১৯৭৬ সালের কুয়াশামাখা ১৭ নভেম্বর চিরকালের মতো চলে গেলেন মওলানা ভাসানী। কিন্তু মওলানা ভাসানীর মতো ব্যক্তির যে মৃত্যু হয় না, তা নতুন করে বোঝা যাচ্ছে সারা পৃথিবীতে ভাসানী চর্চা যেভাবে গতি পাচ্ছে তা দেখে। আর নতুন বাংলাদেশের সর্বত্র তো ভাসানী চিন্তা ফিনিক্স পাখির মতো প্রাণ ফিরে পেয়েছে।
আমাদের ভারতেও, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে মওলানা ভাসানীর দর্শন, রাজনীতি, কৃষকদের প্রতি তার দরদ সম্পর্কে নতুন প্রজন্মের আগ্রহ ক্রমেই বাড়ছে। এটা হওয়ার ছিল। আসলে ভাসানী তার সময়ের চেয়ে অনেক আগে জন্মেছিলেন। তাকে বুঝতে যে মন লাগে তা তার সমসাময়িককালে আসামে ও যুক্তবঙ্গে কিছুটা বোধহয় কমই ছিল। বিশেষ করে অভিজাত রাজনীতিবিদদের মধ্যে। কিন্তু এটাও ঠিক যে. তার জনপ্রিয়তা ছিল সমাজের গরিবদের মধ্যে। কৃষক, শ্রমিক, জেলে, তাঁতি, মাঝি, কুমোর, কামার সমাজের এই আপাত নিম্নবর্গেও মানুষের বিপুল আস্থা ছিল ভাসানীর প্রতি।
মওলানা ছিলেন একাধারে একজন মহান দার্শনিক ও রাজনৈতিক সন্ন্যাসী। সারা জীবন তিনি গ্রামে বাস করেছেন এবং গ্রামের জনমনে স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা চারিয়ে দিয়েছেন। পূর্ববঙ্গের গ্রামীণ সর্বহারার মধ্যে সমাজতন্ত্র শব্দটি তিনিই পৌঁছে দিয়েছিলেন। শুধু মওলানা ভাসানীর আসাম অধ্যায় নিয়েই বিশাল এক গ্রন্থ লিখে ফেলা যায়। নাসুরুদ্দীন বোগদাদীর হাত ধরে মওলানা প্রথম আসামের জলেশ্বর গ্রামে থিতু হয়েছিলেন। বোগদাদী ছিলেন বিখ্যাত পীর। তিনি ঘুরতে ঘুরতে সিরাজগঞ্জে এসে তার পূর্ব পরিচিত হাজী শরাফত আলীর খোঁজ করতে গিয়ে শুনলেন, হাজী সাহেব ও তার পরিবারের সবাই রোগ ভোগে মারা গেছেন। শুধু একমাত্র ছোট ছেলে, চেকা মিঞা বেঁচে থাকলেও জ্ঞাতিদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সয়া ধনগড়া গ্রাম থেকে পালিয়ে গেছে। বোগদাদী অনেক খোঁজাখুঁজি করে চেকা মিঞাকে পেলেন এবং সঙ্গে করে বালক চেকাকে নিয়ে জলেশ্বর পৌঁছলেন। মেধাবী চেকাকে বোগদাদী তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের অন্যতম সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেওবন্দে পাঠালেন। সেখানে গিয়ে চেকা মিঞা স্বদেশি আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে আসামে ফিরে এলেন। সেখানে বেশি দিন না থেকে টাঙ্গাইলের সন্তোষে এসে একটি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করলেন। বস্তুত তখনই ধীরে ধীরে তিনি কৃষকদের দুঃখ-কষ্টের সমব্যথী হতে লাগলেন। সে সময় ময়মনসিংহ, রাজশাহী, টাঙ্গাইল, পাবনাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে জমিদারদের দাপট ছিল ভয়ংকর। ব্রিটিশ সরকার ও জমিদারদের মিলিত অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে কৃষকদের সংগঠিত করতে লাগলেন চেকা মিঞা। সরকার ও জমিদারদের মিলিত শক্তি দেশ থেকে নির্বাসিত করল চেকা মিঞাকে। তিনি আশ্রয় নিলেন পুরনো আসামের দুর্গম জঙ্গল পাহাড়ে। সেসব এলাকায় তখন পূর্ববঙ্গ থেকে চলে আসতে বাধ্য গরিব কৃষকদের ভিড়। তাদের জীবন তখন দুঃসহ যন্ত্রণার। স্থানীয় জমিদার, মহাজন, দালাল, লেঠেলদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ নিম্নবর্গের হিন্দু ও গরিব মুসলমান দলবদ্ধভাবে তাদের নেতা বাছলেন চেকা মিঞাকে।
ততদিনে চিত্তরঞ্জন দাশের ভাবশিষ্য হয়ে চেকা মিঞা সরাসরি রাজনীতিতে এসে গেছেন। ডাক দিলেন কৃষক আন্দোলনের। ভাসানী চরের বাসিন্দা বলে, লোকমুখে তিনি হয়ে উঠলেন মওলানা ভাসানী। আর মওলানাও কোনো আলঙ্কারিক উপাধি নয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের দেওয়া ভালোবাসার ডাক। জ্ঞানী মুসলমান বলতেই হিন্দুর চোখে মওলানা। ভারত উপমহাদেশে এমন অসাম্প্রদায়িক মওলানা আগেও ছিল না। আর পরেও হয়নি। অনেকেই ভাসানীকে সাম্প্রদায়িক বলেন। তিনি ধর্মপ্রাণ ছিলেন। কিন্তু ধর্মব্যবসায়ী ছিলেন না। তিনি আক্ষরিক অর্থেই অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। তার মৃত্যুর পর একই সঙ্গে মিলাদ ও শ্রাদ্ধের আয়োজন করেছিলেন মুসলমান ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। আসামে কৃষক স্বার্থে মওলানা ভাসানীর লড়াই আজও মনে রেখেছে স্থানীয় অধিবাসীদের বড় অংশ। কত কত আখ্যান, লোকগাঁথা, কাহিনি আজও আসামের চর এলাকায় বেঁচে আছে। গাঁও বুড়োরা বলেন, গভীর রাতে, অমাবস্যা বা পূর্ণিমা, ঘুটঘুটে অন্ধকার বা জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়া ফুটফুটে রাতে ঘোড়ার পিঠে ঘুরে বেড়ান মওলানা ভাসানী। চিৎকার করে তিনি সতর্ক করে দেন প্রিয় কৃষকদের ঘুমিয়ে পড়লে চলবে না, লড়াই এখনো শেষ হয়নি। ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার কম চেষ্টা হয়নি, এখনো হয়ে চলেছে ভাসানীর নাম মুছে ফেলার। কিন্তু সারা দুনিয়ার মজলুমের সংগ্রাম যতদিন থাকবে, ততদিন কারও সাধ্য নেই ইতিহাসের পাতা থেকে আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নাম মুছে ফেলার।
১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান আলাদা রাষ্ট্র হওয়ার দিন মওলানা ছিলেন আসামের জেলে। না কংগ্রেস না মুসলিম লীগের নেতারা তাকে খবর দেওয়ার প্রয়োজনটুকুও মনে করেননি যে, দেশ টুকরো হয়ে যাচ্ছে। আসলে কোনো দিনই রাষ্ট্র বা শাসকদের পছন্দের লোক ছিলেন না ভাসানী। আসামের জেলে বন্দি হওয়ার পর শুধু সে সময়ের দুর্বল কমিউনিস্ট পার্টি হাতে লেখা পোস্টার দেয়ালে মেরে মওলানা ভাসানীর মুক্তি চাই স্লোগান তুলেছিল। তিন মাস পর ভারত সরকার মুক্তি দিল ভাসানীকে। গভীর রাতে তীব্র শীতে ভারতের মিলিটারি জিপ প্রায় ধাক্কা দিয়ে সীমান্ত পার করে দিল কৃষকদের প্রাণ হুজুর ভাসানীকে। তিনি ধীরপথে মাথা উঁচু করে ভোরে ভোরে এসে পৌঁছলেন চিরচেনা সন্তোষে। তার দুবছরের মধ্যেই ১৯৪৯ সালে পুরনো ঢাকার মোগলটুলীর ডেরায় গড়ে উঠল মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ। তারপরের গুরুত্বপূর্ণ যাবতীয় কার্যকলাপে সামনের সারিতে মওলানা ভাসানী।
১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের হাতে মুসলিম লীগের পর্যুদস্ত হওয়া, সবের পেছনে মূল কারিগর নিঃসন্দেহে ভাসানী। পরবর্তী সময় আওয়ামী মুসলিম লীগের মধ্যে থেকে মুসলিম শব্দ বাদ দেওয়ার কৃতিত্ব, তাও মওলানা ভাসানীর। ভাসানী মনে করতেন রাজনীতিকে গ্রামে নিয়ে যেতে হবে। গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরা ছিল মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক রণনীতি। মওলানা ভাসানী কমিউনিস্ট ছিলেন না। কিন্তু পরম ভালোবাসায় তিনি আগলে রেখেছিলেন সব গোষ্ঠীর কমিউনিস্টদের। সিরাজ সিকদার থেকে মোহাম্মদ তোয়াহা, হায়দার আকবর খান রনো, দীপা দত্ত, সুখেন্দু দস্তিদার, আব্দুল হক, রাশেদ খান মেনন, কাজী জাফর প্রমুখ বহু বিভক্ত কমিউনিস্টদের। ক্ষমতায় আসার পর ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান গড়ে তুললেন রক্ষী বাহিনী। তাদের হাতে কম করেও কুড়ি বাইশ হাজার কমিউনিস্ট কর্মী-সমর্থক খুন হয়েছিলেন। মওলানা বৃদ্ধ বয়সে সাধ্য মতো ‘গেস্টাপো বাহিনীর’ এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। মুজিব বললেন, নকশাল দেখা মাত্র গুলি করে মারো। ভাসানী গর্জে উঠলেন, নকশাল কারও গায়ে লেখা থাকে না।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভাসানীর রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব শুরু হলো ১৯৫৭ সালের কাগমারী সম্মেলনের সময় থেকেই। কাগমারীতে প্রথম ভাসানী পাকিস্তানের শাসকদের হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন আলাদা হয়ে যাওয়ার। স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে অনড় ছিলেন ভাসানী। তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী দাবি করেছিলেন পূর্ববঙ্গে ৯৮ শতাংশ স্বায়ত্তশাসন হয়ে গেছে। মওলানা এই হাস্যকর দাবি মানতে চাননি। এ ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতার প্রশ্নেও সোহরাওয়ার্দী, মুজিবের সঙ্গে মতভেদ ছিল ভাসানীর। মওলানা ভাসানী ছিলেন পুরোপুরি আমেরিকাবিরোধী। ফলে এসব গুরুতর বিষয়ে মতপার্থক্য ছিল বলেই মওলানা ভাসানী পরবর্তী সময় গড়ে তুললেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ।
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সব বাম, প্রগতিশীল অংশ যোগ দিলেন ন্যাপে। ন্যাপের মিটিং ভাঙতে সক্রিয় হলো আওয়ামী লীগের গুন্ডা বাহিনী। ঊনসত্তরের আয়ুববিরোধী গণ-আন্দোলনের রাশ ছিল ভাসানীপন্থিদের হাতে। রাস্তার লড়াইয়ে শহীদ হলেন ভাসানীর প্রিয় ছাত্রনেতা আসাদ। সারা দেশের গ্রাম-শহরে আওয়াজ উঠল আসাদের মন্ত্র জনগণতন্ত্র। ঊনসত্তর জমি প্রস্তুত করল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের। মুক্তিযুদ্ধ ছিল আক্ষরিক অর্থেই জনযুদ্ধ। দেশের ভেতরে গেরিলা যুদ্ধে অবদান ছিল বামেদের। সে সব অনালোচিত বিষয় এখন সামনে আনা জরুরি। স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনা মওলানা ভাসানী পৌঁছে দিয়েছিলেন গ্রামে গ্রামে ঊনসত্তর সাল থেকে। সত্তর সালে দক্ষিণবঙ্গে ভয়ংকর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুতে বিচলিত মওলানা ভাসানী প্রথম স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের ডাক দিয়েছিলেন। মওলানা ভাসানী বলতেন ধর্ম দুটি। মজলুম ও জালিমের। আপনাকে বেছে নিতে হবে আপনি কোন পক্ষে থাকবেন!
মওলানা ভাসানীর সঠিক মূল্যায়ন হয়নি। বাংলাদেশের আগের রেজিম তার অবদানের স্বীকৃতি সেভাবে দেয়নি। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মুজাফফর আহমেদ বা হরেকৃষ্ণ কোঙ্গার যত সুখ্যাতিই ভাসানীর করুন না কেন পরবর্তীকালের নেতাদের কাছে তিনি বিস্মৃত প্রায়। অথচ ভাসানী শুধু কৃষক-শ্রমিকদের কথাই না পরিবেশ, জলবায়ু, প্রাণিসম্পদ নিয়ে যেভাবে সোচ্চার ছিলেন তা ভাবলে অবাক হতে হয়। দক্ষিণ এশিয়ার আর কোনো নেতা বড় বাঁধ নিয়ে কখনো সোচ্চার হননি। ফরাক্কা বাঁধের বিপদ নিয়ে তিনি জীবনের প্রান্তে পৌঁছে যেভাবে লংমার্চ করেছিলেন, তা ভাবলেও গায়ে কাঁটা দেয়। তিনি ছিলেন সত্যিকারের এক মহতী সাধক। যার কোনো বিকল্প নেই।
লেখক: ভারতীয় প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা ও লেখক