দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এখন থেকে বিচারক ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে সরকারের অনুমতি ছাড়াই মামলা করতে পারবে। এমন বিধান রাখা হয়েছে ‘দুদক অধ্যাদেশ ২০২৫’-এর খসড়ায়, যা সম্প্রতি উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে নীতিগতভাবে অনুমোদন পেয়েছে।
নতুন এই অধ্যাদেশে ২০০৪ সালের দুদক আইনের ৩২(ক) ধারা বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছে। ওই ধারায় বলা ছিল, বিচারক বা সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করার আগে সরকারের অনুমতি নিতে হবে। এখন সেই বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়া হচ্ছে, ফলে দুদক সরাসরি মামলা করতে পারবে।
এই সংস্কারের প্রস্তাব এসেছে দুদক সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে। কমিশন গত ১৫ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়।
২০১৩ সালে শেখ হাসিনার সরকার ৩২(ক) ধারা যুক্ত করেছিল, যা নিয়ে তখন থেকেই সমালোচনা চলছিল। ২০১৪ সালে উচ্চ আদালত ধারাটিকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে বাতিলের নির্দেশ দিয়েছিল। দুর্নীতিবিরোধী মহল দীর্ঘদিন ধরে এর অপসারণ দাবি করে আসছিল।
দুদকের সাবেক মহাপরিচালক মঈদুল ইসলাম বলেছেন, “উচ্চ আদালতের রায়ের পর থেকেই ধারা কার্যত নিষ্ক্রিয় ছিল। এখন যদি সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে তা বাতিল করে, সেটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় সিদ্ধান্ত।”
অধ্যাদেশের খসড়ায় দুদকের কাঠামোতেও বেশ কিছু পরিবর্তনের প্রস্তাব রয়েছে। কমিশনারদের মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে কমিয়ে চার বছর করা হবে এবং তিন সদস্যের মধ্যে অন্তত একজন নারী থাকতে হবে।
কমিশন গঠনের জন্য সাত সদস্যের একটি নির্বাচনী কমিটি করার প্রস্তাব এসেছে। এর নেতৃত্বে থাকবেন আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারক। অন্য সদস্যদের মধ্যে থাকবেন একজন নারী বিচারক, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি বা বিচার কমিশনের চেয়ারম্যান, স্পিকারের মনোনীত সরকার ও বিরোধী দলের একজন করে সংসদ সদস্য এবং রাষ্ট্রপতি মনোনীত একজন সুশাসন বিশেষজ্ঞ।
সংসদ বিলুপ্ত থাকলে সংসদ সদস্যদের বাদ দিয়ে কমিটি গঠন করা যাবে। কমিটি গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে আবেদন গ্রহণ করবে এবং প্রার্থীদের জীবনবৃত্তান্ত, সম্পদ বিবরণী ও সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে কমিশনার নির্বাচন করবে। প্রার্থীর অন্তত ২০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান খসড়া অধ্যাদেশটিকে “উন্নত সংস্করণ” বলেছেন, তবে তিনি মনে করেন কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব বাদ পড়েছে। তার ভাষায়, “সরকার নিজেই সংস্কার কমিশন গঠন করেছে, আবার তার মূল প্রস্তাবগুলো উপেক্ষা করেছে—এটা সংস্কারবিরোধী দৃষ্টান্ত।”
তার মতে, কমিশনের জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা বাড়াতে ‘সিলেকশন অ্যান্ড রিভিউ কমিটি’, শর্টলিস্ট প্রার্থীদের নাম প্রকাশ এবং কমিশনারদের কর্মদক্ষতা মূল্যায়নের বিধান যুক্ত করা প্রয়োজন ছিল।
খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, যেখানে দুদকের জেলা কার্যালয় থাকবে, সেখানে বিশেষ জজ আদালত স্থাপন করা হবে। জেলা কার্যালয়গুলো সরাসরি অভিযোগ যাচাই করতে পারবে এবং যাচাই করা অভিযোগ পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজন হবে না।
এছাড়া দুদকের এখতিয়ার বাড়িয়ে দেশের বাইরে থাকা বাংলাদেশি নাগরিক ও বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশিদের দুর্নীতিও তদন্তের আওতায় আনা হয়েছে। ‘জ্ঞাত আয়’ বলতে বৈধ আয়ের সংজ্ঞা স্পষ্ট করা হয়েছে এবং মামলা, তদন্ত ও অনুসন্ধানের ক্ষমতা আরও বিস্তৃত করা হয়েছে।