লালমনিরহাট বার্তা
রংপুরে মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক ২৮ মার্চ স্মরণে নিসবেতগঞ্জে রক্ত গৌরব স্মৃতি স্মারক
রংপুর অফিস | ২৮ মার্চ, ২০২৩, ১০:৫২ AM
রংপুরে মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক ২৮ মার্চ স্মরণে নিসবেতগঞ্জে রক্ত গৌরব স্মৃতি স্মারক

রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও দিবস আজ ২৮ মার্চ। এই দিনটি রংপুরের মানুষের জন্য স্মরণীয় ও বীরত্ব গাঁথা। মহান মুক্তিযুদ্ধে এই দিনে বাঁশের লাঠি, তীর-ধনুক, দা-কুড়াল, বল্লম নিয়ে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে অকুতোভয় বীর বাঙালি।সেদিন রংপুর বাসী এক অনন্য ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিল ।

জেলা প্রশাসনের আয়োজনে ২৮ মার্চ সকালে রংপুরের ঐতিহাসিক ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও দিবস উপলক্ষে শহিদদের স্মৃতির প্রতি "রক্ত গৌরব" স্মৃতি স্তম্ভে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়েছে।বিভাগীয় প্রশাসনের পক্ষে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন মোঃ আবু জাফর, অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক), রংপুর।জেলা প্রশাসন এবং বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, রংপুর জেলা ইউনিট কমান্ডের পক্ষে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন জেলা প্রশাসক ড. চিত্রলেখা নাজনীন।এরপর জনপ্রতিনিধিগণ, বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি দপ্তরের প্রতিনিধি, রাজনৈতিক সংগঠন, সাংবাদিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন শ্রদ্ধা জানান। পরে শহিদের আত্মার মাফেরাত কামনা করে দোয়াকরা হয়।

রংপুরের ঐতিহাসিক ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও দিবস পালন করা হলেও দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫২ বছর পার হলেও এখনো জাতীয় ভাবে সেদিনের স্বীকৃতি মেলেনি।বাঁশের লাঠি, তীর-ধনুক, দা-কুড়াল, বল্লম নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করার নজির বিশ্বে আর কোনো দেশে নেই। এটি ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সাহসিকতার এক বিরল ঘটনা।১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ আনুষ্ঠানিক ভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মাত্র একদিন পরই স্বাধীনতার জন্য মুখিয়ে থাকা রংপুর বাসী পাকিস্তানি বাহিনীর ঘাঁটি ‘ক্যান্টনমেন্ট’ ঘেরাও করে। সেই দিনের বীরত্বগাঁথা, সাহস আর আত্মত্যাগের অনুপ্রেরণা সূচিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র সংগ্রাম।

রংপুরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠীর শাসন, শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছিল। ৩ মার্চ রংপুরে মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন কিশোর শংকু সমজদার। স্বাধীনতার গণআন্দোলন সংগ্রামের প্রথম ‘শহীদ’ বলা হয় শংকু সমজদারকে। ২৪ মার্চ নিসবেতগঞ্জ এলাকাতে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি জিপ গাড়িতে হামলা করে অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে আব্বাসী নামে সেনা সদস্যকে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে স্থানীয় শাহেদ আলী নামে এক কসাই। এ নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে গোটা শহরে। বাড়তে থাকে মহড়া পাকিস্তানী সেনাদের প্রতিশোধের ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর দেশের মানুষ প্রস্তুতি গ্রহণ করে সশস্ত্র সংগ্রামের। এরই অংশ হিসেবে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও এর ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে রংপুরের স্বাধীনতাকামী মানুষ। দিনক্ষণ ঠিক হয় ২৮ মার্চ। ঘেরাও অভিযানে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বিভিন্ন হাট-বাজারে ঢোল পেটানো হয়। এ আহ্বানে অভূতপূর্ব সাড়া মেলে। পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার সাজ সাজ রব পড়ে যায় চারিদিকে।যার যা আছে তাই নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের জন্য প্রস্ততি নেয় ছাত্র, কৃষক, দিনমজুর,ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেনীর সংগ্রামী মানুষ।আদিবাসীরা তীর-ধনুক নিয়ে প্রস্তুতি নেয়। মিঠাপুকুর উপজেলার ওরাঁও সম্প্রদায়ের তীরন্দাজ সাঁওতালদের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। তীর-ধনুক, বল্লম, দা, বর্শা নিয়ে তারা যোগ দিয়েছিল ঘেরাও ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণে।

রোববার ২৮মার্চ ১৯৭১ সাল সকাল থেকে রংপুরের বিভিন্ন এলাকার মানুষ সংগঠিত হতে থাকে। বেলা ১১টা বাজতে না বাজতেই সাজ সাজ রব পড়ে যায় চারিদিকে। জেলার মিঠাপুকুর, বলদিপুকুর, ভূরারঘাট মানজাই, রানীপুকুর, তামপাট, পালিচড়া, বুড়িরহাট, গঙ্গাচড়া, শ্যামপুর, দমদমা, লালবাগ, গনেশপুর, দামোদরপুর, পাগলাপীর, সাহেবগঞ্জ সহ বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষ একত্রিত হতে থাকে। সবার হাতে লাঠি-সোটা, তীর-ধনুক, বর্শা, বল্লম, দা ও কুড়াল।

রংপুর ক্যান্টনমেন্টে কর্মরত ২৯ ক্যাভেলরী রেজিমেন্টের মেজর নাসির উদ্দিন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী।সে সময় তার ‘যুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধীনতা’ গ্রন্থে সে দিনের বর্ণনায় লিখেছেন, ‘যে দৃশ্য আমি দেখলাম তা চমকে যাওয়ার মতোই। দক্ষিণ দিক থেকে হাজার হাজার মানুষ সারি বেধে এগিয়ে আসছে সেনা ছাউনির দিকে। তাদের প্রত্যেকের হাতেই দা-কাঁচি, তীর-ধনুক, বর্শা, বল্লমের মতো অতি সাধারণ অস্ত্র। বেশ বোঝা যাচ্ছিল এরা সবাই স্থানীয়। সারি বাধা মানুষ পিঁপড়ার মতো লাঠি-সোঠা বল্লম হাতে ক্রমেই এগিয়ে আসছে ক্যান্টনমেন্টের দিকে। এ সময় ক্যান্টনমেন্ট থেকে গোটা দশেক জিপ বেরিয়ে আসে এবং মিছিল লক্ষ্য করে শুরু হয় একটানা মেশিনগানের গুলি বর্ষণ। মাত্র ৫ মিনিটে চারিদিক নিস্তব্ধ হয়ে যায়। হাজার হাজার মরদেহ পড়ে থাকে মাঠে।গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মাঠের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা মানুষ গুলোকে টেনে হিঁচড়ে এনে এক জায়গায় জড়ো করা হলো পুড়িয়ে ফেলার জন্য। কিন্তু তখনো যারা বেঁচে ছিল তাদের গোঙ্গানিতে বিরক্ত হয়ে উঠেছিল পাঞ্জাবি জান্তারা।এ অবস্থাকে আয়ত্তে আনার জন্য বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে চিরতরে তাদের থামিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে উঠল।আহতদের আর্তনাদে গোটা এলাকার আকাশ বাতাস যেন ভারি হয়ে উঠল। সেদিন সন্ধ্যার আগেই নির্দেশ মতো ৫ থেকে ৬শ মরদেহ পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। এ আগুন অন্য যে কোনো আগুনের চেয়ে অনেক বেশি লাল। অনেক বেশি দহন করে এই বহিঃশিখা।খুব কাছ থেকেই সেই আগুন আমি দেখছি। দেখছি কেমন করে জ্বলছে স্বাধীনতাপ্রিয় অসহায় মানব সন্তান।

রংপুরের ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণে অংশ নেয়া একুশে পদক প্রাপ্ত ভাষাসৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মজিবর রহমান মাস্টার বলেন, বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো, জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু এই তিনটি ¯েøাগানকে বুকে ধারণ করে ২৮ মার্চ হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষকে সাথে নিয়ে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করতে গিয়েছিলাম। সে সময় পাক হানাদারের গুলিতে অসংখ্য বাঙালি শহীদ হন।

এই বিভাগের আরও খবর