লালমনিরহাট বার্তা
তিস্তাপাড়ে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকরা ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য শুরু করেছে নানা জাতের ফসলের চাষ
রংপুর অফিসঃ | ২০ নভে, ২০২১, ৪:০৪ AM
তিস্তাপাড়ে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকরা ঘুরে দাঁড়ানোর  জন্য শুরু করেছে নানা জাতের ফসলের চাষ
রংপুরের তিস্তাপাড়ে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকরা ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য শুরু করেছে নানা জাতের ফসলের চাষ। কারন এখানকার কৃষকদের বন্যা ও খরার সঙ্গে যুদ্ধ করে ফরাতে হয় ক্ষেতের ফসল ।এ জনপদের কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতি বারবার ধাক্কা খায় বন্যায়। এ বছরও কয়েক দফার সেই বন্যায় তা আরও বেড়েছে। এতে কৃষকের আশার গুড়ে বালি পড়েছে। গত অক্টোবরের আকস্মিক ২৪ ঘন্টার বন্যায় তিস্তা নদীর-তীরবর্তী তিন উপজেলায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। নদীভাঙনের সঙ্গে উঠতি ফসলের ওপর বালুচাপা আর কোথাও ভাঙনে ভেসে গেছে আবাদি জমি।চলতি মৌসুমে কার্তিকের শেষভাগে পানিশূন্য হয়ে পড়েছে তিস্তানদী।জলধারা বিহীন তিস্তা নদীর বুকে জেগে উঠেছে ধু-ধু বালুচর। বর্তমানে যৌবনহারা তিস্তা বালুময় বুক ফসলে সবুজ হতে শুরু করেছে। আর সেই সবুজে ফসল বুনতে শুরু করেছেন কৃষকেরা। কপালে চিন্তার ভাঁজ থাকলেও ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নতুন উদ্যমে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় ব্যস্ত সময় কাটছে তিস্তাপাড়র কৃষকদের।
তিস্তা নদী বেষ্টিত গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার ক্ষতি গ্রস্থ প্রায় ১০ হাজার কৃষককে প্রণোদনার আওতায় এনেছে সরকার। তিন উপজেলায় এবারের বন্যায় ২ হাজার ৫০৫ হেক্টর জমির রোপা আমন, ৩৫ হেক্টর জমির কাঁচামরিচ, ৬২ হেক্টর জমির চিনা বাদাম পানিতে নিমজ্জিত হয়েছিল। এতে ৩৪৫ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে ৩২৯ হেক্টর জমির আমন, মরিচ ৩০ হেক্টর, চিনা বাদাম ৬০ ও শাকসবজি ২৬ হেক্টর রয়েছে। এ ছাড়া নষ্ট হয়েছে বেশ কিছু আলুখেত।
রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার চর ইচলী, চল্লিশসাল, মর্ণেয়া, বিনবিনা, গজঘন্টা এবং পীরগাছা উপজেলার শিবদেব, ছাওলা ও গাবুড়া চর, কাউনিয়ার ,হারাগাছ,নাজিরদহ,গোপিডাঙ্গা,গদাই,নিজপাড়া,গনাই,হায়বৎখাঁ, টাবুর চর সহ বিভিন্ন ক্ষতি গ্রস্থ এলাকায় দেখা গেছে, তিস্তা নদীর আকস্মিক বন্যার পর পানি নামার ক্ষতচিহ্ন ভেসে উঠেছে। আশপাশে এখনো পড়ে আছে বিধ্বস্থ বাড়ি-ঘর। তিস্তানদীর বন্যার তোড়ে আসা বালুতে চাপা পড়ে আছে কৃষকের ফসলি ক্ষেত। কৃষকরা কাঁচি ও কোদাল দিয়ে সেই বালু সরানোর চেষ্টা করছেন। পানি সরে যাওয়ার পর কিছু ফসলে পচন দেখা দিয়েছে। আবার কোথাও কোথাও শীতকালীন সবজির ক্ষেত সহ মিষ্টিকুমড়া, আগাম আলু সহ নতুন করে ফসল রোপণ করছেন কিষান কৃষানিরা।
তিস্তা পাড়ের কৃষকরা বলছেন, বালুচর এখন তাদের জন্য আশীর্বাদ। এই চরের বালু মাটিতেই ফলবে সোনার ফসল। ঘুরে যাবে করোনা আর বন্যায় ক্ষতি গ্রস্থ মানুষের ভাগ্যের চাকা।কাউনিয়ার চরহয়বৎখাঁ এলাকার সবজি ক্ষেত পরিচর্যায় ব্যস্ত ছখিনা বেগম বলেন, চরের মধ্যে আলু, কুমড়া, ভুট্টা রোপন করছি। আলু তোলার পর বাদাম লাগাবো। পানি না থাকাতে কষ্ট আছে। কিন্তু বালুমাটিতে কোনো রকমে চাষাবাদ শুরু করা লাগে। তা ছাড়া আমাদের মতো গরিবের আর কোনো উপায় নেই। অসময়ে তিস্তার আকস্মিক বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ আরও কয়েক গুণ বেশী। তাদের ধান, আলু, সবজি, বাদামসহ বিভিন্ন ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এতে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতি গ্রস্থ হয়েছেন। মানুষের কাছে ধারনেয়া টাকার দেনায় পড়েছেন। তার পরেও আবার নতুন করে চাষাবাদ শুরু করেছেন।
গঙ্গাচড়ার চর ইচলীর কৃষক মজিদ মিয়া বলেন, ভালো বীজ পাওয়া যায় না। এ্যলা বীজের সমস্যা বাহে। ইয়ার পরেও মিষ্টিকুমড়া নাগানো দুই একর মাটিত(জমিতে)। বর্তমানে সারের দাম বাড়ছে। বর্তমানে সারের বস্তাতে দেড়-দুই ‘শ টাকা বেশি লাগে। সরকার যদি এটা নিয়ন্ত্রণ করে, তাহলে হামারগুল্যার আবাদ সুবাদ করতে সুবিধা হইবে। চরের বুকোত এ্যলা যত আবাদ দেখোছেন, সোগে অভাবী মানুষেরা করছে। এই আবাদের ফসল ব্যাচে (বিক্রিকরে) হামাক সংসার চলা লাগবে।নদীর চরে পানি না থাকায় এখন ধান কাটায় ব্যস্ত লক্ষীটারি ইউনিয়নের পূর্ব ইচলী গ্রামের মোহসীন আলী। হাঁটতে হাঁটতে ধানের জমির পানে চেয়ে তার চোখ বেয়ে পানি ঝরছিল। তার বিস্তৃর্ণ ধানের জমি কাদা, বালু আর পলিতে চাপা পড়েছে। যেন কোমল ধানের শীষগুলোয় চাপা না পড়ে মোহসীন আলীর বুকেই চেপে বসে আছে।
একই ইউনিয়নের কেল্লারহাট গ্রামের কৃষক নাছিমুদ্দী বকস বলেন, হামার আবাদি জমি সোগ তলে গেচলো। আলু, শাকসবজি,মরিচ, কুমড়ার খেত পঁচি গেইছে। অসময়ে বানোত হামার মেলা ক্ষতি হইলে কিন্তু কায়ো হামার পাকে তাকায় না। কৃষি অফিস থাকি নাম লেখি নিয়্যা গেইছে।
পীরগাছা উপজেলার ছাওলা গাবুড়া চরের কৃষক হযরত আলী জানান, বাজারে আগাম মরিচ বিক্রি করে লাভের আশা করেছিলেন তিনি। কিন্তু তিস্তার আকস্মিক বন্যায় তার সেই আশা শেষ হয়ে গেছে। হতাশ হযরত আলী আবার নতুন উদ্যমে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন।
কাউনিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাহানাজ পারভিন বলেন, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার চরাঞ্চলে ফসলের আবাদ ভালো হয়েছিল। আকস্মিক বন্যায় কৃষকরা ক্ষতি গ্রস্থ হয়েছেন। সাধারণত এ সময় বন্যা হয় না। তবে এখন কৃষকরা আবার ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করছেন। তাদের কৃষি অধিদফতর থেকে নানা পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক ওবায়দুর রহমান মন্ডল জানান, রংপুরে রবি মৌসুমে ছয়টি ফসলের যে কোনো একটির জন্য ৩৫ হাজার কৃষককে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে বন্যায় ক্ষতি গ্রস্থ গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার প্রায় ১০ হাজার কৃষক এই প্রণোদনার আওতায় আনাহয়েছে। ক্ষতি গ্রস্থ কৃষকদের বিভিন্ন ফসলের সার ও বীজ দেয়া হচ্ছে।
এই বিভাগের আরও খবর