রংপুর বিভাগের নিজস্ব শব্দ ভাণ্ডারকে বৌদ্ধিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণ, রংপুর বিভাগের ব্যবহৃত দেশীয় বা আঞ্চলিক শব্দ-পরিচিতি এবং এর বিচিত্র ব্যবহার সম্পর্কে ধারণা প্রদান, সর্বোপরি বাংলাদেশের বৈচিত্র্যময় ও রূপান্তরিত আঞ্চলিক ভাষা ও সাহিত্যের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও মর্মার্থ উপলব্ধিতে সহায়ক জ্ঞানাধার নির্মাণের লক্ষ্যে কাজ করছেন লালমনিরহাট জেলার কৃতী সন্তান অধ্যাপক ড. হাবিব-উল-মাওলা; যিনি সাহিত্য-শিল্প-গবেষণা ও শিক্ষাঙ্গনে মাওলা প্রিন্স নামেই অধিক পরিচিত। তিনি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ও সম্প্রসারণ দপ্তরে 'রংপুর বিভাগের আঞ্চলিক শব্দসংগ্রহ' শীর্ষক একটি গবেষণা-প্রকল্প প্রস্তাবনা দাখিল করলে তা ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে মঞ্জুর হয়। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি মাঠ সমীক্ষণের মাধ্যমে রংপুর বিভাগের আঞ্চলিক শব্দ সংগ্রহ করে তৈরি করছেন রংপুরী উপভাষার অভিধান।
গত ২৬ জুলাই দুপুর ২টায় নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন কনফারেন্স কক্ষে গবেষক ও প্রকল্প-পরিচালক মাওলা প্রিন্স 'রংপুর বিভাগের আঞ্চলিক শব্দসংগ্রহ' প্রকল্পের ওপর সেমিনার উপস্থাপন করেন। এসময় তিনি উপস্থিতিদের বিভিন্ন প্রশ্নেরও উত্তর দেন। উক্ত সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য রাখেন নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. আহমেদুল বারী।সভাপতিত্ব করেন কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মুশাররাত শবনম। সেমিনারে প্রকল্প-মূল্যানকারী ও আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. অনিরুদ্ধ কাহালি। কলা অনুষদ আয়োজিত বার্ষিক গবেষণা-প্রকল্প বিষয়ক উদ্বোধনী অনুষ্ঠান-পর্বে সভাপতি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. সৌমিত্র শেখর দে এবং প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সম্মানিত সদস্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর। বিশেষ অতিথি হিসেবে বিভিন্ন অনুষদের ডিনগণ উপস্থিত ছিলেন।
ধ্বনি ও উচ্চারণ ভেদে রংপুর বিভাগের আনুমানিক ২৫,০০০ শব্দ সংগ্রহের তথ্য দেন মাওলা প্রিন্স। তিনি বলেন, উত্তরবঙ্গের সর্ববৃহৎ লোকসাংস্কৃতিক জনপদ হলো বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চল তথা রংপুর বিভাগ। এখানকার মানুষের জীবন-জীবিকা, প্রকৃতি ও ভূগোল অনুযায়ী সৃষ্ট ভাষাকে বলা হয়ে থাকে 'রংপুরী'। ইন্দো-আর্য পরিবারভুক্ত রংপুরী ভাষা রংপুর-দিনাজপুরে 'অম্পুরিয়া' নামে পরিচিত। স্থানীয়রা 'র' ধ্বনিকে 'অ' ধ্বনি উচ্চারণ করার কারণে এমনটি ঘটেছে বা ঘটে থাকে। বাংলা ভাষার অন্যতম আঞ্চলিক ভাষা 'রংপুরী' বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালে কামতাপুরী, রাজবংশী, কোচ-রাজবংশী, গোয়ালপাড়িয়া, সূর্যপুরী বা সূরজাপূরী, তাজপুরী ইত্যাদি নামেও কম-বেশি পরিচিত। ধ্বনি ও শব্দগত সামান্য পার্থক্য থাকলেও এসব মূলত একই ভাষা বা উপভাষা বা লোকভাষা। প্রমিত বাংলা ভাষারীতির উৎস নদিয়া জেলা ভিত্তিক পশ্চিমবঙ্গ হওয়ায় মূল ভাষার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত রংপুর বিভাগের রংপুরী বা অম্পুরিয়া আঞ্চলিক ভাষার পার্থক্য ও স্বাতন্ত্র্য সহজেই লক্ষণীয়।
সেমিনারে প্রকল্প-মূল্যায়নকারী ও আলোচক অধ্যাপক ড. অনিরুদ্ধ কাহালি 'রংপুর বিভাগের আঞ্চলিক শব্দসংগ্রহ' প্রকল্পটির ব্যাপারে বিশেষ সন্তুষ্টি ও উচ্চাশা ব্যক্ত করেন। তার মতে, মাওলা প্রিন্সের এই প্রকল্প শুধু নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় নয়, জাতীয় পর্যায়ে প্রশংসিত হওয়ার মতো। প্রকল্পটি সম্পন্নের পর এর গ্রন্থরূপ প্রকাশ করলে দেশ-জাতি ও সাহিত্য-সংস্কৃতির জন্য তা হবে অনেক বড় কাজ। এজন্য গবেষক ও তথ্যসংগ্রাহকদের আঞ্চলিক শব্দ গ্রহণ ও বর্জনে সতর্ক থাকতে হবে।
লেখক, গবেষক ও অধ্যাপক ড. হাবিব-উল-মাওলা ওরফে মাওলা প্রিন্স লালমনিরহাট সদর উপজেলার নায়েকগড় হারাটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা-শামসুল হক বাবুল ও মাতা- হাছনা আরা দীপালি। তিনি চার্চ অব গড উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৯৭ সালে বিজ্ঞান শাখায় এসএসসি এবং লালমনিরহাট সরকারি কলেজ থেকে ১৯৯৯ সালে বাণিজ্য শাখায় এইচএসসি সম্পন্ন করেন। উভয় পরীক্ষায় তিনি প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে স্নাতক ও প্রথম শ্রেণিতে স্নাতকোত্তর সম্পন্নের পর তিনি ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালে অবস্থিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে ২০০৮ সালের ১ এপ্রিল প্রভাষক পদে যোগদান করেন। নজরুল ও জীবনানন্দের কবিতায় পুরাণ ও চিত্রকল্প' শীর্ষক অভিসন্দর্ভ রচনার জন্য তিনি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেন ২০১৬ সালে। 'রংপুর বিভাগের আঞ্চলিক শব্দসংগ্রহ' প্রকল্পের পূর্বে মাওলা প্রিন্স 'ময়মনসিংহ বিভাগের আঞ্চলিক শব্দসংগ্রহ' প্রকল্প সম্পন্ন করেছেন। 'বেঁচে থাকাই যুদ্ধ এবং শান্তি' (২০২২) তার মহাকাব্যিক উপন্যাস; যেখানে উত্তরবঙ্গের মানুষের ভাষা-সংস্কৃতির রূপায়ণ ঘটেছে নান্দনিকভাবে।