মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রায় আইনের শাসন ও মানবাধিকার এমন দুটি মৌলিক উপাদান, যা ছাড়া একটি গণতান্ত্রিক সমাজ কল্পনা করা যায় না। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, সমতা নিশ্চিতকরণ এবং মানবিক মর্যাদা সংরক্ষণে আইনশিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ১৯৫৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ (Department of Law) বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে আইন শিক্ষার আলোকবর্তিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ২৫ অক্টোবর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। দীর্ঘ ৭২ বছরের গৌরবময় যাত্রায় এ বিভাগ আজ উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও মর্যাদাপূর্ণ আইনশিক্ষা কেন্দ্র। কেবল আইনের ধারা শেখানো নয় বরং ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, সমতা ও মানবিক মর্যাদার মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় বিভাগটি হয়ে উঠেছে এক অবিচল অঙ্গীকারের প্রতীক।
একাডেমিক উৎকর্ষ ও প্রজন্ম গঠন
আইন ও বিচার বিভাগের পাঠ্যক্রমে সংবিধান, প্রশাসনিক আইন, আন্তর্জাতিক আইন, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন, ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা থেকে শুরু করে সমসাময়িক ডিজিটাল আইন ও সাইবার অপরাধ বিষয়ক শিক্ষাও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা কেবল দক্ষ পেশাজীবী নয়, বরং মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠছে। বিগত সাত দশকে এই বিভাগ থেকে হাজারো শিক্ষার্থী বের হয়ে দেশের বার ও বেঞ্চে, উচ্চ আদালতে, প্রশাসনে এবং আন্তর্জাতিক সংস্থায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁদের নেতৃত্বে আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বাস্তব রূপ।
বিচার বিভাগ ও আইন পেশায় অবদান
বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা দেশের মন্ত্রীসভা, জাতীয় সংসদসহ বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস, সিভিল সার্ভিস, শিক্ষকতা, আইন কমিশন, মানবাধিকার কমিশনসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছেন। অনেকেই সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, সরকারি আইন কর্মকর্তা, কূটনীতিক ও আইনশিক্ষক হিসেবে জাতিকে সেবা দিচ্ছেন। এছাড়াও অনেকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা, বিদেশী আদালতে আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মী, কর্পোরেট জগতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছেন। তাঁদের সাফল্য কেবল ব্যক্তিগত গৌরব নয়, বরং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অমূল্য অর্জন।
বিচার বিভাগের নেতৃত্ব
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের গ্র্যাজুয়েটরা বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসে ধারাবাহিকভাবে সাফল্য অর্জন করে আসছেন। বিচার বিভাগে তাঁদের সক্রিয় উপস্থিতি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সরাসরি অবদান রাখছে। অনেকেই উচ্চ আদালতের বিচারপতি, সরকারি আইন কর্মকর্তা ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্থায় নেতৃত্বে দিচ্ছেন।
গবেষণা ও মানবাধিকার আন্দোলন
বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা নারী ও শিশু অধিকার, শ্রম অধিকার, পরিবেশ অধিকার, সংখ্যালঘু অধিকারসহ নানা বিষয়ে গবেষণা পরিচালনা করছেন। গবেষণালব্ধ জ্ঞান নীতি প্রণয়ন ও আইন সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস, আইন দিবস প্রভৃতি উপলক্ষে বিভাগটি নানা কর্মসূচির আয়োজন করে, যা সমাজে ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ ও সামাজিক দায়িত্ব
বিভাগের Moot Court কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের আদালতের বাস্তব অভিজ্ঞতা দেয়। এছাড়া বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত লিগ্যাল এইড ক্লিনিক দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে বিনামূল্যে আইনসেবা পৌঁছে দিচ্ছে। এর মাধ্যমে ন্যায়বিচারের আলো সমাজের তৃণমূল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে এবং শিক্ষার্থীরা সমৃদ্ধ হচ্ছে।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কণ্ঠস্বর
বিভাগের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকবৃন্দ শুধু ক্লাসরুমেই সীমাবদ্ধ থাকেন না। তারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের সংবাদমাধ্যমে (সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, টিভি টক শো, পত্রিকার নিবন্ধ ইত্যাদি) বিশেষজ্ঞ হিসেবে উপস্থিত হয়ে আইনের শাসন ও মানবাধিকার সংক্রান্ত জটিল বিষয়গুলো সরলভাবে উপস্ত্যহাপন করেন। দেশে-বিদেশের কোথাও কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটলে তার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদে উচ্চকণ্ঠ হতে দেখা যায় এ বিভাগের সকলকে। ফলে ক্রমেই বিভাগটি একটি পাবলিক ইন্টেলেকচুয়ালের ভূমিকা পালন করছে।
পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন (PIL)
এ বিভাগের শিক্ষকবৃন্দ ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা দেশের গুরুত্বপূর্ণ মামলায় আইনজীবী এবং আইনি পরামর্শক হিসেবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছেন। বিশেষত, পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন (PIL)-এর মাধ্যমে তাঁরা উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দাখিল করে রাষ্ট্রীয় সংস্থার বিভিন্ন অবৈধ ও আইন বহির্ভূত সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করেছেন এবং জনস্বার্থ সংরক্ষণের লক্ষ্যে ঐতিহাসিক রায় আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা
বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তি ও আইনের সংযোগ ক্রমেই ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ ইতোমধ্যে ডিজিটাল আইন, সাইবার অপরাধ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ে পাঠ্যক্রমে পরিবর্তন এনেছে। ভবিষ্যতে এই বিভাগ আরও বেশি গবেষণাভিত্তিক, প্রযুক্তিনির্ভর ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন আইন শিক্ষা প্রদানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। দীর্ঘ যাত্রায় অর্জনের পাশাপাশি কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে, যেমন পর্যাপ্ত গবেষণা অর্থায়নের অভাব, আন্তর্জাতিক এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের সীমাবদ্ধতা এবং প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষার ঘাটতি। ভবিষ্যতে ডিজিটাল আইন, সাইবার নিরাপত্তা, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন, ও ক্লিনিক্যাল লিগ্যাল এডুকেশনকে আরও জোরদার করা প্রয়োজন। গবেষণা অর্থায়ন বৃদ্ধি, বৈশ্বিক সহযোগিতা সম্প্রসারণ এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বিভাগের অগ্রযাত্রাকে আরও সমৃদ্ধ করবে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও বিচার বিভাগ গত ৭২ বছরে প্রমাণ করেছে যে এটি কেবল একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, বরং আইনের শাসন, মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়ের এক নির্ভরযোগ্য স্তম্ভ। এই দীর্ঘ অভিযাত্রা আমাদের অনুপ্রাণিত করে একটি ন্যায়ভিত্তিক ও মানবাধিকারসম্মত সমাজ গঠনের স্বপ্নকে আরও এগিয়ে নিতে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সকল শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
লেখকঃ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ৩১ ব্যাচের প্রাক্তন শিক্ষার্থী, কার্যকরী সদস্য, রুলা এবং সিনিয়র সহকারী পরিচালক, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন।