মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৫, ৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
সর্বশেষ বিশেষ সংবাদ জাতীয় সারাদেশ আন্তর্জাতিক খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফস্টাইল আইন-আদালত মতামত অন্যান্য
/ জাতীয়

রংপুরে চোর সন্দেহে জামাই-শ্বশুরকে গণপিটুনি, নিহতের পরিবারের সড়ক অবরোধ


প্রকাশ :

রংপুরের তারাগঞ্জে চোর সন্দেহে জনতার হাতে নৃশংস গণপিটুনিতে প্রাণ হারালেন জামাই-শ্বশুর। নিহত দুইজনই এলাকার পরিচিত মানুষ ছিলেন। এ ঘটনার পর ক্ষুব্ধ স্বজন ও এলাকাবাসী মরদেহ নিয়ে রংপুর–দিনাজপুর মহাসড়ক অবরোধ করে বিচারের দাবি জানান। প্রায় আধা ঘণ্টা অবরোধের পর পুলিশের অনুরোধে বিক্ষোভকারীরা সড়ক ছেড়ে দেন।

নিহতরা হলেন—তারাগঞ্জ বাজারের জুতা মেরামতের কারিগর রুপলাল দাস (৪০) এবং তাঁর ভাগ্নি জামাই মিঠাপুকুর উপজেলার অটোরিকশাচালক প্রদীপ দাস (৪৫)। তাঁরা সম্পর্কে জামাই-শ্বশুর হলেও পারিবারিক সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। শনিবার (৯ আগস্ট) রাত সাড়ে ৯টার দিকে উপজেলার সয়ার ইউনিয়নের বুড়িরহাট বটতলা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

ঘটনার সূত্রপাত বিয়ের আলাপ থেকে

পরিবার সূত্রে জানা যায়, রুপলালের মেয়ের শ্যামপুর এলাকার লালচাঁদ দাসের ছেলের সঙ্গে বিয়ের সমন্ধের কথা ছিল। রোববার দিন তারিখ চূড়ান্ত করার কথা ছিল। এ জন্য প্রদীপ দাস শনিবার রাতে মিঠাপুকুর থেকে নিজের ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিয়ে রুপলালের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। পথে দিক ভুলে তিনি বুড়িরহাট বটতলা মোড়ে পৌঁছান এবং রুপলালকে ফোন করে সেখানে আসতে বলেন। রুপলাল এসে তাঁকে নিয়ে একই অটোরিকশায় বাড়ির পথে রওনা দেন।

কিন্তু রাত গভীর হওয়ার আগেই ঘটে যায় ভয়াবহ ঘটনা। স্থানীয় কিছু মানুষ তাঁদের ভ্যানচোর সন্দেহে আটক করে। অটোরিকশার ভেতরে থাকা চারটি ছোট প্লাস্টিকের বোতল থেকে তীব্র গন্ধ ছড়িয়ে পড়লে সন্দেহ আরও বেড়ে যায়। বোতলের গন্ধে দুজন স্থানীয় ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতে জনতার মধ্যে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে তাঁরা অজ্ঞান পার্টির সদস্য। মুহূর্তেই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে এলাকায়।

মৃত্যুর আগে নির্মম নির্যাতন

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, উত্তেজিত জনতা রুপলাল ও প্রদীপকে বটতলা থেকে বুড়িরহাট উচ্চবিদ্যালয় মাঠে নিয়ে যায়। সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নির্মম মারধরের শিকার হন তাঁরা। একপর্যায়ে অচেতন হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন দুজনেই। রাত ১১টার দিকে খবর পেয়ে পুলিশ তাঁদের উদ্ধার করে তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক রুপলালকে মৃত ঘোষণা করেন। গুরুতর আহত প্রদীপকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হলে রবিবার ভোরে সেও মারা যান।

দুই পরিবারে এখন হাহাকার

রুপলালের স্ত্রী মালতী রাণী দাস ভেঙে পড়া কণ্ঠে বলেন, “আমার স্বামী কোনো অপরাধ করেনি। মানুষ ভুল বোঝে ওদের পিটিয়ে মেরে ফেলল। এখন আমি আমার স্বামী আর শ্বশুর—দুজনকেই হারালাম।” নিহতদের স্বজনদের দাবি, উদ্ধার হওয়া বোতলে চোলাই মদ ছিল, কিন্তু তার সঙ্গে চুরি বা অজ্ঞান পার্টির কোনো সম্পর্ক নেই।

তারাগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এম.এ. ফারুক বলেন, “গণপিটুনিতে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। নিহত রুপলালের স্ত্রী বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। ঘটনার সব দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে। জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে।”

এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে স্থানীয় জনমনে তীব্র ক্ষোভের পাশাপাশি ভয়ও ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকের প্রশ্ন—গুজবের ভিত্তিতে গণপিটুনি দিয়ে কাউকে হত্যা করা কতটা ন্যায্য? সামাজিকভাবে এমন প্রবণতা দমন না হলে নিরপরাধ মানুষও যে কোনো সময় জনতার রোষে প্রাণ হারাতে পারে।