। এই দিবস উৎযাপনের মূল লক্ষ্য হলো, আদিবাসী জনগোষ্ঠির মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার, ভাষা, সংস্কৃতি, আত্ম-নিয়ন্ত্রণাধিকার সম্পর্কে সদস্যরাষ্ট্র, বৃহত্তর জনগণ ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন করে তোলা। ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতিবছর বিভিন্ন দেশে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থার পক্ষ থেকে এই দিবস পালন করা হচ্ছে। তবে, বাংলাদেশে এই দিবসটি পালিত হচ্ছে ২০০১ সাল থেকে।

বাংলাদেশের সংবিধানে আদিবাসী শব্দাটি না থাকায় সরকারীভাবে এই দিবসটি উৎযাপন করা হয় না। তবে, বাংলাদেশের সংবিধানের ২৩(ক) ধারার উল্লেখ আছে: রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।

বাংলাদেশে আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ১৬ লক্ষ; যা সমগ্র জনগোষ্ঠির প্রায় এক শতাংশ। বাংলাদেশের আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিকাংশ পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং ময়মনসিংহ অঞ্চলে বসবাস করে, তবে সিলেট, রংপুর ও রাজশাহী অঞ্চলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বসবাস করে। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হল চাকমা। এছাড়া রয়েছে গারো, মারমা, ম্রো, খেয়াং, চাক, বম, লুসাই, পাংখোয়া, ত্রিপুরা, সাঁওতাল, মনিপুরীসহ কমপক্ষে ৫০টি জাতিগোষ্ঠি। তাদের অধিকাংশেরই নিজস্ব ভাষা আছে।

দেশের আইনের মারপ্যাচ ও ভাষার পার্থেক্যের কারণে বিগত ৭০ বছরে আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মালিকানাধিন জমির অধিকাংই হাতছাড়া হয়েছে। তাদের জমি বিভিন্নভাবে জবরদখল, উচ্ছেদ ও জাতিয়াতির মাধ্যমে বিতারিত করার প্রতিবাদে এবং তা পূনরোদ্ধারসহ আত্ন-নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ ও সরকারের বিভিন্ন মহলের সাথে দেন-দরকার করে আসছে।

গতকাল বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা এএলআরডিসহ মোট ২৫টি সংগঠন একত্রে ঢাকায় সিরডাপ মিলনায়তনে এই দিবসটি পালন উপলক্ষ্যে একটি সেমিনারের আয়োজন করেছে। যার প্রতিবাদ্য বিষয় ছিল: আদিবাসীদের ভূমি ও আত্ন-নিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠায় যুব শক্তির ভূমিকা ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জনাব জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) এবং আলোচক হিসাবে দেশের বিভিন্ন প্রন্তের অভিজ্ঞ জনগোষ্ঠির প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে জনাব সন্তু লারমা বলেন যে, আজকের আলোচনার প্রধান দুইটি অংশ তার একটি হচ্ছে, আদিবাসী যুব সমাজের ভূমিকা আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এক্ষেত্রে যুব সমাজকে সর্বপ্রথমে রাষ্ট্র ও সমাজ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নিতে হবে। কারণ আদিবাসী যুব সমাজ এই রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার মধ্যেই বেড়ে উঠছে। বাংলাদেশ সমাজ ব্যবস্থা শ্রেণী বিভক্ত। বর্ণ, লিঙ্গ, অর্থনীতি, শিক্ষাসহ সকল ক্ষেত্রে বৈষম্য আছে। এটা যে শুধু বৃহত্তর জনগোষ্ঠি বাঙ্গালীদের মধ্যে আছে এমনটি নয়, এই বিভক্তি ও বৈষম্য আদিবাসী সমাজেও বিরাজমান।

শোষণ, নিপিড়ন, নির্যাতন, বৈষম্য ও শ্রেণী বিভক্ত এই রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় আদিবাসীদের ভূমি ও আত্ন-নিয়ন্ত্রণের অধিকার বিষয়টি কিভাবে গুরুত্ব পাবে? তাছাড়া এই দাবির পক্ষে ও বিপক্ষের শক্তি কি কি? তাও সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে শিখতে হবে। আদিবাসীদের মধ্যেও কেউ কেউ কোন স্বার্থের লোভে পড়ে, বিপক্ষের শক্তির সাথে মিশে নিজেদের ক্ষতি করছে। তাই, স্বপক্ষ ও প্রতিপক্ষ নিরুপন করতে না পারলে কার সাথে লড়াই হবে?

তাছাড়া, শুধু ভূমির অধিকার বা আত্ন-নিয়ন্ত্রণ শুধু ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠির বিষয় নয়। এটা সার্বজণীন ও ব্যাপক। আমাদের আন্দোলন, সার্বিকভাব সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য চিন্তা করে হতে হবে। সার্বিকভাবে সকল স্তরে বর্ণ ও লিঙ্গ বৈষম্য দুর করে কাজ করতে হবে। এই আন্দোলনের ভিত্তি হবে; নীতি ও আদর্শ। আর সে লড়াই বা সংগ্রাম! কার বিরূদ্ধে, কিসের জন্য, কোথায় করবে? তাদের অব্স্থান পরিস্কারভাবে বুঝতে হবে। সবকিছু ভালভাবে না জেনে-শুনে কিছু করা ঠিক হবে না। সঠিকভাবে আত্নপক্ষ ও প্রতিপক্ষ নির্ধারণ করতে হবে। আত্ন-পক্ষের মধ্যেও বিভেদ আছে, অনেকে প্রতিপক্ষের হয়ে কাজ করছে এবং ‍নিজস্ব জাতির উপর শোষন নিপিড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। সকল বিষয় ভালভাবে পযবেক্ষন না করে যুব সমাজ তাদের ভূমিকা কিভাবে নির্ধারণ করবে?

তিনি আরো বলেন যে, যুব সমাজকে সবকিছু বিবেচনা করে, অভিজ্ঞতার আলোকে তাদের নিজেদেরকে স্বাধিনভাবে করনীয় নির্ধারণ করতে হবে। নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য সকল ক্ষেত্রেই আছে। তাও মাথায় রাখতে হবে। তরুন, তরুনীদের মধ্যে পার্থক্য দুর করতে হবে এবং সমঅধিকার দিতে হবে।

আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের জন্য শুধুমাত্র, সভা করা, কিছু লেখা লেখি করা, মানববন্ধন করা, স্মারক লিপি দেয়া খুবই তুচ্ছ কাজ। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, সমাজকে সার্বিভাবে জানা এবং নিজেদের অবস্থান ঠিক করা।

আর রাষ্টের দায়িত্বে বিষয়ে তিনি উল্লেখ করেন যে, সবার আগে বুঝতে হবে, এটা কার রাষ্ট্র ও তার শ্রেণী অস্থান কি? আদিবাসীদের আত্ন-নিয়ন্ত্রনের বিষয়ে ৫২ বছর ধরে আলোচনা হচ্ছে। অপরদিকে দেশের সংবিধান দ্বারা জাতীয় পরিচয় যেভাবে নির্ধারন করা হয়েছে, তাতে ৫০টি অধিক ভাষার বা জাতিগোষ্ঠির অস্থিত্ব কোথায়?

১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তির মাধ্যমে আত্ন নিয়ন্ত্রনের অধিকার শিকার করা হলেও তার বাস্তবায়ন হয় নাই। ১৩ টি জাতি অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রাম এখনো অশান্ত। বর্তমান রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, আধিপত্যবাদ, সামন্তবাদ, উগ্রতাবাদ, দূর্নীতি, সন্ত্রাস ও অধিকার হনন!

বহুজাতিক ও বহু ধর্মের লোকদের একত্রে বড় একটি সংগ্রামের মাধ্যমে দেশ স্বাধিন হয়েছে। এটি একটি বহুজাতিক ও বহু শ্রেণীর রাষ্ট্র। তবে, বর্তমানে তা স্বীকার করা হয় না। রাষ্ট্র সব কিছুতে বল প্রয়োগ করে থামাতে চায়। এটা সত্যি যে, বলপ্রয়োগ ব্যাতিত কোন কিছুই হয় না। কিন্তু তা মানুষের জীবন রক্ষার জন্য, অধিকার পাওয়ার জন্য, সংস্কুতির অধিকার, সাধারণ মানুষের মানবিক ও আর্থিক উন্নয়নের জন্য বাধা। যেখানে দেশের বৃহদাংশের মধ্যেও শোষণ, বঞ্চনা, দুর্নীতির, নির্যাতনের শিকার, অধিকার থেকে বঞ্চিত। সেখানে সুষ্ঠু শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ছাড়া আদিবাসীদের অধিকার আদায় সম্ভব হবে না।

তিনি মনে করেন, রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালন হওয়া উচিত নীতি ও আদর্শের মাধ্যমে। এই পরিস্থিতিতেও, আদিবাসী যুব গোষ্ঠিকে নীতি ও আদর্শের মাধ্যমে আন্দোলন করতে হবে। তা নহলে এই আন্দোলন সফল হবে না। অতীতে অনেক আন্দোলন ব্যার্থ ও বিভ্রান্ত হতে দেখেছি। অনেক আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে! কিভাবে হয়েছে? তা বুঝার বিষয়! আর, আদিবাসী যুবগোষ্ঠিকে তাদের অবস্থান শ্রেনী ও বৈষম্যের উর্ধে গিয়ে নীতি ও আদর্শের দিকে এগিয়ে যেতে হবে এবং তা ধারণ করতে হবে। তাহলে তাদের প্রচেষ্ঠায় প্রতিপক্ষকে তাদের যৌক্তিক দাবিসমূহ বুঝাতে সক্ষম হবে। নীতি আদর্শের মাধ্যমে আন্দোলন করে সবাইকে বুঝাতে হবে। তাদের নীতি আদর্শের ভিত্তি হবে; প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠি, বঞ্চিত, সমমর্যাদা ও সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করতে হবে। আদিবাসীসহ সর্বস্তরের মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করতে হবে।

নিজেরা করি’র সমন্বয়কারী খুশি কবিরের সভাপতিত্বে ও সঞ্চালনায় উক্ত সেমিনারে আলোচক হিসাবে বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্বাবদ্যলয়ের অধ্যাপক ড. মেজবাহ্ কামাল, ড. রোবায়েত ফেরদৌস, এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, জাতীয় আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবিন্দ্রনাথ সরেন, আদিবাসী নেত্রী সারা মারান্ডি, আদিবাসী ছাত্র পরিষদের সাধারণ সম্পাদক তরুন মুন্ডা, রুলফাউ রাজশাহীর আফজাল হোসেনসহ আরো অনেকে। মূল প্রবন্ধ উপস্থান করেন: পাভেল পার্থ ও ফালগুনী ত্রিপুরা।

এই বিভাগের আরও খবর