শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ২ ফাল্গুন ১৪৩১
সর্বশেষ বিশেষ সংবাদ জাতীয় সারাদেশ আন্তর্জাতিক খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফস্টাইল আইন-আদালত মতামত অন্যান্য
/ বিশেষ সংবাদ

সারাদেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ও মৃত্যুহার বাড়ছে, আক্রান্তদের রয়েছে বিপজ্জনক উপসর্গ


প্রকাশ :

সারাদেশে আশঙ্কাজনক ভাবে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তর সংখ্যা যে ভাবে বাড়ছে সেইসাথে বাড়ছে মৃত্যুর হারও। যারা হাসপাতালে ভর্তি তাদের বেশিরভাগেরই রয়েছে বিভন্ন বিপজ্জনক উপসর্গ। গত দুই বছরের তুলনায় এ বছর ডেঙ্গু রোগে মৃত্যুর হার অনেক বেড়েছে। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহ মারা গেছেন ৩০ জন। এ বছর এখন পর্যন্ত ১শত ৯৩ জন মারা গেছেন। অক্টোবরের প্রথম সাতদিনে সারা দেশে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে প্রায় সাত হাজার মানুষ। গত মাসের প্রথম সপ্তাহে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয় ২ হাজার ৩শত ৬৬ জন। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ৭ অক্টোবর ঢাকা মহানগরীতেই প্রায় ৪শত ৪৫ জন নতুন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং সারা দেশে ভর্তি হয়েছেন ৭৭৩ জন। অন্যদিকে, এই সপ্তাহে এ বছরের জানুয়ারি থেকে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৭ হাজার ৮০৮ জন। 

প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। ২০০০ সালের পর থেকে গত দুই দশকে ২০২৩ সালে এবং চলতি বছরে বেড়েছে ডেঙ্গুর সংক্রমণ এবং সংক্রমিত হয়ে মৃত্যুহার। বিগত কয়েক বছরে জুলাই মাস থেকেই ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং কমতে শুরু করে পরের বছর  ফেব্রæয়ারি-মার্চ মাসে। কিন্তু, ২০১৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত, অন্য বছরের তুলনায় সারা বছরই হাসপাতালে ভর্তি হতে দেখা যায় ডেঙ্গু রোগী। 

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মেডিসিন বিভাগের সহকারি অধ্যাপক মুহাম্মদ মাহ্ফুজুল হক জানান, প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা এবং যারা হাসপাতালে ভর্তি তাদের বেশিরভাগেরই রয়েছে বিভন্ন বিপজ্জনক উপসর্গ।

যাদের ডেঙ্গুর সাথে বিপজ্জনক উপসর্গ বা ‘শক সিনড্রোম’ আছে, অথবা অন্য একটি রোগ আছে - যার কারণে রোগীর অবস্থা খারাপ হতে পারে। যেমন কারো হার্টের সমস্যা, কারো কিডনির সমস্যা, কারো অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, অথবা কারো প্রেগন্যান্সি - এই জাতীয় ক্ষেত্রে, আমরা হাসপাতালে পর্যবেক্ষণে রাখি৷ তবে যে-কোনো অবস্থায় ডেঙ্গু রোগীর অবস্থা খারাপ হতে পারে বলে জানান সহকারী অধ্যাপক মুহাম্মদ মাহ্ফুজুল হক।

কেন বাড়ছে সংক্রমণ এবং মৃত্যুহার?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়ার অন্যতম প্রধাণ কারণ হলো, সময়মতো বিপদচিহ্ণ শনাক্তে ব্যার্থ হয়ে সঠিক সময়ে হাসপাতালে না আসা এবং সর্বোপরি ডেঙ্গু মশা নিধনে অব্যবস্থাপনা।

কীটতত্ত্ববিদ, এবং গবেষক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. কবিরুল বাশার জানান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেল্থ ইমার্জেন্সি অপারেশন এবং কন্ট্রোল রুমের যে তথ্য আমরা পাই, তা ৭৭ টি হাসপাতালের এবং ৬৪ জেলার সিভিল সার্জনদের পাঠানো তথ্য। কিন্তু, এর বাইরেও বিভিন্ন ছোট-বড় ক্লিনিক এবং বাড়িতেও অনেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘‘ধারণা করা হয়, যেই হিসাবটি এখানে দেখানো হয়, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি রোগী থাকে৷ সেই সংখ্যাটা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে নেই। ’’

বাংলাদেশে পুরুষের তুলনায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত নারীর সংখ্যা কম হলেও ডেঙ্গুতে মৃত নারীর সংখ্যা অনেক বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, এই বছর ডেঙ্গু রোগীদের মধ্যে নারী রোগীদের মৃত্যুই বেশি, যা মোট মৃতের ৫০ দশমিক ৯ শতাংশ। কারণ উল্লেখ করে  ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘‘বাংলাদেশের নারীরা হাসপাতালে যাওয়ার প্রতি তাদের অনীহা কাজ করে। তারা সবার আগে পরিবারের যতœ নেয়াকে গুরুত্ব দেয়। এছাড়াও, বাংলাদেশের নারীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, এবং গর্ভধারণকালীন বা মাসিকচলাকালীনও তাদের ইমিউন সিস্টেমটা দুর্বল হয়ে যায়, যার কারণে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে নারী মৃত্যুর সংখ্যা বেশি।’’

ড. কবিরুল বাশার গত ২৫ বছর ধরে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মশা ও মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কাজ করছেন। সক্রমণ বাড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ”বর্ষাকালে যেহেতু বৃষ্টির পানি জমা হয়, তাই প্রজনন স্থল বেড়ে যায়। তবে শীতকালেও এডিস মশার প্রজনন এবং ডেঙ্গুর সংক্রমণ হয়ে থাকে। বাংলাদেশের শহররগুলোতে নিরবিচ্ছিন্ন পানি সরবরাহ না থাকার কারণে নগরবাসী বিভিন্ন পাত্রে পানি জমিয়ে রাখতে বাধ্য হয়। আবার শীতকালে নির্মাণ কাজ বেড়ে যাওয়ার কারণেইনির্মাণাধীন ভবনের বেজমেন্টে জমা পানি, লিফ্টের গর্ত, ইট এবং টাইলস ভেজানোর চৌবাচ্চা ইত্যাদি জায়গায় জমে থাকা পানিতে এডিস মশার প্রজনন হয়। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই একটি চ্যালেঞ্জ। এডিস মশার নিয়ন্ত্রণকে যদি চাকুরি হিসাবে নেয়া হয়, তাহলে এটি কোনোদিনই নিয়ন্ত্রণ হবে না। ২০০০ সাল থেকে যে গতানুগতিক পদ্ধতিতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হতো সেভাবে যে সম্ভব নয় তা আমরা বিগত ২৫ বছরে প্রমাণ পেয়েছি।’’

ঢাকায় বসবাসরত অনেকেই দ্বিতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত

ঢাকাবাসীদের অনেকেই দ্বিতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন। কোনো পরিবারের কোনো সদস্যের পূর্বে ডেঙ্গু হয়ে থাকলে, সেই পরিবারে অন্য সদস্যদের পরবর্তীতে ডেঙ্গু হওয়ার আশঙ্কা থাকে। 

বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের বুলেটিনে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, ডেঙ্গু রোগীদের  ৮৩ শতাংশের সম্ভাবনা থাকে আবারো ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মেডিসিন বিভাগের সহকারি অধ্যাপক মুহাম্মদ মাহ্ফুজুল হক ২০১৫ সাল থেকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি ডয়েচে ভেলেকে বলেন, ‘‘যারা ঢাকার শহরাঞ্চলে থাকেন, তাদের অনেকেরই পূর্বে ডেঙ্গুর ইতিহাসটা পাওয়া যায়। আর যারা ঢাকার পেরিফেরি থেকে আসছে, তাদের অনেকেরই প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হচ্ছে। তবে একটি লক্ষণীয় বিষয় হলো, প্রথম যারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আসছে, বা আগে যাদের ডেঙ্গু ছিল, তাদের অনেকেরই লক্ষণগুলো প্রকাশ না পাওয়ার জন্য, তারা পূর্বে ডেঙ্গু রোগী হিসেবে ডায়াগনোসিসে না থাকতে পারেন। হয়তো কখনো তাদের ডেঙ্গু হয়েছিল, তা বুঝতে পারেনি।’’

গতবছর এবং এই বছর ডেঙ্গুতে শক সিনড্রমের মাত্রা বেশি বলে জানান তিনি। বিশেষ করে যাদের ডেঙ্গুর পূণরাবৃত্তি হয়, সেসব ক্ষেত্রে রোগীদের মধ্যে শক সিনড্রম দেখা যায়। ‘‘তীব্র পেটে ব্যথা, বারবার বমি হওয়া যা ঔষধ খেয়েও কমছে না, পাতলা পায়খানা - বিশেষ করে যদি তিন-চারবারের বেশি, কোথাও থেকে, যদি ব্লিডিং হয়, যদি কারো প্রস্রাব কমে যায়, বা কারো যদি পেট ফুলে যায়, অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। ডেঙ্গু রোগীদের এই ধরনের উপসর্গ থাকলে, আমরা দ্রæত তাদের হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যোগাযোগ করতে বলি,’’ জানান ড. মুহাম্মদ মাহ্ফুজুল হক। 

এছাড়াও গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন ডেঙ্গু রোগের সঠিক ব্যবস্থাপনা যা কমাতে পারে মৃত্যুহার। অনেক সময় অপ্রয়োজনীয় বা অতি চিকিৎসা ক্ষতির কারণ হতে পারে। এছাড়া, অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসাও পরিহার করতে বলেন তিনি।