পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে বেড়ে ওঠা ২৫ বছর বয়সী মাহনূর ওমর নিজের কৈশোরের বিব্রতকর অভিজ্ঞতাকে রূপ দিয়েছেন এক ঐতিহাসিক আইনি লড়াইয়ে। নারীর মাসিক স্বাস্থ্যসেবা পণ্যের ওপর সরকারের আরোপিত করকে তিনি চ্যালেঞ্জ করেছেন আদালতে।
সম্প্রতি মাহনূর লাহোর হাই কোর্টে আবেদন করেছেন, যেখানে তিনি দাবি করেছেন— স্যানিটারি প্যাডের ওপর আরোপিত সরকারি কর সাংবিধানিকভাবে বৈষম্যমূলক এবং তা বাতিল করা উচিত। তার ভাষায়, এই কর আসলে নারীর ওপর অন্যায্য ‘পিরিয়ড ট্যাক্স’।
আলজাজিরার তথ্যমতে, মাহনূর স্মরণ করেন— স্কুলজীবনে মাসিকের সময় টয়লেটে যাওয়ার আগে জামার হাতায় ন্যাপকিন লুকিয়ে নিতে হতো। মনে হতো যেন কোনো অপরাধ করছেন। “আমি যেন টয়লেটে মাদক নিয়ে যাচ্ছি,” বলেন তিনি।
মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা মাহনূর দেখেছেন, মাসিক নিয়ে কথা বললেই শিক্ষকরা চুপ করিয়ে দিতেন। এক সহপাঠী একবার বলেছিল— তার মা ন্যাপকিন কেনাকে ‘অর্থের অপচয়’ মনে করেন। সেই কথাই মাহনূরকে নাড়িয়ে দেয়। তিনি ভাবতে শুরু করেন, যদি মধ্যবিত্ত পরিবারের অবস্থাই এমন হয়, তাহলে নিম্ন আয়ের নারীদের অবস্থা কেমন!
ইউনিসেফ পাকিস্তানের তথ্য অনুযায়ী, স্থানীয় করসহ স্যানিটারি ন্যাপকিনে মোট কর প্রায় ৪০ শতাংশ। মাহনূরের পিটিশনে বলা হয়েছে, এটি সংবিধানের সেই ধারাগুলোর পরিপন্থী, যেগুলো সাম্য, মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার কথা বলে।
দেশটিতে মাসিক নিয়ে কথা বলা এখনো নিষিদ্ধ। ফলে এসব কর নারীদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা পণ্যকে আরও অপ্রাপ্য করে তুলছে। বর্তমানে এক প্যাকেট ন্যাপকিন কিনতে প্রায় ৪৫০ রুপি (১.৬ ডলার) খরচ হয়। যেখানে মাসিক মাথাপিছু আয় মাত্র ১২০ ডলার— সেখানে এটি অনেক পরিবারের কাছে বিলাসপণ্য।
২০২৪ সালে ইউনিসেফ ও ওয়াটারএইডের এক গবেষণায় দেখা যায়, পাকিস্তানের মাত্র ১২ শতাংশ নারী বাণিজ্যিকভাবে তৈরি ন্যাপকিন ব্যবহার করেন। বাকিরা কাপড় বা অন্য উপকরণে নির্ভরশীল। অনেকের কাছে পরিচ্ছন্ন পানি পর্যন্ত নেই।
দস্তক ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক হিরা আমজাদ বলেন, “এই মামলাটি সফল হলে নারীদের জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিন অনেক বেশি সাশ্রয়ী হবে।”
আইনজীবী ও অধিকারকর্মীরা বলছেন, এটি কেবল একটি মামলা নয়, বরং নারীর মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রশ্ন। আদালতে মামলাটির নাম রাখা হয়েছে ‘মাহনূর ওমর বনাম পাকিস্তান সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা’। কিন্তু মাহনূরের কাছে এটি “নারী বনাম পাকিস্তান”।
ছোটবেলা থেকেই নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করার স্বপ্ন দেখতেন মাহনূর। রাস্তাঘাটে, গণমাধ্যমে ও ঘরে নারীদের প্রতি বৈষম্য তাকে ন্যায়বিচারের পথে দাঁড় করিয়েছে। তিনি বলেন, “এই সহানুভূতি আর সচেতনতার শিক্ষা আমি মায়ের কাছ থেকেই পেয়েছি।”
বর্তমানে মাহনূর পাকিস্তানের ক্রসরোড কনসালট্যান্ট নামের প্রতিষ্ঠানে লিঙ্গ ও ফৌজদারি বিচারবিষয়ক পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন। ১৯ বছর বয়সে তিনি ‘অওরাত মার্চ’-এ যোগ দেন এবং ১৬ বছর বয়সে শুরু করেন মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ। নিজের তহবিল দিয়ে ৩০০টির বেশি ‘ডিগনিটি কিট’ তৈরি করে নিম্নআয়ের নারীদের মধ্যে বিতরণ করেন।
২০২৫ সালের শুরুতে সুপ্রিম কোর্টে ল’ ক্লার্ক হিসেবে কাজ শুরু করার পর তার জীবনে বড় পরিবর্তন আসে। বর্তমানে তিনি লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসে লিঙ্গ, শান্তি ও নিরাপত্তা বিষয়ে স্নাতকোত্তর করছেন।
কর ও সংবিধান–সংক্রান্ত আইনের বিশেষজ্ঞ আহসান জাহাঙ্গীর খানের সঙ্গে পরিচয়ের পরই ‘পিরিয়ড ট্যাক্স’ চ্যালেঞ্জের ধারণাটি আসে। আহসান এখন এই মামলার সহ–আবেদনকারী।
তার ভাষায়, “এ লড়াই শুধু স্যানিটারি ন্যাপকিনের দাম কমানোর জন্য নয়, এটি মূলত ন্যায়বিচারের লড়াই। কারণ এটি এক প্রাকৃতিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার ওপর কর।”
মাহনূরও একমত। তিনি বলেন, “আমরা চাই, নারীরা যেন তাদের শরীর নিয়ে লজ্জা নয়, অধিকার নিয়ে কথা বলতে পারে।”