লালমনিরহাট বার্তা
বিনা বেতনে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে মোছলেম উদ্দিন
আহসান সাকিব হাসান | ৮ এপ্রি, ২০২৩, ৯:২৪ AM
বিনা বেতনে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে মোছলেম উদ্দিন

নেই কোন বেতন-ভাতা, তবুও নিজ উদ্যোগে দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় ধরে শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছেন ৭৭ বছর বয়সি মোসলেম উদ্দিন। লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী ইউনিয়নের শৌলমারী তিস্তা নদীর বুকে চর কালিকাপুর গ্রামের বাসিন্দা তিনি।

১৯৬৯ সালে ২৩ বছর বয়সে মোসলেম উদ্দিন এসএসসি পাস করেন। সেই সময় শৌলমারী কালিকাপুর চরে তিনি ছিলেন একমাত্র এসএসসি পাস ব্যক্তি। মূল ভূখণ্ডে আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে তিনি লেখাপড়া করেছিলেন। চরে একসময় মাধ্যমিক বিদ্যালয় না থাকায় তিনি তার দুই ছেলে ও চার মেয়েকে উচ্চশিক্ষিত করতে পারেননি। তাই তার এই মহত উদ্যােগ।

তিস্তাপারের দুর্গম এই চরে মাত্র একটি নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়। এখানে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। বিদ্যালয়টি এখনো এমপিওভুক্ত হয়নি। এখানে একজন ইংরেজি শিক্ষক থাকলেও তিনি নিয়মিত আসতে পারেন না। তাই এই বিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ের পাঠদান করেন শিক্ষানুরাগী এই ব্যক্তি। তাঁর পাঠদানের আন্তরিকতায় মুগ্ধ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা। বেতন-ভাতা ছাড়াই ১৫ বছর ধরে তিনি এ বিদ্যালয়ে পাঠদান করছেন।

বিনা বেতনের এই শিক্ষক এক দিনও বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকেন না। সবার আগে আসেন, বিদ্যালয় ছুটি হওয়ার পর সবার শেষে চলে যান। চরের শিক্ষার্থীদের জীবন শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে নিবেদিত এই মহান শিক্ষকের নাম মোসলেম উদ্দিন। ২০০৮ সালে এই চরে বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয় 'নদী ও জীবন নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। এই স্কুল প্রতিষ্ঠায় তিনি শ্রম দিয়েছিলেন। তার পর থেকেই তিনি এই স্কুলে পাঠদান করে আসছেন।

৭৭ বছর বয়সী মোসলেম উদ্দিন এখনো কর্মচঞ্চল মানুষ। তিনি চরের শিশুদের শিক্ষিত করতে স্বেচ্ছাশ্রমে শিক্ষাদান করে আসছেন। তাঁর সম্পদ বলতে দুই বিঘা জমি ছাড়া আর কিছুই নেই। দুই ছেলে থাকলেও তাঁরা বিয়ে করে আলাদা থাকেন। স্ত্রী বেনোয়ারা বেগমকে নিয়ে সুখ-দুঃখের জীবন মোসলেম উদ্দিনের।

মোসলেম উদ্দিনের স্ত্রী বেনোয়ারা বেগম বলেন, উনি সকালে স্কুলে যান, বিকেলে বাড়িত আসেন। চরের মধ্যে অল্প এই জমিতে চাষাবাদ করি। উনি প্রাইভেট পড়ায় যা দুই পয়সা পায় সব মিলেই টানাপোড়ানে সংসার চালাই। ওনাক সবাই মোসলেম উদ্দিন স্যার কয়া ডাকায়। তাতেই উনি খুশি, হামরাও খুশি।

সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী সুমাইয়া আক্তার,আল্পনা আক্তার ও অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী মর্জিনা আক্তার বলেন, মোসলেম উদ্দিন স্যার সুন্দর করে ইংরেজি প্রথম পত্র ও দ্বিতীয় পত্র পড়ান। আমরা বুঝতে না পারলে আবার পড়ান, কখনো রাগ করেন না। উনি তো চাকরি করেন না, মনের টানে স্কুলে আসেন, উনি আমাদের দাদুর মতো। আমরা দাদুর কাছে প্রাইভেট পড়ি, দাদুকে একশত টাকা দিলেও উনি নেয়।

কালিকাপুর চরের কৃষক নাজির হোসেন (৬৭) বলেন, দুঃখ কষ্ট মিলেই আমাদের জীবন। বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর থেকে চরের ছেলে-মেয়েরা মাধ্যমিকে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। বিশেষ করে চরের মেয়েদের শিক্ষিত করতে এ বিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আগে এই চরের মেয়েরা সর্বোচ্চ পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করার সুযোগ পেতো। "নদী ও জীবন" বিদ্যালয়টি হওয়ার পর চরের অনেক মেয়ে উচ্চ শিক্ষিত হয়েছে। বিদ্যালয়টি দুর্গম চরে শিক্ষার প্রদীপ জ্বালিয়েছে।

বিদ্যালয়টির পরিচালনা কমিটির সভাপতি মোবারক আলী বলেন, ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান তিনি চরের লোকজনকে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে অনুপ্রেরণা যোগান। তিনি আর্থিকভাবে সহায়তা করলে বিদ্যালয়ের অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। এখানে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোনো বেতন নেওয়া হয় না। শিক্ষকরা বিভিন্ন স্থান থেকে এসে বিনা পারিশ্রমিকে চরের শিক্ষার্থীদের পাঠদান করছেন। তার মধ্যে মোছলেম উদ্দিন অন্যতম। বিদ্যালয়টি এখনো এমপিও ভুক্ত না হওয়ায় শিক্ষকদের মাঝে অসন্তোষ রয়েছে।

বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক মাহবুবুর রহমান বলেন, এখানে নয়জন শিক্ষকের মধ্যে চার-পাঁচজন নিয়মিত উপস্থিত হলেও ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক নিয়মিত আসেন না। এ অবস্থায় মোসলেম উদ্দিনই একমাত্র ভরসা, যিনি বিনা বেতনে ১৫ বছর ধরে ইংরেজি বিষয়ে পাঠদান করে যাচ্ছেন। বিদ্যালয়টি এমপিও ভুক্ত না হওয়ায় প্রতিষ্ঠাকালীন অনেক শিক্ষক চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। নতুন কিছু শিক্ষক যোগদান করেছেন। বিনা পারিশ্রমিকে আমরা শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছি। চরে নারী শিক্ষার বিস্তার ঘটানো আমাদের উদ্দেশ্য। বিদ্যালয়টি এমপিও ভুক্ত হলে এটি দুর্গম চরে নারী শিক্ষা বিস্তারে আরও বেশি ভূমিকা রাখবে।

শিক্ষানুরাগী শিক্ষক মোসলেম উদ্দিন বলেন, ১৯৬৯ সালে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জের হাজরানিয়া দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হই। অল্প কিছু জমিতে চাষাবাদ করি, গ্রামের বাড়িতে টিউশনি করে সামান্য যে আয় হয় তা দিয়ে কষ্ট করে সংসার চালাই। আবার গরিব শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রাইভেট পড়ার টাকাও নেইনা। ছেলে মেয়েদের পড়াতে পেয়ে আমার অনেক ভালো লাগে। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত আমি তাদের পড়াতে চাই।

লালমনিরহাট জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল বারী বলেন, বিদ্যালয়টি কেন এখনো এমপিও ভুক্ত হতে পারেনি সেটা বলতে পারছি না। এমপিও ভুক্ত হওয়ার জন্য সব ধরনের কাগজপত্র শিক্ষা অধিদপ্তরে রয়েছে।

২০০৮ সালে নির্মিত নদী ও জীবন নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়টিতে বর্তমান ১৩৯ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। বিদ্যালয়টিতে টিনশেডের দুটি ভবন রয়েছে। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে ১৩৯ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এখানে প্রধান শিক্ষকসহ শিক্ষক আছেন নয়জন।

এই বিভাগের আরও খবর