শুক্রবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৫, ২৩ কার্তিক ১৪৩২
সর্বশেষ বিশেষ সংবাদ জাতীয় সারাদেশ আন্তর্জাতিক খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফস্টাইল আইন-আদালত মতামত অন্যান্য
/ জাতীয়

রংপুর অঞ্চলে তিস্তা নদী জীবন রেখা বিপর্যয়ের মুখে: এস এম শফিকুল ইসলাম


প্রকাশ :

তিস্তা নদী একসময় উজান ও ভাটিতে সমানভাবে প্রবাহমান ছিল। এক সময়ের এই নদীতে স্টিমার, নৌযান ও পালতোলা বড় বড় বাণিজ্যিক নৌকা চলাচল করত। যাতায়াত এবং মালামাল পরিবহনের প্রধান মাধ্যম ছিল নৌপথ। সেই সময় তিস্তার তীরবর্তী এলাকায় গড়ে উঠেছিল নদীবন্দর এবং বড় ব্যবসাকেন্দ্র। এখন সেই সব চিত্র কল্পনাই থেকে গেছে।

গত ০১ নভেম্বর বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলন এর আয়োজনে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বার অডিটোরিয়ামে নদী রক্ষায় চাই রাজনৈতিক অঙ্গীকার শীর্ষক জাতীয় নদী কনভেনশনে সংগঠনের সিনিয়র সহ-সভাপতি গেরিলা লিডার এস এম শফিকুল ইসলাম কানু প্রথম অধিবেশনে আলোচকের বক্তব্যে এসব কথা বলেন। 

এ সময় তিনি আরো বালেন , তিস্তা নদী উত্তর জনপদের রংপুর অঞ্চলের প্রাণনালী। কিন্তু উজানের দেশ ভারত আন্তর্জাতিক পানি প্রবাহ আইন অমান্য করে তিস্তা বাঁধ, ড্যাম ও জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করেছে। ফলে নদীর স্বাভাবিক পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ক্রমেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জলবায়ুর অভিঘাতে রংপুর অঞ্চলের মানুষের জীবনে নেমে এসেছে সীমাহীন দুর্ভোগ।

তিস্তা এখন দুই কোটি মানুষের জন্য মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। বর্ষাকালে মানুষ বন্যায় ভাসে, শুষ্ক মৌসুমে পানির জন্য হাহাকার করে। নদী ভাঙনের কারণে প্রতিবছর হাজার হাজার পরিবার উদ্বাস্তু হয়ে পড়ছে। তারা সর্বস্ব হারিয়ে শহরের মহাসড়কের পাশে, গলির ধারে, গাছতলায়, ফুটপাতে বা নর্দমার ধারে অস্থায়ী টঙঘরে আশ্রয় নিচ্ছে। এই মানুষদের স্ত্রী ও সন্তানরা গৃহকর্মী বা শিশু শ্রমিক হিসেবে জীবন বেছে নিতে বাধ্য। নিপীড়ন, নির্যাতন, ধর্ষণ এবং হত্যার শিকার হলেও তারা বিচার পান না।

সংবিধানের ১৩ ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। তাই ভূমিহীন বা সম্পদহীন হওয়া সংবিধানের পরিপন্থী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমি আইন সংস্কার এবং নদীর সীমানা ও পরিবেশ সুরক্ষার জন্য ১৯১৭ সালের বিধান অনুসরণ করে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আইন প্রণয়ন জরুরি। সরকারি সহায়তা অত্যন্ত অপ্রতুল এবং দীর্ঘসূত্রী।

প্রতি বছর বন্যা, নদী ভাঙন ও খরার কারণে রংপুর অঞ্চলে কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। নদীতে পানি না থাকায় মাছের প্রজনন কমে যাচ্ছে, ফলে মাছের আকাল দেখা দিচ্ছে। একসময় বৈরালী মাছের জন্য সুপরিচিত এই নদীতে এখন তা প্রায় বিলুপ্ত। বৈরালীসহ দেশীয় মাছ রোগ প্রতিরোধ ও ঔষধি গুণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

অর্ধশতাব্দী পার হলেও তিস্তার পানি বণ্টন সমস্যার সমাধান হয়নি। দেড় যুগ পরেও পানি প্রবাহ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করছে। এই পরিস্থিতিতে তিস্তা নদীর সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের জন্য তিস্তা মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। চীন ২০২২ সালে এ প্রস্তাব দেয়।

প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হলো নদীর উভয় তীরে ২২০ কিলোমিটার তীররক্ষা নির্মাণ, ৭৩ কিলোমিটার নদীখনন, জলাধার নির্মাণ, শাখা নদী খনন, পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন এবং শিল্প অঞ্চল গড়ে তোলা। এতে কয়েক লাখ হেক্টর জমি উদ্ধার ও সেচ সুবিধা সম্প্রসারিত হবে, ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে এবং লাখো মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এতে রংপুর অঞ্চলের দারিদ্র্যতা কমার সম্ভাবনা রয়েছে। উল্লেখযোগ্য, দেশের দশটি দরিদ্র জেলার মধ্যে রংপুর বিভাগে পাঁচটি জেলা এবং চারটি জেলা তিস্তা তীরবর্তী।

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চীনের সঙ্গে সম্পাদিত তিস্তা মহাপরিকল্পনার এমওইউ নবায়ন করেছে। ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে কাজ শুরু করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তবে তিস্তা পাড়ের মানুষ এখনো শঙ্কামুক্ত নয়। পূর্ববর্তী সরকার প্রতিশ্রুতি দিলেও প্রকল্প বাস্তবায়ন করেনি।

তিস্তা অববাহিকার দুই কোটি মানুষ বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন, স্তব্ধ কর্মসূচি ও মশাল প্রজ্জ্বলনসহ নানা কর্মসূচি চালাচ্ছে। তারা নির্বাচন তফসিল ঘোষণার আগেই তিস্তা মহাপরিকল্পনার কাজ শুরু করার আহ্বান জানিয়েছে।

দশ বছর মেয়াদী প্রকল্পে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। সরকার চীনের কাছে ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ঋণ চেয়েছে। বাকি অর্থের জন্য বিদেশি সহায়তার অপেক্ষা না করে নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবি তুলেছে রংপুর অঞ্চলের মানুষ। প্রয়োজনে সঞ্চয়পত্রের মতো তিস্তা বন্ড চালু করার প্রস্তাবও করা হয়েছে।

রংপুর অঞ্চলের মানুষ তিস্তা মহাপরিকল্পনার পাশাপাশি ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করার জন্য জাতীয় পরিকল্পনা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং টেকসই পরিকল্পনা অপরিহার্য বলে তারা মনে করছে।