লালমনিরহাট বার্তা
পাহাড়ধস নিয়েও ব্যবসা!
ডয়চে ভেলে | ২৯ আগ, ২০২৩, ৪:৫৩ AM
পাহাড়ধস নিয়েও ব্যবসা!

চট্টগ্রামে আগে পাহাড় কাটা, পাহাড় দখলই চলতো দেদার, এখন কারো কারো জন্য পাহাড়ধসও হয়ে উঠছে লাভজনক। পাহাড়রক্ষার উদ্যোগ তাই কার্যত আরো কমেছে৷তাই প্রতি বছরই পাহাড়ধস হয়। মানুষ মারা যায়। কিছুদিন কথা হয়। তারপর আগের মতোই চলে সবকিছু। রবিবার চট্টগ্রামের ষোলশহরে পাহাড়ধসে বাবা ও মেয়ের মৃত্যুর পর আবারো তাই আলোচনায় এসেছে পাহাড়ধসের ঘটনা।

২০০৭ সালে চট্টগ্রামে ভয়াবহ পাহাড়ধসে ১২৯ জনের মৃত্যুর পর ‘পাহাড় রক্ষা’ কমিটি নামে একটি কমিটি করা হয়েছিলো। ওই কমিটির প্রধান ছিলেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল এবং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ( চুয়েট) তখনকার উপাচার্য (ভিসি) অধ্যাপক মো. মোজাম্মেল হক। তিনি সোমবার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা পাহাড় রক্ষায় ৩৬টি সুপারিশ করেছিলাম। আমাদের সুপারিশ ছিলো কীভাবে পাহাড় রক্ষা করা যায়। কিন্তু দেখলাম পাহাড় রক্ষায় কারো আগ্রহ নাই। বরং পাহাড় ধস হলে একটি মহলের অনেক লাভ। পাহাড় ধসে পড়লে সেটা দখল করা সহজ। সেখানে আবার বসতি গড়ে তোলা যায়। এটা বিশাল লাভের ব্যাপার।”

‘‘পাহাড়ধস হলে সেটা নিয়ে নানা প্রকল্প গ্রহণ করা যায়। উদ্ধারের জন্য অনেক যন্ত্রপাতি কেনা যায়। টেন্ডার হয়। এখানেও লাভ। পাহাড় ধস বন্ধ করতে হলে পাহাড় দখল বন্ধ করতে হবে। তাহলে ধস পরবর্তী ব্যবসাও হবে না। ফলে ধস বন্ধে কারো আগ্রহ নাই। তাই আমিও এটা নিয়ে আর কথা বলি না,” আক্ষেপ করে বলেন চুয়েটের সাবেক এই ভিসি।

তার কথা, ‘‘পরিকল্পিতভাবে বৈজ্ঞানিক উপায়ে চট্টগ্রামের পাহাড় কীভাবে রক্ষা করা যায়, কীভাবে ধস বন্ধ করা যায় আমরা তার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু সেটা ওই প্রস্তাব পর্যন্তই শেষ।”

চট্টগ্রাম ভিত্তিক বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরাম এবং বেলা জানায়, গত ১৬ বছরে চট্টগ্রামে পাহাড়ধসে ২৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে। বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরামের সাধারণ সম্পাদক এবং বেলার চট্টগ্রাম নেটওয়ার্কের সমন্বয়ক আলীউর রহমান জানান, ‘‘চট্টগ্রাম শহরে ১৩৫টির মতো পাহাড় ছিল৷ তার মধ্যে ৬০ শতাংশ পাহাড় দখল হয়ে গেছে। প্রভাবশালীরা এই পাহাড়গুলো দখল করে নিয়েছে। তারাই পাহাড়ে গরিব মানুষদের দিয়ে বসতি গড়ে তোলো। তারপর দখল করে নেয়।’’

তিনি বলেন, ‘‘চট্টগ্রামের পাহাড়তলি আকবর শাহ এলাকায় পাহাড় দখলের অভিযোগ যে ওয়ার্ড কাউন্সিলর জসিমের বিরুদ্ধে, তাকে আবার সিটি কর্পোরেশনের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভাপতি করা হয়েছে। টাইগারপাস এলাকায় পাহাড়ে সবচেয়ে বেশি জন বসতি৷ সেখানেই আবার সিটি কর্পোরেশনের অফিস বানানো হয়েছে।’’

২০০৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত চট্টগ্রামে কমপক্ষে ১৩ বার বড় ধরনের পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটেছে। আর এই পাহাড়ধস হয় বর্ষা মৌসুমে। চট্টগ্রামের পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির তথ্য মতে শহরের ২৫টি পাহাড়ে এখনো এক হজারের বেশি পরিবার বসবাস করছে। এর ৮০ ভাগই ভাড়ায় থাকেন। মূলত পাহাড়গুলো প্রভাশালীরা দখল করে ঝুপড়ি ঘর বানিয়ে নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে ভাড়া দেন। আর এটাই হলো পাহাড় দখলের একটি কৌশল। এর বাইরে উন্নয়নের নামে, স্থাপনা তৈরির নামে, পর্যটনের নামে পাহাড় দখল তো আছেই।

আলীউর রহমান বলেন, ‘‘চট্টগ্রাম শহরের পাহাড়গুলো বেলে-দোআঁশ মাটির। বৃষ্টি হলে গলে গলে পড়ে যায়। জেলা প্রশাসনের দায়িত্বে থাকা এই পাহাড়গুলোতে পরিকল্পিত বনায়ন করা হয়নি। ফলে দখল সহজ হয়েছে। একটির ওপর একটি ঝুপড়ি ঘর বানানো হয়েছে। ফলে বৃষ্টিতে পাহাড় ধসে পড়ে।’’

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান অবশ্য বলেন, ‘‘পাহাড়গুলোর মালিক জেলা প্রশাসন নয়। মালিক সরকারের বিভিন্ন দপ্তর ও প্রতিষ্ঠান। পাহাড়গুলো রক্ষার দায়িত্ব তাদের। তারা যদি রক্ষা না করে তাহলে তো এই পরিস্থিতি হবে। আমরা সর্বশেষ বৈঠকেও তাদের পাহাড় রক্ষার আহ্বান জানিয়েছি। তাদের পাহাড়গুলো কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখার জন্য বলেছি।”

তার কথা, ‘‘আমরা পাহাড়ে বসতি করার খবর পেলে ভ্রাম্যমাণ আদালত করে অভিযান চালাই। কিন্তু কিছুদিন পর তারা আবার ফিরে আসে। আমরা মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জরিমানা করতে পারি। কিন্তু মামলা করার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। তারা দায়সারা গেছের মামলা করলে তো হবে না। এতে মামলার সংখ্যা বাড়া ছাড়া আর কিছুই হয় না। ফলে প্রতিবছর বর্ষা আসলেই পাহাড়ধস হয়। মানুষ মারা যায়।”

এ নিয়ে বার বার চেষ্টা করেও চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের বক্তব্য জানা যায়নি। তবে জানা গেছে অধিদপ্তর ২০২১ এবং ২০২২ সালে পাহাড় দখলের অভিযোগে ২৬টি মামলা করেছে। তারা মামলা করেই তাদের দায়িত্ব শেষ করে বলে জানা যায়।

চট্টগ্রামের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীও পাহাড় রক্ষায় তার দায়িত্ব এড়িয়ে বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ‘‘পাহাড় তো পরিবেশের অধীনে। এগুলো রক্ষা করার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। আমাদের দায়িত্ব হলো, কেউ পাহাড়ে বসে গেলে উচ্ছেদ অভিযান চালাই। কিন্তু ছয় মাস পর তারা আবার ফিরে আসে।”

তার দাবি, ‘‘যারা পাহাড়ে বসতি স্থাপন করে তারা গরিব ও ছিন্নমূল মানুষ।”

কিন্তু খোদ সিটি কর্পোরেশন এবং কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে পাহাড় দখলের অভিযোগের কথা বললে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘‘ওয়ার্ড কাউন্সিলর কীভাবে দখল করেছেন আমি ঠিক জানি না। আর সিটি কর্পোরেশন পাহাড় কেটে কোনো রাস্তা করেনি। আমাদের কার্যালয় আসলে সাময়িকভাবে সরানো হয়েছে। কারণ পুরনো ভবন নতুন করে তৈরি করা হচ্ছে। ভবন তৈরি হলেই আমরা ফিরে আসবো।”

তবে এক পর্যায়ে তিনি বলেন, ‘‘প্রভাবশালীরা পাহাড় দখল করলে তো কেউ কিছু বলে না। চুপ থাকে। ঈগল টেক্সটাইলের পিছনে প্রভাবশালীরা অনেক পাহাড় দখল করছে। কেউ তো কিছু বলছে না। সবাই চুপ করে আছে।”

এই বিভাগের আরও খবর