লালমনিরহাট বার্তা
সুফিয়ানা জীবন:মওলানা ভাসানীর শিক্ষা
বার্তা ডেস্ক | ৩১ জুল, ২০২৩, ২:৩৮ PM
সুফিয়ানা জীবন:মওলানা ভাসানীর শিক্ষা

১৯৭৪ সনের ০১ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার নার্সারি শ্রেণি থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত এ ক্যাম্পাসে ক্লাসে শুরুর প্রথম দিনে মহান শিক্ষক মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানি সমবেত কর্মী, অভিভাবক ও অবুঝ ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে নাতিদীর্ঘ ভাষণ দান করে। তাতে তিনি বলেন,‘আমার লক্ষ্য বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু আমি লক্ষ্য করছি,বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও কর্ম-জীবনে, সমাজ-জীবনে অনৈতিক জীবন যাপনে কেউ লজ্জা বোধ করে না। বরং কে কত অনৈতিক হতে পারে তার প্রতিযোগিতা নেমে পড়ে।এ মানসিকতার পারিবর্তন আনতে হলে শিক্ষা-জীবনের গোড়াতেই নেতিক জীবনের পত্তন করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে নৈতিকতা চাপিয়ে দিয়ে সুফল পাওয়া যাবে না। তাই,আমি শিশু স্কুল দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু করছি। বাবলার কাঁটা হয়েই বেড়ে ওঠে। ভেড়াকে চাবকিয়ে কোনদিন তাজি ঘোড়া বানানো যায় না।’

নীতির প্রশ্নে মওলানা ভাসানী, শৈশব দুরন্তপনার জন্যে যাকে চ্যাকা মিয়া ডাকা হতো, বাবলার কাঁটা হয়েই বেড়ে উঠেছিলেন। বয়স দশের বেশি হবে না, পিতৃহারা হলেন। চাচা ইব্রাহিম খাঁ-এর অভিভাবকত্বে লালিত-পালিত হচ্ছিলেন। দু’তিন বছরের মধ্যে গৃহাত্যাগী হবার অন্তরালে যে ঘটনাটি কিশোর-ভাসানীকে প্রভাবিত করেছিল তা আজ ইতিহাসের বিষয়বস্তু। সে সময় খানাপিনায় আশরাফ-আতরাপ অর্থাৎ অভিজাত-অ-অভিজাত-এ দু শ্রেণিতে ভাগ করে বসানো হতো এবং সেভাবেই খাওয়ানো হতো। চাচা ইব্রাহিম এভাবে ভাগ করে মেহমানদারি করেছিলেন। কিশোর ভাসানী দৃঢ় চিত্তে আপত্তি জানালেন এবং চাচার নির্মম ভর্ৎসনার শিকার হলেন। সেই যে সিরাজগঞ্জের ধানগড়া গ্রামের বাড়ি থেকে বের হলেন, আর কোনদিন ফিরে যাননি। সারা জীবন এ নৈতিক চেতনা তিনি লারন-পালন করেছেন। কখনো তিনি মানুষে শ্রেণিভেদ ও বৈষম্য মেনে নেননি। এ ধ্যান-ধারনাকে তিনি চরম অনৈতিক জ্ঞান করতেন। তাই তিনি চাইতেন, শিক্ষা-জীবনের শুরু থেকে অসাম্প্রদায়িকতা ও শ্রেণি-বৈষম্যহীনতার শিক্ষা এবং সে শিক্ষার পরিবেশ বজায় থাকুক।একে তিনি সুন্দর মানুষ হবার পূর্বশর্ত মনে করতেন।

পরবর্তী জীবনে এ চেতনাকে আরও বড় করে তিনি প্রতিষ্ঠিত করলেন। পারিবারিক পরিমন্ডল থেকে একে জাতীয় পর্যায়ে পৌঁছালেন। ৩০-এর দশকের শেষের দিকে মওলানা ভাসানীর প্রথম পুত্র মরহুম আজিজুল হক খাঁ-এর বয়স ১২ বা ১৩। তিনি সেদিনের দুরারোগ্য ব্যাধি টাইফয়েডে মৃত্যুবরণ করেন।এর অন্তরালে রয়েছে এক শোকগাথা। তখন আসামের গৌরিপুরের মহারাজার সাথে একটি হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা নিয়ে‘মওলানা ভাসানীর প্রত্যক্ষ লড়াই চলছিল। দক্ষিণ শালমারা নামক এলাকায়‘প্রজাবন্ধু হাইস্কুল’নামকরণে মওলানা ভাসানী যে প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন তাতে মহারাজার ছিল ঘোর আপত্তি। স্কুল প্রতিষ্ঠা শেষ পর্যন্ত মেনে নিলেও অন্তত ‘প্রজাবন্ধু’ নাম বদলাতে হবে, মহারাজার দাবি। মওলাপনা ভাসানী সে দাবি না মানতে লেলিয়া দেয়া হাতির পাল ঠেকাতে ব্রহ্মপুত্র বিধৌত দক্ষিণ শালমারায় যখন তিনি ব্যস্ত, তখন ব্রহ্মপুত্রের অপর পার হামিদাবাদ থেকে সংবাদ এল, স্নেহময় পুত্র গুরুতর অসুস্থ। রণে ভঙ্গ দিয়ে স্থান ত্যাগ করলে প্রজার নাম মুছে যাবে এ আশংকায় মওলানা ভাসানী যখন পিতৃ-বাৎসল্য চেপে রাকছেন, তখন খবর পৌঁছাল, আদরের আজীজুল আর নেই। না,তখনও তিনি আপন-ভূবন পানে তাকাননি, তাকিয়েছিলেন মজলুম প্রজাবৃন্দের দাবি প্রতিষ্ঠরি প্রতি। তাই সংবাদ বাহককে জানিয়ে দিয়েছিলেন, না, পুত্রের জানাজায় শরিক হবার ফুরসত নেই। আমার হয়ে সে কাজ তোমরা করো, তোমাদের কাজ আমি করছি। এই ছিল মওলানা ভাসানীর জীবন।

আজ যখন মওলানা ভাসানীর রেখে যাওয়া এ ক্যাম্পাসে একটি বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ণাঙ্গ রূপ ধারণ করার কর্মযঙ্গ চলছে, তখন মওলানা ভাসানীর আকুতির কথা খুব মনে পড়ে। জাতীয় রাজনীতিতে তিনি ৩০-৪০ দশক থেকেই ‘মওলানা ভাসানী’৫০-এর দশক থেকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে তিনি ‘মওলানা ভাসানী’-সেই মওলানা ভাসানী ৯৪ বছর বয়সে এসে সুদূরপ্রসারী কর্মপ্রবাহ শুরু করেছেন শিশু স্কুল দিয়ে-লক্ষ্য তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় নাগাদ পৌঁছাবেন। কেন এই উদ্যোগ নিলেন, জীবনসায়াহ্নে কেন তাগিদ অনুভব করলেন, তার ব্যাখ্যা তাঁর আহূত শিক্ষা সম্মেলনে সন্তোষের দরবার হলে বরেণ্য শিক্ষাবিদদের উপস্থিতিতে লিখিতভাবেই তিনি নিজেই জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন,“মদ চোলাইয়ের কারখানা হইতে যেমন কেহ দুধ প্রত্যাশা করে না, তেমনি কেরাণীকূল ও গোলামী মানসিকতা সৃষ্টির জন্য যে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তিত হইয়াছিল তাহা হইতে স্বাধীন,স্বাবলম্বী,পরিশ্রমী,সহানুভূতিশীল মানুষ সৃষ্টি সম্ভব নয়। তাই দেখা যায়,বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী যেসব ব্যক্তি দেশ চালাইতেছে তাদের অনেকেই দুর্নীতি, ঘুষ, সুদ, জুয়া ও মদের বন্যায় ভাসিয়া চলিয়াছে। নিজের সংকীর্ণ স্বার্থের কাছে দেশকে, দেশের মানুষকে বিকাইয়া দিতে কুন্ঠিত হইতেছে না। এই শিক্ষা মনুষ্যত্ববোধকে জাগ্রত করে না, বরং মানুষকে আত্মা ও স্বার্থ সর্বস্ব করিয়া তোলে। এই কারণেই বর্তমান শিক্ষায় উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিরা লক্ষ্য কোটি ভুখা-নাঙ্গা মানুষের ঝুপড়ির পাশে সুরম্য প্রাসাদে বিলসিতায় গা ঢালিয়া দিতে মোটেই লজ্জা বোধ করে না। এই সব লোকেরা শাসন যন্ত্রের বিভিন্ন ঘাঁটি দখল করিয়া ধনিক বণিকদের সঙ্গে যোগসাজশে সকল অর্থনৈতিক সুবিধা লুটিতেছে, আর যাহারা চাকুরী পাইতেছে না তাহারা নিজের জীবনকে ব্যর্থ মনে করিতেছে। উভয় দলই ধর্ম ও নৈতিকতাকে জলাঞ্জলি দিয়া ব্যক্তিগত মুনাফাকে শিক্ষার উদ্দেশ্য করিয়াছে। জীবনের সাথে এই শিক্ষার কোন যোগ না থাকায় শিক্ষিত শ্রেণি যারা নিজেদের ভদ্রলোক বলিয়া মনে করে, তারা কায়িক শ্রমকে নিন্দনীয় মনে করে এবং যেসব বৃত্তির সঙ্গে কায়িক শ্রম জড়িত রহিয়াছে তাহার প্রত্যেকটিকেই ঘৃণ্য মনে করে। এই শিক্ষা মানুষকে স্বাবলম্বী না করিয়া সম্পূর্ণভাবে কলম পেশা চাকুরীর উপর নির্ভরশীল তথাকথিত ভদ্রলোক করিয়া তোলে।

(সূত্রঃ নানান মাত্রায় মওলানা ভাসানী, লেখকঃ সৈয়দ ইরফানুল বারী)

এই বিভাগের আরও খবর