রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর ফটকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন চলাকালে নিহত শিক্ষার্থী আবু সাঈদের ময়না তদন্ত প্রতিবেদনে হোমিসাইডাল বা হত্যাকান্ড হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। শরীরে মিলেছে শটগানের গুলির চিহ্ন ও মাথার তালুতে ময়না তদন্ত রিপোর্র্ট অনুযায়ী সে গুলিতে নয় মাথায় আঘাতের কারণে মারা গেছে।মাথার তালুতে ৩ ইঞ্চি ঢ ১.৫ ইঞ্চি আকারের আঘাতের চিহ্ন। এতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আড়াই মাস পর পাওয়া ময়না তদন্তের রিপোর্টে এসব তথ্য প্রকাশ পেয়েছে।রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ময়না তদন্তের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,আবু সাঈদের কানের ওপরের দিকে মাথার খুলিতে দৈর্ঘ্যে ৩ ইঞ্চি ও প্রস্থে দেড় ইঞ্চি আয়তনের গর্ত ছিল, যেখান থেকে রক্ত ক্ষরণ হয়েছে এবং রক্ত জমাট বাঁধা ছিল। এ ছাড়া বুক, পেট, পা সহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য ছোট ছোট রাবার বুলেটের গর্ত ছিল। সেখান থেকেও প্রচুর রক্ত ক্ষরণ হয়েছে। মাথার আঘাত, শরীরের রক্তক্ষরণের কারণে আবু সাঈদ শকে চলে যায়। এতে সে মৃত্যু কোলে ঢলে পড়ে।সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) রাতে গণমাধ্যমের হাতে আসা আবু সাঈদের ময়না তদন্তের প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা যায়।গত ১৬ জুলাই রাত ১১টা ৫০ মিনিটে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আবু সাঈদের লাশের ময়না তদন্ত করা হয়। ময়না তদন্তের প্রতিবেদনে এটিকে হোমিসাইডাল বা হত্যাকান্ড হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
আবু সাঈদ হত্যা মামলার প্যানেল আইনজীবী রোকনুজ্জামান রোকন বলেন, মাথার আঘাতের চিহ্ন সুস্পষ্ট। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় গুলির ক্ষত। সবকিছু মিলে ময়না তদন্ত রিপোর্ট প্রমাণ করে, এটি হত্যাকান্ড। এ হত্যা কান্ডের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের কেউ ছাড়া পাবে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, ময়নাত দন্তের প্রতিবেদন অনুযায়ী আবু সাঈদের মাথায় আঘাতে একটি বড় ক্ষত (গর্ত) হয়েছিল।বুলেটের আঘাতে মৃত্যু হলে বুলেট তার মাথার এক পাশে লেগে অন্য পাশের্^দিয়ে বের হয়ে যেত। যেহেতু এমনটি ময়না তদন্তে উল্লেখ নেই তাহলে এটি কোনো ঢিলের আঘাতে হতে পারে।এ ব্যাপারে ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডাঃ রাজিবুল ইসলামকে মোবাইল ফোন করে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
আবু সাঈদের সহপাঠীরা এ হত্যাকান্ডের দ্রæত বিচার দাবি করেছেন।এ হত্যাকান্ডের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দায়ী।আমাদের চাওয়া, সুষ্ঠু বিচারিক প্রক্রিয়ায় দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা হোক।
গত ১৬ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন আবু সাঈদ। তিনি রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন।বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন।আবু সাঈদের মৃত্যুর ঘটনায় গত ১৮ আগস্ট রংপুর মেট্রোপলিটন আমলি আদালতে হত্যা মামলা করেন তার বড় ভাই রমজান আলী। মামলায় ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরও ৩০-৩৫ জনকে আসামি করা হয়।আসামিরা হলেন পুলিশের সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, রংপুর ডিআইজি আব্দুল বাতেন, রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মনিরুজ্জামান, উপ-পুলিশ কমিশনার আবু মারুফ হোসেন, সহকারী পুলিশ কমিশনার আরিফুজ্জামান, সহকারী পুলিশ কমিশনার ইমরান হোসেন,তাজহাট মেট্রো থানার ওসি রবিউল ইসলাম, পুলিশের এএসআই সৈয়দ আমীর আলী ও সুজন চন্দ্র রায়,রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ সভাপতি পোমেল বড়–য়া, সাধারণ সম্পাদক শামিম মাহফুজ, ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক বাবুল হোসেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আসাদ মন্ডল, গণিত বিভাগের শিক্ষক মশিউর রহমান, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিসের কর্মকর্তা রাফিউল হাসান রাসেল, বিশ্ববিদ্যালয়ের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ বিভূতি ভূষণ কে আসামি করা হয়েছে।এই মামলায় পুলিশ সদস্য এএসআই মোঃ আমীর আলী ও সুজন চন্দ্র রায় কে গ্রেফতার করে রংপুর জেলা পিবিআই পুলিশ।গত ৯ সেপ্টেম্বর সোমবার রাতে বিষয়টি নিশ্চিত করেন রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিসি হেডকোয়ার্টার্স আবু বক্কর সিদ্দিক ও পিবিআই পুলিশ সুপার মোঃ জাকির হোসেন।
রংপুরে আবু সাঈদ নিহতের ঘটনায় বেরোবির তদন্ত কমিটি গঠনঃ
রংপুরে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে আবু সাঈদ নিহতের ঘটনায় বেরোবির তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।গতকাল সোমবর সন্ধায় বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন,বেগম রোকেয়া বিশ^বিদ্যালয় অতিরিক্ত পরিচালক (জনসংযোগ) ও অফিস প্রধান জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা বিভাগের মোহাম্মদ আলী।
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ^বিদ্যালয়ে (গত ১৬ জুলাই) বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মোঃ আবু সাঈদ নিহত হওয়ার ঘটনায় বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জড়িতদের (শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারী) চিহ্নিত করণ ও শাস্তির ধরণ নির্ধারণের জন্য এই তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।কমিটিতে প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. মোঃ মিজানুর রহমান আহŸায়ক, একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোঃ আমির শরীফ সদস্য এবং বিশ^বিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. মোঃ ফেরদৌস রহমান সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। কমিটিকে আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
প্রসঙ্গত,গত ১৬ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নিয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর ফটকে পুলিশের গুলিতে নিহত হন আবু সাঈদ। তার গুলিবিদ্ধ হওয়ার ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে সোচ্চার হন বহু মানুষ, এতে আরও গতিশীল হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন।