লালমনিরহাট বার্তা
নদ-নদী ব্যবস্থাপনার অভিভাবক
শমশের আলী, বিশেষ প্রতিনিধি | ১৩ আগ, ২০২৩, ১১:১৭ AM
নদ-নদী ব্যবস্থাপনার অভিভাবক

নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদ-নদীর সংখ্যা নিয়ে তারতম্য যাহাই থাকুক না কেন, এই সংখ্যা নেহায়েত কম নয়, তাও প্রায় ৮০০ টি। এই নদ-নদী সমূহ দেশের অনন্য প্রাকৃতিক সম্পদ, যা দেশের মানুষের জীবন-যাত্রা, জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ, জনস্বাস্থ্য, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, মৎস্য সম্পদ, কৃষি, পশু-পাখির সমৃদ্ধি, ও যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ সার্বিক ব্যাবস্থাপনায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। তাছাড়া আমাদের দেশের অধিকাংশ নদ-নদী মিষ্টি পানির আধার হওয়ায়, উপকূল অঞ্চলের লবনাক্ততা বৃদ্ধি রোধ ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ঠিক রাখতে অনেক ভূমিকা রয়েছে। এর ফলে সুন্দরবনের জীব-বৈচিত্র এখনো বিরাজমান।

পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে মোট নয়টি দপ্তর এই নদ-নদী সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাপনা বিষয়ে কাজ করে আসছে। যেমন: পূর্ববঙ্গীয় রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০ এর ৮৬, ৮৭, ১৪৩, ১৪৪ ও ১৪৫ ধারা অনুসারে নদ-নদীর সীমানা ও মালিকানা নির্ধারণের দায়িত্ব একমাত্র ভূমি প্রশাসনের।

মৎস্য আইন ১৯৫০ অনুসারে নদ-নদী ও জলাশয়ে মৎস্য চাষ, আহরণ, জলাশয় লীজ প্রদান, মৎস্য অভয়াশ্রম সংরক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব মৎস্য অধিদপ্তরের।

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ  আইন-১৯৯৫, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (সংশোধন) আইন ২০১০ এবং বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষন আইন ২০১৭ অনুসারে নদ-নদী ও জলাধারের পরিবেশ-প্রতিবেশ সুরক্ষা ও দূষণ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড আইন ২০০০ অনুসারে (ক) নদ-নদী ও তার অববাহিকা নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি নিষ্কাশন, সেচ ও খরা প্রতিরোধের লক্ষ্যে জলাধার, ব্যারেজ, বাঁধ, রেগুলেটর বা অন্য যে কোন অবকাঠামো নির্মাণ; (খ) সেচ, মৎস্য চাষ, নৌপরিবহণ, বনায়ন, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও পরিবেশের সার্বিক উন্নয়নে সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে পানি প্রবাহের উন্নয়ন কিংবা পানি প্রবাহের গতিপথ পরিবর্তনের জন্য স্থলপথ, জলপথ, খালবিল ইত্যাদির পূনঃখনন; (গ) ভূমি সংরক্ষণ, ভূমি পরিবৃদ্ধি ও পূনরুদ্ধার এবং নদ-নদীর মোহনা নিয়ন্ত্রণ; (ঘ) নদ-নদীর তীর সংরক্ষণ ও নদ-নদী ভাঙ্গন হইতে সমভাব্য ক্ষেত্রে শহর, বাজার, হাট এবং ঐতিহাসিক ও জাতীয় জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহ সংরক্ষণ; (ঙ) উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ ও সংরক্ষণ; (চ) লবণাক্তাতার অনুপ্রবেশ রোধ ও মরুকরণ প্রশমন; (ছ) সেচ, পরিবেশ সংরক্ষণ ও পানীয় জল আহরণের লক্ষ্যে বৃষ্টির পানি ধারণ করতে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কাজ করে আসছে।

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রবাহিত আন্তঃসীমান্ত নদ-নদী সমূহের যথাযথ সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা ও দেশীয় স্বার্থ নিশ্চিত করার জন্য ভারতের সাথে সভা-সমাবেশ করার একমাত্র প্রতিষ্ঠান। ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ও প্রজাতন্ত্রী ভারত সরকারের প্রধানমন্ত্রীদ্বয়ের মধ্যে যৌথ ঘোষণার মাধ্যমে দু’দেশের বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে অভিন্ন নদ-নদীর ব্যাপক জরিপ কার্যক্রম পরিচালন এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণের বিস্তারিত প্রকল্প প্রণয়ন ও প্রধান প্রধান নদ-নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ প্রকল্পের উপর সমীক্ষা পরিচালনা, উভয় দেশের জনগণের পারস্পরিক সুবিধা অর্জনের লক্ষ্যে এতদাঞ্চলের পানি সম্পদের ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার এবং বাংলাদেশের সাথে ভারত সংলগ্ন এলাকায় পাওয়ার গ্রীড সংযোজনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য স্থায়ী ভিত্তিতে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশন গঠিত হয়। উক্ত ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭২ সালের ২৪ নভেম্বর অংশগ্রহণকারী দু’দেশের মধ্যে যোগাযোগ অব্যাহত রেখে সর্বাধিক যৌথ ফলপ্রসূ প্রচেষ্টার মাধ্যমে অভিন্ন নদ-নদী সমূহ থেকে সর্বোচ্চ সুফল প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের সমঝোতা স্মারক বা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের বাংলাদেশ পক্ষের কাজ সম্পাদনে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংযুক্ত দপ্তর হিসেবে যৌথ নদী কমিশন, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা হয়।

উল্লেখ্য, যে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রবাহমান শতাধিক নদ-নদী থাকলেও এই প্রতিষ্ঠান ১৯৭২ সালে মাত্র ৫৪টি নদ-নদীর তালিকা প্রকাশ করেছে। আর বাংলাদেশ-বর্মার মধ্যে প্রবাহমান ৩টি নদী তালিকাভূক্ত করেছে। বিগত ৫০ বছরে নদ-নদী জরিপের মাধ্যমে এই তালিকা আর হালনাগাদ করা হয় নি। উপরন্তু তালিকায় এমনও নদ-নদী আছে, যার উৎপত্তি স্থল বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে; যেমন, সাঙ্গু, মাতামূহুরী, আত্রায় (যা করতোয়ার শাখা নদী) ইত্যাদি। আবার কর্ণফুলীসহ অনেক নদ-নদী এই তালিকায় নাই।

যৌথ নদী কমিশনের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় মাত্র গঙ্গা পানি বন্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, যার মেয়াদ আগামী ২০২৬ সালে শেষ হবে। এই চুক্তি কেবল ফারাক্কা বাঁধের মধ্যে সীমাবদ্ধ, ফারাক্কা (নেপাল সহ) উজানে নির্মিত প্রায় ১০টি বাঁধের বিষয়ে উল্লেখ নেই। আবার অন্যান্য নদ-নদীর পানি প্রবাহ নিয়ে কোন ফলপ্রসু আলোচনা বা সমঝোতা হয় নি। গঙ্গা অববাহিকার সবচেয়ে বেশি পানি প্রবাহ হয়ে থাকে নেপাল থেকে, ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার উল্লেখযোগ্য পরিমানে পানি প্রবাহিত হয়ে আসে ভুটান ও চীনের তিব্বত মালভূমি থেকে। তাই, আমাদের দাবি ছিল অববাহিকা ভিত্তিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে সংশ্লিষ্ট সকল দেশ মিলে যৌথ সমঝোতায় স্বাক্ষর করা। সেই বিষয়ে কোন আলোচনার সুত্রপাত এখনো হয় নি।

ফরিদপুর জেলায় অবস্থিত বাংলাদেশ নদ-নদী গবেষণা ইনষ্টিটিউট ১৯৭৮ সাল থেকে কাজ করে আসছে। বাংলাদেশ নদ-নদী গবেষণা ইনষ্টিটিউট আইন ১৯৯০ অনুসারে, এই প্রতিষ্ঠানের কাজের পরিধি নিম্নরূপ: (ক) নদ-নদী শাসন, নদ-নদীর ভাঙ্গন রোধ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং সেচ ও পানি নিষ্কাশনের প্রয়োজনে নকশা প্রণয়নের জন্য এবং নদ-নদী কৌশল, নদ-নদীর পলল নিয়ন্ত্রণ, নদ-নদীর মোহনা এবং জোয়ার ভাটা সম্পর্কিত গবেষণা কাজে ভৌত মডেলের মাধ্যমে সমীক্ষা পরিচালনা করা; (খ) পানি সম্পদ উন্নয়নের জন্য নদ-নদীর পানি প্রবাহ এবং পানি বিভাজন এলাকা, পানি বিজ্ঞান, ভূ-পরিস্থ এবং ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহার এবং পরিবেশগত বিষয়াদি বিশেষতঃ লবনক্তার অনুপ্রবেশ এবং পানির গুণাগুণ সম্পর্কে গাণিতিক মডেলের মাধ্যমে সমীক্ষা পরিচালনা করা; (গ) নদ-নদী শাসন, নদ-নদীর ভাঙ্গন রোধ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং সেচ ও পানি নিষ্কাশনের জন্য মাটি, পানি, পলল এবং নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত উপকরণ পরীক্ষা এবং নির্মাণ কাজের মানের তদারকি ও মূল্যায়ন করা; (ঘ) উপরে উল্লেখিত বিষয়সমূহে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা এবং তৎসংশ্লিষ্ট কারিগরী বিষয়ে সাময়িকী এবং প্রতিবেদন প্রকাশ করা; (ঙ) উপরোল্লেখিত কোন বিষয় সম্পর্কে সরকার, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানকে পরামর্শ প্রদান করা; (চ) উহার কার্যাবলীর মত একই প্রকার কার্যে নিয়োজিত অন্য কোন দেশী বা বিদেশী সংস্থার সহিত যৌথ কার্যক্রম পরিচালনা করা।

বাংলাদেশ সরকারের পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের একটি সংযুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসাবে ২০১৬ সাল থেকে বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ জেলায় শাখা অফিসের মাধ্যমে সম্পূর্ণ হাওর এলাকার নদ-নদী সহ বিশাল জলাশয়ের ও তৎসংশ্লিষ্ট সম্পদের সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে হাওর মাষ্টার প্ল্যান প্রণয়ন ও বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে তার বাস্তবায়ন করে আসছে।

পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা (ওয়ারপো) পানি সম্পদ পরিকল্পনা আইন- ১৯৯২ অনুযায়ী নিম্নোক্ত দায়িত্ব পালন করে আসছে; (ক) পানি সম্পদের উন্নয়নকল্পে পরিবেশগতভাবে ভারসাম্যপূর্ণ মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা; (খ) পানি সম্পদের বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবহার ও সংরক্ষণ সম্পর্কিত জাতীয় কৌশল ও নীতি নির্ধারণ করা; (গ) পানি সম্পদ উন্নয়ন, ব্যবহার ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সংশিষ্ট অন্যান্য সংস্থাকে পরামর্শ প্রদান করা; (ঘ) পানি সম্পদ উন্নয়ন, ব্যবহার ও সংরক্ষণে নিয়োজিত যে কোন প্রতিষ্ঠানের সমীক্ষা পরিচালনায় সহযোগিতা প্রদান এবং প্রয়োজনে সংশিষ্ট যে কোন বিষয়ে বিশেষ সমীক্ষা পরিচালনা করা; (ঙ) পানি সম্পদ উন্নয়ন, ব্যবহার ও সংরক্ষণে নিয়োজিত কোন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক গৃহীত ব্যবস্থা হতে উদ্ভূত বিষয়ের মূল্যায়ন ও পর্যালোচনা করা এবং উক্ত বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করা; (চ) পানি সম্পদের ব্যবহার সংক্রান্ত শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও পেশাগত মান উন্নত করা; (ছ) পানি সম্পদের ব্যবহার সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ ও পর্যালোচনা করা এবং প্রচারের ব্যবস্থা করা; (জ) পানি সম্পদ বিষয়ক জাতীয় এবং সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে আন্তর্জাতিক সেমিনার, সম্মেলন ও কর্মশালার আয়োজন ও পরিচালনা করা; (ঝ) সরকার কর্তৃক প্রদত্ত পানি সম্পদ বিষয়ক অন্যান্য দায়িত্ব পালন করা।

উপরন্তু বাংলাদেশ পানি আইন ২০১৩ অনুযায়ী ওয়ারপোর দায়িত্বসমূহ হচ্ছে; পানি সম্পদের সমন্বিত উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা, আহরণ, বিতরণ, ব্যবহার, সুরক্ষা ও সংরক্ষণের লক্ষ্যে বিধান প্রণয়ণ করা।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন ২০১৩ দ্বারা নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন; নদ-নদীর জায়গা অবৈধ দখল, নদ-নদীর দূষণ, পানি ও পরিবেশ দূষণ, শিল্প কারখানা কর্তৃক সৃষ্ট নদ-নদী দূষণ, অবৈধ কাঠামো নির্মাণ, নানাবিধ অনিয়ম রোধকল্পে এবং নদ-নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ পুনরুদ্ধার, নদ-নদীর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণসহ এবং নৌ-পরিবহন যোগ্য হিসাবে গড়ে তোলাসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নদ-নদীর বহুমাত্রিক ব্যবহার নিশ্চিত করার প্রয়োজনে গঠন করা হয়েছে। এই কমিশন নদ-নদী যথাযথ সুরক্ষার জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করে আসছে।

সর্বোপরি, ২০১৯ সালে বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের রায়ে বাংলাদেশের সকল নদ-নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করেছে এবং জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে নদ-নদী সমূহের অভিভাবক ঘোষণা করেছে।

সার্বিক বিবেচনায়, পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের অধীন মোট নয়টি দপ্তর, নদ-নদী সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালন করে আসছে। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের আলাদা আলাদা আইন ও নির্দেশনা অনুসারে উক্ত দপ্তর সমূহ কাজ করছে। কোন কোন ক্ষেত্রে একটি দপ্তরের কাজের পরিধির সাথে অন্য দপ্তরের কাজের পরিধির মিল রয়েছে, তবে সমন্বয় নাই। নদ-নদীর সীমান নির্ধারণসহ কোন কোন ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগে কিছুটা অস্পষ্টতা পরিলক্ষিত হয়েছে। দীর্ঘ সময় পরেও সকল কাজের সমন্বয় করতে কোন একক প্রতিষ্ঠান বা মন্ত্রণালয় গড়ে তোলা হয় নি। উপরন্তু উচ্চ আদালতের রায়ের ভিত্তিতে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন ২০১৩ সহ অন্যান্য আইনসমূহ সংশোধন করা হয় নি। ফলে নদ-নদীর সুরক্ষায় কোন কার্যকর উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

নদ-নদী সমূহের পানি প্রবাহে কৃত্রিম বাধা সৃষ্টি, দূষণ, পরিবেশ-প্রতিবেশ তোয়াক্কা না করে নদ-নদীর তীরে প্রকল্প বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন প্রকারের অব্যাবস্থাপনার কারণে বন্যা ও প্লাবন এখনো নিয়ন্ত্রণহীন। গত কয়েক দিনে সারা দেশে তা মারাত্মক ভাবে ফুটে উঠেছে। দেশের কোন কোন অঞ্চলে খরার তীব্রতা ও পানি সংকট বেড়েই চলেছে। এইসব অবস্থার ফলে জনস্বাস্থ্য, কৃষি, মৎস্য সম্পদ, প্রাণিসম্পদ, জলবায়ু, পরিবেশ-প্রতিবেশ আজ হুমকির সম্মুখীন।

আন্তঃসীমান্ত নদ-নদী সমূহের পানি প্রবাহ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে ১৯৯৭ সালে, জাতিসংঘ প্রণীত আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহে নৌ-চলাচল বর্হিভুত ব্যবহার সংক্রান্ত আইনটি প্রণয়নের পর ১৭ আগষ্ট ২০১৪ তারিখে মাত্র ৩৬টি দেশের স্বাক্ষরের মাধ্যমে কার্যকারিতা পেয়েছে। তবে উক্ত আইনে চীনসহ দক্ষিণ এশিয়া দেশসমূহ এখনো স্বাক্ষর করার কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। যার ফলে আন্তঃসীমান্ত নদ-নদী সমূহের যৌথ ব্যবস্থাপনা ও বিরোধ নিস্পত্তি বিষয়ে জাতিসংঘের সহায়তা পাওয়ার বিষয়টি অনিশ্চিত।

জাতিসংঘ পানি নামে ২০১৫ সালে জাতিসংঘের একটি অঙ্গসংগঠণ তৈরী করা হয়েছে। যাদের কাজ হচ্ছে; জাতিসংঘ প্রণীত স্থায়ীত্বশীল উন্নয়ন লক্ষমাত্র (এসডিজি)-৬ এর অর্জনকে ত্বরান্বিত করা, প্রমাণ-ভিত্তিক নীতিনির্ধারণ, প্রবিধান, পরিকল্পনা এবং সব স্তরে বিনিয়োগের জন্য উচ্চ-মানের তথ্যের প্রাপ্যতা বৃদ্ধি করা৷ আরও নির্দিষ্টভাবে, এর লক্ষ্য হলোঃ (ক) এসডিজি-৬ এর তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ এবং প্রতিবেদন তৈরী করতে দেশগুলিকে সহায়তা করে এবং (খ) একটি সামগ্রিক পদ্ধতিতে এই তথ্য ব্যবহার করার জন্য সমস্ত স্তরে নীতি-নির্ধারক এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের সহায়তা করা।

এছাড়াও, নদ-নদীর অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বেশ কয়েকটা আন্তর্জাতিক সংস্থা বিভিন্ন ভাবে অনেককে সাথে নিয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আলাদা ভাবে প্রতিবছর ২২ মার্চ, বিশ্ব পানি দিবস পালন করে থাকে। তাছাড়া, বাংলাদেশের নদ-নদীর ব্যবস্থাপনার একক বা প্রধান কোন দপ্তর বা সংস্থা না থাকায় জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংগঠনের সাথে সমন্বয় করে ইতিবাচক কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা সম্ভব হয় নাই।

বাংলাদেশে আরো একটি বিষয় অমিমাংশিত আছে, তা হলো অববাহিকার সংখ্যা। বইপত্রে আমরা পায় তিনটি অববাহিকা যথা: গঙ্গা বা পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র বা যমুনা ও মেঘনা। তাহলে ফেনী, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, বান্দারবান ও কক্সবাজার জেলা সমূহের মধ্যে প্রবাহিত নদীসমূহ যথা; কারকি, সেলোনিয়া, মুহুরি, ফেনী, হালদা, কর্ণফুলী, সাঙ্গু, মাতামুহুরি, বাঁকখালী কোন অববাহিকার অংশ? অববাহিকার সংজ্ঞা ও ব্যাপ্তি নিয়ে কোন দপ্তর আলোচনা করে মিমাংশা করবে? জানা নাই। আর কোন নদী বা খালের পানি যদি লোকালয়ের উপর দিয়ে প্রতি বর্ষাকালে প্রবাহিত হতে থাকলে, কার কাছে সমাধান পাব তাও জানা নাই।

তাই উল্লেখিত ৯টি দপ্তর, বরেন্দ্র বহুমুখি উন্নয়ন প্রকল্প, গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পসহ অন্যান্য সেচ প্রকল্প প্রতিষ্ঠানকে একক কোন মন্ত্রণালয়ের অধিন রেখে নদ-নদীর একটি সমন্বয়ক ও অভিভাবক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা দরকার। যাতে নদ-নদীর সুরক্ষার বিষয়ে জবাবদিহিতা ও জনসম্পদ ব্যাবহারে স্বচ্ছতা নিশ্চিৎ করা সম্ভব হয়।

লেখক: নদী অধিকার মঞ্চের সদস্য সচিব।

এই বিভাগের আরও খবর