শনিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১
সর্বশেষ বিশেষ সংবাদ জাতীয় সারাদেশ আন্তর্জাতিক খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফস্টাইল আইন-আদালত মতামত অন্যান্য
/ আইন-আদালত

গণহত্যার দায়ে শুরুতেই বিচার হবে শেখ হাসিনার


প্রকাশ :

ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঠেকাতে হত্যা, গণহত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে করা মামলার বিচার আনুষ্ঠানিক (অভিযোগ দাখিল ও গঠন, সাক্ষ্যগ্রহণ, যুক্তিতর্ক) শিগগির শুরু হতে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পর্যায়ক্রমে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সংঘটিত গুমের ঘটনা নিয়ে অভিযোগেরও বিচার হবে। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে আনুষ্ঠানিক বিচারকাজ শুরু হবে। বিচারকাজ শুরুর পর আগামী ছয় মাসের মধ্যে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আরও অনেকের রায়ের প্রত্যাশা করছে প্রসিকিউশন।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল), ১৯৭৩ আইনটি করা হয়। ২০১০ সালের মার্চে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে ট্রাইব্যুনাল গঠন হওয়ার পর এই আইনে বিভিন্ন সময়ে জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির শীর্ষ কয়েকজন নেতার ফাঁসির আদেশ ও তা কার্যকর হয়। সময়ের পরিক্রমায় এখন গণহত্যার অভিযোগে আওয়ামী লীগের তৈরি আইনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার হচ্ছে। বিভিন্ন সংস্থার হিসাবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে এখন পর্যন্ত হাজারের বেশি মানুষ নিহতন হয়েছে। যাদের বেশিরভাগের মৃত্যু হয়েছে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে। আহত হয়েছেন ২০ হাজারের বেশি মানুষ। আহতদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়েছেন। এরই মধ্যে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা অন্তত ১০০ জন আহত ব্যক্তির জবানবন্দি নিয়েছে। আহত আরও অনেকের জবানবন্দি নেওয়া হবে। তাদের সবাইকে সাক্ষী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। একই সঙ্গে সাক্ষ্য দেবেন নিহতদের স্বজন ও প্রত্যক্ষদর্শীরা। গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হবে ঘটনার সময়ের ভিডিও, হত্যাকা-ের পরিকল্পনা ও নির্দেশনার আসামিদের মধ্যে অডিও রেকর্ড।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গণহত্যার অভিযোগ তোলা হয় এবং বিচার শুরুর উদ্যোগ নেওয়া হয়। হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারকে চেয়ারম্যান করে ট্রাইব্যুনালের বিচারিক প্যানেলসহ প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থাও পুনর্গঠন করা হয়। গত বুধবার পর্যন্ত প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থায় ১০০টির মতো অভিযোগ জমা হয়েছে। এর মধ্যে ৯০টির মতো অভিযোগ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের।ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রাথমিক তদন্তের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৭ অক্টোবর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, পুলিশের কয়েকজন সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির মাধ্যমে বিচারের প্রাথমিক প্রক্রিয়া শুরু হয়। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা এরই মধ্যে পুলিশের মহাপরিদর্শকের কাছে পাঠানো হয়েছে। এখন পুরনো হাইকোর্ট ভবনের পাশে একটি টিনশেড ভবনে বিচারের প্রাথমিক পর্যায় শুরু হলেও পুরনো ভবনটির সংস্কারকাজ দ্রুততার সঙ্গে চলছে। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে এ ভবনে আনুষ্ঠানিক বিচারকাজ শুরু হবে বলে জানিয়েছে প্রসিকিউশন।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিটি ঘটনাতেই মূল কারণ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার একদলীয়, স্বৈরশাসন বা পারিবারিক শাসনকে টিকিয়ে রাখার জন্য এ গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে শীর্ষ আসামি যারা আছেন, তাদের বিচার দ্রুততম সময়ের মধ্যে শেষ করার চেষ্টা করব। তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত হলে ছয় মাসের মধ্যে দুই-একটা মামলার বিচার একটা পর্যায়ে (রায়) নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা থাকবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘গুমের অভিযোগগুলোর আলাদা তদন্ত হবে। তবে এই মুহূর্তে প্রধান অগ্রাধিকার গণহত্যার বিচার। পাশাপাশি গুমের অভিযোগের তদন্ত সহসাই শুরু হবে। আইনের কিছু সংশোধনীর কাজ চলছে। সংশোধনী হলেই বিচারকাজটা সহজ হয়ে যাবে।’

শিগগির সংশোধন হচ্ছে আইন : জুলাই-আগস্টে গণহত্যার অভিযোগের বিচার করতে শুরু থেকেই বিদ্যমান আইন সংশোধনের তাগিদ দিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিগগির আইনটি সংশোধন হতে যাচ্ছে। ৫১ বছর আগের এ আইনটি এর আগে একাধিকবার সংশোধন হয়েছে। এবার সাত থেকে আটটি ধারা সংশোধন হতে যাচ্ছে। কিছুদিন আগে আইন সংশোধনের একটি প্রাথমিক খসড়া তৈরি করে অংশীজনদের মতামত নিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়। আরও কিছু অংশীজনের মতামত শেষে আইনটি সংশোধিত হয়ে আসবে। কোনো রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে গণহত্যা বা মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ প্রমাণিত হলে সেই দলকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নিষিদ্ধ, রেজিস্ট্রেশন বাতিল, জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে বিরত রাখার মতো বিষয়গুলো বিবেচনায় রয়েছে। বিদ্যমান আইনে সংগঠনের বিচারের বিধান থাকলেও শাস্তি কী হবে সে বিষয়ে কিছু নেই। একই সঙ্গে বিদ্যমান আইনে মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞার কিছুটা পরিবর্তন আসতে পারে। সংশোধনীর ফলে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ইত্যাদি অপরাধের দায় বা লায়াবিলিটি নির্ধারণ করতে ট্রাইব্যুনাল রোম স্ট্যাটিউটের ধারা-৯ অনুযায়ী গৃহীত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)-এর ‘এলিমেনটস অব ক্রাইম’ (অপরাধের উপাদান) বিবেচনা করার সুযোগ পাবে।

এ ছাড়া এই আইনের অধীনে অপরাধ হতে পারে, এটি জানা সত্ত্বেও যদি কোনো সংস্থা, সংগঠন, দল, সংঘবদ্ধ চক্রের শীর্ষ ব্যক্তিদের পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থতায় সংশ্লিষ্ট পক্ষকে বিচারের আওতায় আনা হতে পারে।

শতাধিক আহত ব্যক্তির জবানবন্দি : ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় গুলি ও নির্যাতনের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ঢাকা ও ঢাকার বাইরে আহত হয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। বিচারে তাদের সাক্ষ্যকে গুরুত্ব দেবে প্রসিকিউশন। ইতিমধ্যে চিফ প্রসিকিউটরসহ অন্য প্রসিকিউটররা ঢাকার যেসব হাসপাতালে আহতরা চিকিৎসাধীন, তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা শতাধিকের বেশি আহত ব্যক্তির প্রাথমিক জবানবন্দি নিয়েছেন। তাদের সবাইকে সাক্ষী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করবে প্রসিকিউশন। পাশাপাশি নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের অনেকেই অভিযোগ দায়ের করেছেন ট্রাইব্যুনালে। তাদেরও সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য ডাকা হবে। আর সাক্ষীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এরই মধ্যে বিভিন্ন পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে।


গণহত্যার পর গুমের বিচার, সংগঠনের বিচার সরকারের সিদ্ধান্তে : বিগত সরকারের ১৫ বছরে সংঘটিত গুমের ঘটনায় ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থায় এখন পর্যন্ত ১০টির বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে। এগুলোতে আসামি করা হয়েছে শেখ হাসিনাসহ তার সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, ওই সময়ের সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ র‌্যাব ও পুলিশের সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তাকে। আওয়ামী লীগ সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে গণহত্যার কয়েকটি মামলার বিচার শেষ করে গুমের অভিযোগের বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হবে। প্রসিকিউটরদের তথ্য অনুযায়ী, সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্র রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়লেও তদন্ত এখনো শুরু হয়নি। দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে বিচারের মুখোমুখি করা হবে কি না, সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এ বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত জানালে তারা উদ্যোগ নেবেন বলে জানান অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম।

পুরনো মামলাগুলোর কী হবে : ট্রাইব্যুনাল সংশ্লিষ্টদের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় দুই মাস ধরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক বিচারকাজ হচ্ছে না। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ৩০টি মামলা বিচারাধীন আছে ট্রাইব্যুনালে। এমন পরিস্থিতিতে এসব মামলার কী হবে, তা নিয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠনের আগে ২০টির বেশি মামলা ছিল সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তিতর্কের পর্যায়ে। এসব মামলায় ১৯৮ জন আসামির মধ্যে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন ৪৪ জন। এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের একাধিক প্রসিকিউটর দেশ রূপান্তরকে জানান, পুরনো মামলায় আসামিপক্ষের কেউ যদি মনে করেন যে তিনি হয়রানি বা মিথ্যা মামলার শিকার হয়েছেন, তাহলে তাদের আবেদন করতে বলা হয়েছে। পর্যালোচনায় যদি দেখা যায় যে, মামলাটি মিথ্যা, হয়রানির শিকার হওয়ার মতো উপাদান আছে বা আসামি নির্দোষ তখন সেটি ট্রাইব্যুনালে উপস্থান করে প্রতিকারের আরজি জানাবেন প্রসিকিউটররা।

প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম  বলেন, ‘এ বিষয়ে পর্যালোচনা চলমান রয়েছে। চিফ প্রসিকিউটরের নির্দেশনা পেলেই কার্যক্রম শুরু হবে।’

বিচারে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা নিশ্চিত চায় প্রসিকিউশন : গণহত্যার অভিযোগে করা মামলার বিচারে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা নিশ্চিতে জোর দিচ্ছে প্রসিকিউশন। এ লক্ষ্যে আসামিদের আইনানুযায়ী যত রকমের সুবিধা দেওয়া যায় তত সুবিধা নিশ্চিত করেই বিচারকাজ হবে বলে জানান প্রসিকিউটররা। ইতিমধ্যে আইন ও বিচার উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বিভিন্ন সময়ে ট্রাইব্যুনালে বিচারকাজের স্বচ্ছতা নিশ্চিতের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েছেন। এ লক্ষ্যে আসামিদের পক্ষে বিদেশি আইনজীবী নিয়োগ, বিদেশি পর্যবেক্ষকদের বিচারকাজ পর্যবেক্ষণের সুযোগসহ শুনানি ইলেকট্রনিক মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা রাখা হতে পারে। এ ছাড়া ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজের ভিডিও স্ট্রিমিং বা অডিও ভিজ্যুয়াল রেকর্ডিংয়ের সুযোগ রাখা হতে পারে সংশোধিত আইনে। আইনের বিধান মেনে পলাতকদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী থাকবেন। একই সঙ্গে অধস্তন আদালতে আসামিদের ওপর হামলার ঘটনায় তিক্ত পরিস্থিতিতে ট্রাইব্যুনালে তাদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তার বিষয়টি পর্যালোচনা করা হচ্ছে

অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেন, ‘বিচারক যদি সঠিকভাবে বিচারকাজ না করেন তাহলে ন্যায়বিচার হবে না। অতীতে এখানে ও সুপ্রিম কোর্টে ন্যায়বিচার হয়নি। এবার সর্বোচ্চ ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে। তদন্ত সংস্থা কোনো মিথ্যা প্রতিবেদন দেবে না, যা সত্য ঘটনা তাই যেন তদন্তে আসে সে বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া আছে। প্রসিকিউশনও কোনো নির্দোষ লোককে সাজা দেওয়ার প্রচেষ্টা চালাবে না। সত্যিকার অর্থে যারা গণহত্যার পরিকল্পনাকারী, ষড়যন্ত্রকারী ও নির্দেশদাতা এবং তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে প্রাপ্ত সাক্ষ্যের আলোকেই বিচার হবে।’