রংপুরের তারাগঞ্জে গণপিটুনিতে নিহত রূপলাল দাসের মেয়ে নূপুর রবিদাসের বিয়ে আজ (রোববার)। যেদিন তার বাবার উপস্থিতিতে এই বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হওয়ার কথা ছিল, সেই দিনেই তিনি নির্মমভাবে মবের হাতে প্রাণ হারান। এখন শোকের ছায়া নিয়েই হচ্ছে বিয়ে, আনন্দের বদলে ঘরে ঘরে নিঃশব্দ কান্না।
শনিবার (১ নভেম্বর) নূপুরের গায়ে হলুদের আয়োজন হয়। আগের দিন থেকেই ঘরে ঘরে চলছিল বিয়ের প্রস্তুতি—গেট, প্যান্ডেল, খাসি কেনা, আত্মীয়-স্বজন আপ্যায়নের আয়োজন—সবই ছিল। কিন্তু এই আয়োজনের মাঝেও গভীর এক শূন্যতা। বাবার আশীর্বাদ নেই, বরং সেই বাবাকেই হারাতে হয়েছে বিয়ের দিন ঠিক করতে গিয়ে।
তারাগঞ্জের ঘনিরামপুরের চর্মকার রূপলাল দাস (৪০) ও মিঠাপুকুরের বালুয়াভাটা গ্রামের প্রদীপ দাস (৩৫) গত ৯ আগস্ট চুরির অভিযোগে গণপিটুনিতে নিহত হন। এর পর থেকেই রূপলালের পরিবার অন্ধকারে। তখন রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসনের কর্মকর্তারা পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছিলেন, কিন্তু সময় গড়াতেই সবাই হারিয়ে গেছেন।
পরিবারের সদস্যরা জানাচ্ছেন, রূপলালের মৃত্যুর পর কিছুদিন সহানুভূতি দেখানো হলেও এখন আর কেউ খোঁজ নেয় না। তবু কষ্টের মধ্যেই নূপুরের বিয়ে আয়োজন করছেন মা ভারতী রানী। ধার-দেনা করে কেনা হয়েছে গয়না, জামাইয়ের উপহার, তিনটি খাসি—সবই বাবাহারা মেয়ের বিয়ের জন্য।
নূপুর রবিদাস বলেন, “বিয়ের আয়োজন চলছে, কিন্তু আমার মনে শান্তি নেই। বাবাকে হারানোর কষ্টে বুক ভেঙে যাচ্ছে। যারা বাবাকে পিটিয়ে মেরেছে তারা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, অথচ পুলিশ কিছু করছে না। আমরা নিরাপত্তাহীনতায় আছি।”
তার ছোট ভাই জয় রবিদাস বলেন, “বাবা নেই, তাই সব দায়িত্ব আমার ওপর। বোনের বিয়ের খরচ মেটাতে হাট থেকে খাসি কিনেছি, উপহার দিয়েছি, মামার সাহায্যে যতটা পারছি করছি।”
মা ভারতী রবিদাস জানান, “স্বামীকে হারিয়ে আমি একেবারে একা। ধার করে মেয়ের বিয়ের আয়োজন করছি। কেউ পাশে নেই। যারা পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তারা এখন আর খবর নেয় না।”
তারাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রুবেল রানা বলেন, “নূপুরের বিয়ের জন্য উপজেলা তহবিল থেকে এক লাখ টাকা এবং সমাজসেবা অফিস থেকে ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ভারতী রবিদাসকে বিধবাভাতা ও নূপুরের পড়াশোনার জন্য শিক্ষা ভাতা দেওয়া হচ্ছে।”
রংপুরের মানবাধিকার কর্মী অ্যাড. জোবাইদুল ইসলাম মনে করেন, “রূপলাল ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার মৃত্যুর দায় রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। নূপুরের বিয়েতে যেন সমাজ ও প্রশাসন সবাই পাশে থাকে, সেটাই এখন সবচেয়ে জরুরি।”
উল্লেখ্য, গত ৯ আগস্ট রাতে রূপলাল তার ভাগ্নি জামাই প্রদীপ লাল রবিদাসকে নিয়ে মেয়ে নূপুরের বিয়ের দিন ঠিক করতে যাচ্ছিলেন। পথে তারাগঞ্জের বুড়িরহাটে স্থানীয় কয়েকজন তাদের চোর সন্দেহে আটক করে মারধর করে। এতে ঘটনাস্থলেই রূপলাল মারা যান, পরদিন হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন প্রদীপ। এ ঘটনায় রূপলালের স্ত্রী ভারতী রানী বাদী হয়ে ৫০০-৭০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে মামলা দায়ের করেন। এ পর্যন্ত ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।