মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ ২০২৫, ৪ চৈত্র ১৪৩১
সর্বশেষ বিশেষ সংবাদ জাতীয় সারাদেশ আন্তর্জাতিক খেলা বিনোদন বাণিজ্য লাইফস্টাইল আইন-আদালত মতামত অন্যান্য
/ মতামত

শীতকালে নিপাহ রোগ : আতঙ্ক নয়, দরকার সতর্কতা ও সচেতনতা - মোঃ রুপাল মিয়া


প্রকাশ :

শীতকাল মানেই বিশেষ কিছু। গরম পোশাক, বিশেষ বিশেষ খাবার মানুষের মনে আলাদা অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। অনেকে মনে করেন, শীতকালের বিশেষ খাবার না খেলে শীতকে প্রকৃতভাবে অনুভব করাই যায় না। শীতের বিশেষ খাবারগুলোর মধ্যে খেজুর গাছের রস অন্যতম। অনেকে শখের বশে আবার অনেকে শীতকাল আসলে খেতেই হবে এমনটা ভেবে খেজুর গাছের রস খেয়ে থাকেন।

খেজুর গাছের প্রকৃত রস মানুষের কোনো ক্ষতি করে না। বরং খেজুর গাছের রস প্রচুর খনিজ ও পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ। খেজুর গাছের রস কাঁচা খাওয়া যায়, আবার জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করেও খাওয়া যায়। এই গুড়ে আয়রন বেশি থাকে এবং হিমোগ্লোবিন তৈরিতে সহায়তা করে। যারা শারীরিক দুর্বলতায় ভোগেন, কাজকর্মে জোর পান না খেজুর গাছের রস তাদের জন্য দারুণ উপকারী। কিন্তু খেজুর গাছের কাঁচা রস গ্রহণে সতর্কতা অবলম্বন না করলে ঘটতে পারে মহাবিপদ। কারণ শীতকাল আসলেই নিপাহ রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়। নিপাহ একটি ভাইরাসজনিত সংক্রামক রোগ। এই রোগে মৃত্যুর হার অনেক বেশি। আমরা জানি, বাদুর নামক প্রাণীটির বসবাস গাছে। গাছের ফল ও পাতা এদের প্রধান খাদ্য। এমনকি খেজুর গাছের সংগৃহীত কাঁচা রসও এদের অন্যতম খাবার। আর বাদুড় নামক প্রাণীটিই নিপাহ ভাইরাসের প্রধান বাহক। সংগৃহীত খেজুর গাছের কাঁচা রস বাদুড় পান করার অবশিষ্টাংশে বা আংশিক আহার করা ফলে বাদুড়ের লালা বা মল-মূত্র মিশে থাকে। বাদুড়ের আংশিক আহার করা সেই ফল জমিতে পড়ে থাকে অথবা বাদুড়ের মল-মূত্রও ঘাসের সঙ্গে মিশে থাকে। বাদুড় পান করার অবশিষ্ট খেজুর গাছের কাঁচা রস পান করলে বা আংশিক আহার করা বা কামড়ানো ফল খেলে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

বিজ্ঞানীদের ধারণা, সংক্রমিত রোগীর হাঁচি-কাশি-কফ-থুথু অর্থাৎ শ্বাসতন্ত্র ও শরীরের সংক্রমিত নিঃস্বরণের মাধ্যমে নিপাহ একজন থেকে অন্যজনে সংক্রমিত হতে পারে। বাদুড়ের লালা, মল-মূত্র মিশ্রিত খেজুর গাছের কাঁচা রস পানে বাংলাদেশের কোনো কোনো জেলায় মানুষ নিপাহ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। এগুলোর মধ্যে কোনো কোনো জেলায় নিপাহ সংক্রমিত রোগীর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তি নিপাহ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন।

নিপাহ রোগের লক্ষণ সবার ক্ষেত্রে একরকম নাও হতে পারে, কখনো কখনো কোনো লক্ষণ নাও থাকতে পারে। সাধারণভাবে, খেজুর গাছের কাঁচা রস পান করার বা বাদুড়ের আংশিক আহার করা ফল খাওয়ার অথবা নিপাহ রোগে আক্রান্ত পশু বা ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার দুই সপ্তাহের মধ্যে মৃদু থেকে তীব্র শ্বাসকষ্ট, জ্বরসহ মাথাব্যথা, মাংসপেশিতে ব্যথা, খিচুনি, প্রলাপ বকা, অজ্ঞান হওয়ার মতন লক্ষণ থাকলে নিপাহ রোগ বলে সন্দেহ করা হয়। নিপাহ রোগের কোনো টিকা ও সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। সতর্কতা ও সচেতনতাই এই রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারের উপায়। খেজুর গাছের কাঁচা রস কোনো ভাবেই পান করা যাবে না। সর্ব অবস্থায় বাদুড়ের লালা, মল-মূত্র এড়িয়ে চলতে হবে। তবে খেজুর গাছের রস থেকে তৈরি গুড়, খেজুর গাছের রসে রান্না করা পায়েস এবং রান্না করা শাকসবজি নিরাপদ। কারণ ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি তাপে নিপাহ ভাইরাস নষ্ট হয়। যেকোনো ফল খেতে হলে তা ভালো করে ধুয়ে শুকনো অবস্থায় খেতে হবে। কাঁচা শাকসবজি দিয়ে সালাদ খেতে হলে সেগুলোও ভালো করে ধুয়ে ও পরিষ্কার করে নিতে হবে। নিপাহ আক্রান্ত ব্যক্তির কাছে বিনা প্রয়োজনে যাওয়া যাবে না। রোগীর সেবার জন্য সাবধানতা ও সংক্রমণ প্রতিরোধমূলক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। শ্বাসতন্ত্র বাহিত রোগ প্রতিরোধে যে সব নিয়ম-কানুন রয়েছে সেবাকারী ব্যক্তিকে সব নিয়ম মেনে চলতে হবে। নিপাহ রোগে আক্রান্ত রোগীর এক মিটারের মধ্যে যেতে হলে মুখে মাস্ক পড়তে হবে। এমনকি রোগীর মুখেও মাস্ক পরিয়ে দিতে হবে। রোগীকে খাবার ও ঔষধ খাওয়ানোর আগে ও পরে সাবান দিয়ে দুইহাত ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে। রোগীর খাওয়ার আগে ও পরে থালা-বাসন সাবান দিয়ে ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে। রোগীর আংশিক খাওয়া/উদ্বৃত্ত খাবার অন্য কাউকে খেতে দেওয়া যাবে না, কোনো প্রাণীকেও খাওয়ানো যাবে না। খাবার এমন জায়গাতে ও এমনভাবে ফেলে দিতে হবে, যেন সেখান থেকে অন্য কোনো মানুষ বা প্রাণী সেটা আর খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করতে না পারে। রোগীর ব্যবহারের কাপড়/তোয়ালে থালাবাসন/গ্লাস ইত্যাদি সাবান দিয়ে ভালো করে ধুয়ে আলাদা রাখতে হবে যাতে অন্য কেউ তা ব্যবহার করতে না পারেন। রোগীর মৃত্যু হলে তার দাফন-কাফন নির্দেশিত নিয়ম মেনে করতে হবে, যেন মৃত রোগীর লালা/রক্ত/মল-মুত্রের সরাসরি সংস্পর্শে অন্য কেউ না আসে। গ্লাভস ও মাস্ক পরে নির্দেশিত ব্যবস্থা গ্রহণ করে মৃতদেহ গোসল করাতে হবে। যিনি/যারা গোসল করাবেন, তিনি/তারা মৃতদেহ গোসল করাবার পরে নিজে/নিজেরা সাবান দিয়ে গোসল করে ধোয়া কাপড় পরবেন।

নিপাহ রোগের লক্ষণ দেখা দিলে আক্রান্ত ব্যক্তিকে দ্রুত নিকটস্থ সরকারি হাসপাতালে প্রেরণ করতে হবে। কথায় আছে-প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। আর ভাইরাসজনিত সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে সতর্কতা ও সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। তাই নিজে সতর্ক ও সচেতন হওয়ার পাশাপাশি অন্যকেও সতর্ক ও সচেতন করতে হবে।

লেখক : সহকারী তথ্য অফিসার, আঞ্চলিক তথ্য অফিস, পিআইডি, রংপুর