লালমনিরহাট বার্তা
পরিবেশ ও জলবায়ু ব্যবস্থাপনা
শমশের আলী | ৩ সেপ, ২০২৪, ১২:০৬ PM
পরিবেশ ও জলবায়ু ব্যবস্থাপনা

মানবদেহ ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা তথা মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রাকৃতিক পরিবেশের অন্যতম ভূমিকা রায়েছে। মানব সভ্যতার সবকিছুই প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে সম্পর্কযুক্ত। সারা বছরের প্রকৃতির ভিন্ন ভিন্ন অবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের ষড়ঋতুর দেশ। এই ঋতুর সাথে সম্পর্ক আছে: কৃষি, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, অর্থনীতি, বিনোদন, সামাজির ও ধর্মীয় আচারসহ এই এলাকার সমগ্র জীবন-যাপন ব্যবস্থা। সম্প্রতি আমাদের দেশের কোথাও কোথাও অধিক বৃষ্টিপাতের ফলে অনাকাঙ্খিত বন্যা বা দীর্ঘ মেয়াদি প্লাবণ বয়ে যাচ্ছে।

নদীভাঙ্গনের তীব্রতা বৃদ্ধির ফলে জমি হারা পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোন কোন নগরীতে বর্ষায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। এই বছরে গ্রীষ্মের তাপদাহ এতটাই বেশি ও দীর্ঘ মেয়াদে ছিল, যা সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকাটা কঠিন হয়ে পড়েছিল। এই তাপদাহের প্রভাবে এবারের ফসলের বেশ ক্ষতি হয়েছে। আম ও লিচু চাষিরা তা জানান দিয়েছেন। মৎস্য ও প্রাণী সম্পদের উপর কি ধরনের প্রভাব পড়েছে, তা এখনো পুরোপুরি অনুমান করা যায় নি। সিলেট বিভাগে এবারের বন্যা ২০২২ সালের তুলনায় কতটা ক্ষতি করবে তা এখনো নিরিক্ষণ ও মূল্যায়নের সময় হয় নি বটে। তাছাড়া, সমুদ্রের পানি বৃদ্ধির প্রভাবে আমাদের দেশের কি ধরনের বা কতটা ক্ষতি হতে পারে, এখনো পরিসংখ্যাণ পরিস্কারভাবে বলা না গেলেও, ক্ষতির ঝুঁকিতে অবশ্যই আছি তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

পরিবেশ হচ্ছে ৫টি প্রাকৃতিক উপাদান বা প্রকৃতিক সম্পদের সমন্বয় যথা:

(ক) জমি, (খ) জলা, (গ) আলো ও তাপ, (ঘ) বায়ুমন্ডল এবং (ঙ) বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণ ও জীব বৈচিত্র।

পরিবেশের ৫টি উপাদানের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষনের উপর জলবায়ুর স্থায়িত্বশীলতা নির্ভর করে। কোন একটি উপাদানের ব্যবস্থাপনার তারতম্যের কারণে উক্ত এলাকা বা পৃথিবীর জলবায়ুর স্থায়িত্বশীলতা নষ্ট হতে পারে। আর, জলবায়ু হচ্ছে আবহাওয়ার গড় বা সামগ্রিক অবস্থার একটি হিসাব। যার মধ্যে আছে; বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রার তারতম্য, আদ্রতা, বায়ু প্রবাহ, বায়ুর চাপ, সামুদ্রিক ও ভূউপরিভাগের নিম্নচাপ ও ঝড়। যদিও তাপদাহ ও বৃষ্টির সময় বা মাত্রার তারতম্য ব্যাতিত অন্যান্য ঘটনা বা দূর্যোগ সমুহ সম্পূর্ণভাবে জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ি করা যায় না। অনেক ক্ষেত্রে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও কাঠামোগত উন্নয়নের অযুহাতে পরিবেশ ও প্রতিবেশ বিনষ্টকারী কিছু উদ্যোগের ফলে জলপ্রবাহে বা নদী প্রবাহে বাধা সৃষ্টিসহ মাটি, পানি ও বায়ু দুষণ হয়ে থাকে। যা প্রকৃতি ও জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হয়। যেমন: পানি প্রবাহের সক্ষমতা বিবেচনা না করে ভেরি বাঁধ তৈরী করা বা প্লাবণভূমি সাথে নদীর সম্পর্ক স্থাপনকারী খাল সমূহ বন্ধ করে দেওয়া। বৃষ্টির পানি ধারন বা পানি নিস্কাশন ব্যবস্থায় বাধা তৈরী করা। পরিবেশ বান্ধব শিল্প-কারখানা বন্ধ করে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর শিল্প কারখানার প্রসার ঘটানো। তিন ফসলী কৃষিজমিতে নগরায়ন বা শিল্পায়ন করা। বন ধ্বংশ করা ইত্যাদি। তবে, বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য আমাদের দেশ অতটা দায়ি নয়।

উন্নত দেশ সমূহে ১৭৫৭ সাল থেকে শিল্প বিপ্লবের দোহাই দিয়ে, যত সংখ্যক কার্বন-ডাই- অক্সাইড নিঃসরনকারী শিল্প কারখানা স্থাপন করেছে এবং বিভিন্ন দেশকে শিল্প স্থাপনে সহায়তা করেছে, তার সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। শিল্প বিপ্লবের পর থেকে দিনে দিনে সারা বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং জলবায়ুর এই মারাত্নক রূপ ধারন করেছে। অষ্টাদশ শতকে অতটা বুঝা না গেলেও! একবিংশ শতাব্দীতে এটি একটি ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করেছে।। যা মানুষসহ সকল প্রাণী ও উদ্ভিদজগতে সহনশীলতার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। এই বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে, প্রথমত: গ্রীষ্মকালে তাপদাহ অনেক বৃদ্ধি পেয়ে অসহনীয় পরিস্থিতির উদ্রেক হয়েছে। দ্বিতীয়ত: বর্ষার ব্যাপ্তিকাল ও গড় বৃষ্টিপাতের তারতম্যের ফলে, প্লাবনের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। তৃতীয়ত: সামদ্রিক ঝড়ের পুনরাবৃত্তির হার ও তীব্রতা বেড়েছে। বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন শুরু হয় ১৯৯৫ সাল থেকে। উক্ত সম্মেলনে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় হচ্ছে; কার্বন নিঃসরণ কমাতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানীর প্রসার ঘটানো। তবে, কার্বন নিঃসরণ কমাতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর পাশাপাশি সামগ্রিক পরিবেশ ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষনের উপর জোর দেওয়া জরুরি। যেমন বনভূমি ও কৃষিজমি উজার করে বিভিন্ন প্রকারের কল-কারখানা ও নগর স্থাপনসহ প্লাষ্টিকের ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে অক্সিজেনের ঘাটতি ও কার্বন নিঃসরণ বৃদ্ধি ঘটে। কার্বন নিঃসরণ কমাতে গাছ বা বনভূমির সংরক্ষণ, রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার রোধসহ, জমি ও জলাভূমির ক্ষতি হতে পারে এমন দ্রব্যের ব্যবহার রোধসহ ক্ষতিকর সকল কর্মকান্ড বন্ধ করতে হবে। বাংলাদেশে পরিবেশ বান্ধব শিল্প যেমন, পাট, চিনি, সুতাও রেশম শিল্পের বিকাশ ঘটেছে অষ্টদশ শতাব্দিতে। আর কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরন শিল্প কারখানার বিকাশ লাভ করেছে বিংশ শতকে। যদিও কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরনের মাত্রা এখনো উন্নত দেশের তুলনায় অনেক কম। কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরনের তালিকায় বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ৩৯ নম্বরে এবং ১৯৭০ সালে ছিল ১০৪ নম্বরে। বাংলাদেশের এই অবস্থান পরিবর্তনের জন্য যেসব দেশ প্রযুক্তি বা ঋণ দিয়ে সহায়তা দিয়েছে, তারাই দায়ী হবে। ২০০৯ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক আয়োজিত ১৫তম জলবায়ু সম্মেলনে গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ড গঠিত হয়। এই তহবিল ক্ষতিগ্রস্থ্য দেশের মানুষের অভিযোজন ও কার্বন- ডাই-অক্সাইড কমাতে বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যবহৃত করার লক্ষ্যে গঠিত হয়। যেসব দেশ জলবায়ুর বিরূপ পরিবর্তনের জন্য দায়ি তাদের থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করে ক্ষতিগ্রস্থ দেশসমূহকে প্রদানের সিদ্ধান্ত থাকলেও তা আজো কার্যকর হয়নি। বরং সেই তহবিলের বরাতে ভিন্ন কৌশল বাস্তবায়িত হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরনে বাংলাদেশের সরাসরি অতটা ভূমিকা না থাকলেও, নিজস্ব ভূখন্ডের জমি, জলা ও বায়ু দুষণে যথেষ্ঠ ভূমিকা আছে। যা সহজেই রোধ করা সম্ভব ছিল। যেমন: কারখানার ও নগরীর বৈর্জ্য দিয়ে নদী ও জলাধার দুষণ, জলাধার ভরাট ও দখল, ইটভাটা, পলিথিনের দুষণ, গাড়ির কালো ধোঁয়া, কৃষিজমিতে কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহার, তিন ফসলী জমি নষ্ট করে নগরায়ন ও শিল্পায়ন করা, হাসপাতাল ও ঔষধ শিল্পের বৈর্জ্য দ্বারা মাটি ও পানি দুষণ, অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে কারেন্ট জালের ব্যবহার ইত্যাদি। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন প্রকারের দূষণের ফলে; মাটি বায়ু ও পানির দুষণ এতটাই মারাত্নক যে, খাদ্য বা আহারে রাসায়নিক তেজস্ক্রিয়তার মাত্রার আধিক্যের পাশাপাশি শ্বাস প্রশ্বাসে দূষিত বায়ু প্রবেশ করছে। ফলে, ক্যান্সারসহ বিভিন্ন প্রকারের দুরারোগ্য ও মরণঘাতী ব্যাধির প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা চিকিৎসা ব্যায়ের পাশাপাশি মানবজীবনে নতুন নতুন ভোগন্তির সৃষ্টি করছে।

সারা বিশ্বের সকল শিল্প-কারখানাকে পরিবেশ-প্রতিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব বিবেচনায় প্রধানত: চারটি শ্রেনীতে ভাগ করা হয়। (১) লাল, (২) কমলা, (৩) সাদা ও (৪) সবুজ। পরিবেশ-প্রতিবেশের উপর সর্বাধিক নেতিবাচক প্রভাব বিস্তারকারী শিল্প-কারখানাকে লাল শ্রেনীভূক্ত করা হয়েছে! যেমন; কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রাসায়নিক অস্ত্র কারখানা, কোকাকোলা প্রস্তুত কারখানা ইত্যাদি। আর সবচেয়ে কম বা শুন্য মাত্রার নেতিবাচক প্রভাব বিস্তারকারী শিল্প-কারখানাকে সবুজ শ্রেনীভূক্ত করা হয়েছে। যেমন; পাট ও আখ শিল্প, চাল-ডালের মিল, তাঁত, অক্সিজেন তৈরীর কারখানা, ইত্যাদি। তবে, লাল ও কমলা শ্রেনীভূক্ত শিল্প-কারখানা স্থাপন করা হলে, তা কিভাবে একটি দেশের উন্নয়নের মানদন্ড হিসাবে বিবেচিত হয়! সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হয়ে পড়েছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে; লাল ও কমলা শ্রেনীভুক্ত শিল্প-কারখানা কি মানবজাতির উন্নয়ন নাকি অধঃপতন  তথাকথিত এই উন্নয়ন; কখনো কখনো বেশি লাভের আশায় নিজের বা জাতির কিডনি বেচে দেওয়ার সাথে তুলনা করা যায়। পরিবেশের বিপর্যয়ের কারণ হিসাবে বলা যায় যে, গত তিন দশকে ঢাকা জেলার প্রায় ৬০ শতাংশ জলাভূমিসহ সারাদেশে শতাধিক নদ-নদী ও জলাভূমি বিলুপ্ত হয়েছে। উপরন্তু, সকল প্রকারের শিল্প-কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য সরাসরি নদী, খাল, বায়ুমন্ডল ও মাটিতে মিশে যাওয়ার ফলে মানুষসহ সকল প্রানী ও উদ্ভিদের মধ্যে বিষক্রিয়ার কারণে স্বাস্থ্যহানী, চিকিৎসা ব্যায় ও জনভোগান্তি বেড়েছে। তাছাড়া, বাংলাদেশে দেশিয় মাছের প্রায় ১০০ টি মাছের প্রজাতি বিলুপ্ত প্রায়। দেশিয় জাতের অনেক পশু-পাখিও আজ বিপন্ন হতে চলেছে। পরিবেশ কর্মীদের দীর্ঘদিনের দাবির পরেও সকল ক্ষেত্রে ইটিপি (বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ স্থাপনা বা বর্জ্য শোধনাগার) স্থাপন বা সচল হয়নি। আবার, লাল ও কমলা ধরনের শিল্প-কারখানর জন্য পরিবেশ-করও আরোপ করা হয়নি। তাছাড়াও জনবহূল ও ক্ষুদ্রায়তনের এই দেশে আর কত শিল্প-কারখানার বর্জ্য ও দুষনের চাপ বইতে হবে? পরিবেশ সুরক্ষার ক্ষেত্রে এটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। এখনই বন ও গাছকাটা বন্ধ করতে হবে, তার সাথে আন্তর্জাতিক নদীর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার স্বার্থে জাতিসংঘ প্রনীত পানি প্রবাহ আইনে অনুস্বাক্ষর ও পালন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখনই পরিবেশের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না পারলে এই বিশ্ব সবার জন্যই বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে।

লেখক: শমশের আলী, সদস্য সচিব, নদী অধিকার মঞ্চ।

এই বিভাগের আরও খবর