লালমনিরহাট বার্তা
‘ভারতের কী লেখাপড়া জানা প্রধানমন্ত্রী দরকার?’
বার্তা অনলাইন ডেস্ক | ২ এপ্রি, ২০২৩, ৬:৩৭ AM
‘ভারতের কী লেখাপড়া জানা প্রধানমন্ত্রী দরকার?’

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়ে তথ্য জানতে চাওয়ার কারণে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে আদালতে ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করার পরে মি. কেজরিওয়াল আবারও প্রশ্ন তুলেছেন যে দেশের প্রধানমন্ত্রীর পড়াশোনা জানা প্রয়োজন কী না।

শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “একজন প্রধানমন্ত্রীকে প্রতিদিন কয়েকশো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তার মধ্যে প্রতিরক্ষা থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয় থাকে।

তিনি নিজে যদি পড়াশোনা না জানেন তাহলে কর্মকর্তারা যা খুশি বুঝিয়ে দিয়ে সই করিয়ে নিয়ে চলে যেতে পারে।"

এই প্রশ্ন তুলে মি. কেজরিওয়ালের দল একটা পোস্টার প্রচারণাও শুরু করেছে দিল্লিতে। নীল কাগজের ওপরে সাদা অক্ষরে ছাপা ওই পোস্টারে লেখে হয়েছে ভারতের কি পড়াশোনা জানা প্রধানমন্ত্রী দরকার?

আম আদমি পার্টি ওই পোস্টার দিল্লির নানা জায়গায় লাগিয়েছে। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী ২০১৬ সালে তথ্য জানার অধিকার আইন অনুযায়ী গুজরাত বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে নরেন্দ্র মোদীর ডিগ্রির বিস্তারিত জানতে চেয়েছিলেন। কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশনার বিশ্ববিদ্যালয়কে নির্দেশ দেন ওই তথ্য দেওয়ার জন্য।

সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ওয়েবসাইটে মি. মোদীর ডিগ্রির তথ্য দিয়ে দেয়, তবে তারা কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশনারের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে মামলাও করে। সেই মামলার রায়ে গুজরাত হাইকোর্ট শুক্রবার রায় দেয় যে, মি. কেজরিওয়াল এমন তথ্য জানতে চেয়েছেন, যা জনসমক্ষেই আছে।

আদালত আরও বলে যে তথ্য জানার অধিকার আইনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর ডিগ্রি নিয়ে প্রশ্ন তুলে মি. কেজরিওয়াল একটা বিতর্ক তৈরি করতে চেয়েছিলেন। সেজন্য তার ২৫ হাজার টাকা জরিমানাও হয়।

তবে, শনিবার মি. কেজরিওয়াল আবারও সেই একই প্রশ্ন তুলেছেন।

তিনি বলছেন, “প্রধানমন্ত্রীর একটা ভিডিও আমরা দেখেছি, যেখানে মি. মোদী বলেছিলেন যে তিনি পড়াশোনা জানেন না, গ্রামের স্কুলে যেতেন, তার পরে আর পড়াশোনা করেন নি।"

“প্রধানমন্ত্রী যদি পড়াশোনা না জানেন, যে কেউ গিয়ে তো তাকে বোকা বানিয়ে দেবে। হাইকোর্টের নির্দেশের ফলে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে যে সব সংশয় ছিল, তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

অমিত শাহ কয়েক বছর আগে একটা ডিগ্রি দেখিয়েছিলেন। যদি ডিগ্রি থাকেই, সেটা যদি সঠিক হয়, তাহলে সেটা দেখানো হচ্ছে না কেন?” প্রশ্ন অরবিন্দ কেজরিওয়ালের।

নরেন্দ্র মোদির এডিট করা ভিডিও সাক্ষাৎকার

নরেন্দ্র মোদীর ঠিক কোন ভিডিওর কথা মি. কেজরিওয়াল বলেছেন, তা স্পষ্ট নয়।

তবে ২৯ সেকেন্ডের একটা ভিডিও ক্লিপ সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে বছর দুয়েক আগে, মি. মোদীর পুরনো একটি সাক্ষাৎকারের ভিডিও সেটি।

ওই সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন সাংবাদিক রাজীব শুক্লা।

সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ওই ভিডিও ক্লিপে মি. মোদীকে বলতে শোনা গেছে, তিনি ১৭ বছর বয়সে ঘর ছেড়ে দিয়েছিলেন, স্কুলের পড়া শেষ করেই।

ওই সাক্ষাৎকারের পুরোটাই ইউ টিউবে পাওয়া যায়। রু-বা-রু নামে ওই জনপ্রিয় টেলিভিশন অনুষ্ঠানের পুরোটাই বিবিসি বাংলা দেখেছে।

নরেন্দ্র মোদী যখন বিজেপির সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দিল্লিতে থাকতেন, তখনই সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়।

সেখানে “স্কুলের পড়া শেষ করেই...” এই শব্দবন্ধের অব্যবহিত পরই মি. মোদী উল্লেখ করেছিলেন "অনেক পরে, সঙ্ঘের (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ) কয়েকজনের উৎসাহে তিনি আবারও আনুষ্ঠানিক পড়াশোনা শুরু করেন এবং ‘এক্সটার্নাল ক্যান্ডিডেট’ হিসাবে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক এবং গুজরাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন, আর কলেজের দরজাও তিনি দেখেন নি"।

এই অংশটি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ২৯ সেকেন্ডের ক্লিপ থেকে বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছে।

যার ফলে মনে হচ্ছে যে তিনি স্কুলের পরে আর পড়াশোনা করেন নি।

অমিত শাহ দেখিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর ডিগ্রি

অরবিন্দ কেজরিওয়াল ২০১৬ সালে তথ্য জানার অধিকার আইন অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর ডিগ্রি দেখতে চাওয়ার পরেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ সংবাদ সম্মেলন করে মি. মোদীর ডিগ্রির প্রতিলিপি প্রকাশ করেছিলেন।

তবে সেই ডিগ্রিও জাল বলে তখনই অভিযোগ করেছিল মি. কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি।

সামাজিক মাধ্যমে নরেন্দ্র মোদীর শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে নানা তথ্য ঘুরে বেড়ায়।

তার মধ্যে একটি ‘এন্টায়ার পলিটিক্যাল সায়েন্স’ নামে একটি অদ্ভুত বিষয়ে তার ডিগ্রি পাওয়ার কথা বলা হয়।

এছাড়া, কম্পিউটার থেকে প্রিন্ট করা তার ডিগ্রি সার্টিফিকেটে যে ফন্ট ব্যবহার করা হয়েছে, মাইক্রোসফ্টের সেই ফন্ট তার ডিগ্রি পাওয়ার বহু বছর পরে বেরিয়েছে, বা তার সার্টিফিকেট যেদিন ইস্যু করা হয়েছে সেটা একটা রবিবার ছিল অথবা মি. মোদীর সঙ্গে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন সেরকম কোনও সহপাঠীকে কেন পাওয়া যায় না।

এমন অনেক যাচাই না করা তথ্যই সামাজিক মাধ্যমে ঘুরে ফিরে আসে তিনি ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই।

ডিগ্রি নিয়ে মোদির জীবনীকার আর পারিবারিক বন্ধু কী বলছেন

সাংবাদিক নীলাঞ্জন মুখার্জি ২০১৩ সালে নরেন্দ্র মোদীর জীবনী লিখেছিলেন।

ভারতের একজন পড়াশোনা জানা প্রধানমন্ত্রীর দরকার কী না, সে প্রশ্ন যখন নতুন করে উঠেছে, সেই প্রেক্ষিতে মি. মুখার্জী বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “আমি যখন জীবনী লেখার জন্য মি. মোদীর সাক্ষাৎকার নিই, এবং সবটাই টেপ রেকর্ড করা আছে, সেখানে তিনি (মি. মোদী) শুধু উল্লেখ করেছিলেন যে করেসপন্ডেন্স কোর্সে তিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক আর গুজরাত থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পেয়েছেন।"

"কোন বছরে তিনি পাশ করেছেন, বা কী তার বিষয় ছিল, সে সব আমার বইয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল না তাই আর বিশদে জানতেও চাই নি আমি," বলেন মি. মুখার্জী। নরেন্দ্র মোদীর এক পারিবারিক বন্ধু আহমেদাবাদের সিনিয়র সাংবাদিক সতীশ মোরি।

তার কাছে বিবিসি জানতে চেয়েছিল মি. মোদীর শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে।

তিনি বলেছেন, “আমি যা জানি, প্রধানমন্ত্রী পলিটিক্যাল সায়েন্স নিয়ে ডিগ্রি পেয়েছেন।“ তিনি যদি দুটো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি অর্জন করেই থাকবেন, তাহলে তার কোনও সহপাঠী বা কোনও শিক্ষকের কথা কেন মানুষ জানতে পারেন না – এই প্রশ্নের উত্তরে মি. মোরি বললেন, “তার একজন শিক্ষক, প্রায় নব্বই বছর বয়স, তার সঙ্গে তো আমি কিছুদিন আগে বিধানসভা ভোটের আগেই দেখা করেছি।

আর মি. মোদী যখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, সেই সময়ে তার স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষক-অধ্যাপকদের আমন্ত্রণ করে একটা সম্বর্ধনা দিয়েছিলেন গুজরাত কলেজে।“

কেন প্রধানমন্ত্রীর ডিগ্রি নিয়ে বিতর্কের জবাব দেয় না বিজেপি?

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রীর ডিগ্রিগুলি প্রকাশ করার পরেও কেন নরেন্দ্র মোদীর শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে বারেবারেই প্রশ্ন ওঠে, কেনই বা তিনি বা তার দল বিষয়গুলি নিয়ে কথা বলেন না, সেই প্রশ্নও শনিবার তুলেছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল।

নরেন্দ্র মোদীর জীবনীকার নীলাঞ্জন মুখার্জীরও মনে এই একই প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসে। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছিলেন, “তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে বারে বারেই তার ডিগ্রি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, বিতর্ক হয়।

কিন্তু আমার খুব আশ্চর্য লাগে যে কেন তিনি নিজে বা তার দল এই বিষয়ে কোনও ক্ল্যারিফিকেশন দেয় না! যদি ডিগ্রি থেকেই থাকে তাহলে তো তাদের সেগুলো সামনে নিয়ে এসে এই বিতর্ক স্থায়ীভাবে শেষ করে দেওয়া উচিত।“

তিনি আরও বলছিলেন, “আমাকে নিজের মুখে নরেন্দ্র মোদী তার ডিগ্রি নিয়ে যা বলেছিলেন, যতক্ষণ না আমি সেটার বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ পাচ্ছি, ওই কথাটাকেই আমি সঠিক বলে মেনে চলব। এটাই আমার অবস্থান।“

মি. মোদীর পারিবারিক বন্ধু সতীশ মোরি বলছিলেন, “উল্টো দিক থেকে ভাবলে এটাও তো হতে পারে যে প্রধানমন্ত্রী বা তার দল যে এই বিতর্কের কোনও জবাব দেয় না, তার কারণ তারা নিজেরা জানেন যে সত্যটা কি। তাদের নিজেদের কাছে বিষয়টা খুবই স্বচ্ছ যে প্রধানমন্ত্রীর দুটি ডিগ্রিই আছে। তাই কেউ প্রশ্ন তুললেই তার জবাব কেন দিতে হবে বারে বারে?”(বিবিসি)

এই বিভাগের আরও খবর