২৪ বছর পর দুই বোনের আলিঙ্গন
লালমনিরহাট সীমান্তের জারিধরলা শ্যামা মন্দিরের পূজায় দু’দেশের মানুষের মিলনমেলা বসেছে। এ পূজায় পুরোহিত থাকেন বাংলাদেশের, আর পূজারী ভারতের।
রবিবার (১৯ অক্টোবর) দিনব্যাপী শ্যামাপূজা বা ‘বুড়ির মেলা’ উপলক্ষে লালমনিরহাট সীমান্ত ছিল একেবারে উন্মুক্ত। ২০০৮ সালের পর এই প্রথম দুই দেশের মানুষ বিনা পাসপোর্ট ও ভিসায় অবাধে মেলায় অংশ নেয়।
মেলা থেকে ফিরে আসা যুবক শ্রী হৃদয় কুমার (৪৫) জানান, মেলায় দুই বোনকে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে দেখা গেছে। প্রায় দুই যুগ পর দেখা হয় তাদের— বাংলাদেশের শুশীলা রানী (৬০) ও ভারতের নিয়তি রানী (৫৮)-এর। এই অনুষ্ঠানকে ঘিরে গত দুই সপ্তাহ ধরে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছিল স্থানীয় প্রভাবশালী মহল।
লালমনিরহাটের দুর্গাপুর ও মোগলহাট সীমান্তে ধরলা নদীর পাড়ে ৯২৭ নম্বর সীমান্ত পিলারের কাছে রবিবার দিনভর অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত মিলনমেলায় দেখা হয় দুই বোনের। একে অপরকে দেখেই তারা কান্নায় ভেঙে পড়েন। প্রায় দশ- পনের মিনিট ধরে শুধু কান্নাই চলেছে। চোখের জলে ফুটে উঠেছে সেই দীর্ঘ অপেক্ষার প্রশান্তি।
বড় বোন শুশীলা রানী এনেছিলেন মিষ্টি, ইলিশ মাছ ও টাঙ্গাইলের শাড়ি। ছোট বোন নিয়তি রানী নিয়ে এসেছিলেন ভারতের মিষ্টি, মসলা, প্রিন্ট শাড়ি ও জামদানি। উপহার বিনিময়ের সময়ও তাদের চোখে অশ্রু থামেনি।
বাংলাদেশের শুশীলা রানী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “প্রায় ২৪ বছর হলো বোনের সঙ্গে দেখা হয় না। ২০০৯ সালের পর মোবাইল ফোনে কথা হতো, তাতে মন ভরত না। ২০২১ সালের পর ভিডিও কলে কথা বলেছি, কিন্তু বুকের কষ্ট যায়নি। আজ বুড়ির মেলায় এসে বোনের দেখা পেয়ে মনটা জুড়িয়ে গেল।”
শুশীলা রানীর বাড়ি লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার দেওডোবা গ্রামে। আর নিয়তি রানীর বাড়ি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার দিনহাটা থানার গিদালদহ গ্রামে। নিয়তি জানান, প্রায় ৩৫ বছর আগে তিনি ভারতে চলে যান। বাবা-মা মারা গেছেন— দেখা হয়নি। এখন বাংলাদেশে কেবল দিদি বেঁচে আছেন। এমন হাজার পরিবারের গল্প বোনা হয় এই মেলায়।
প্রতি বছরই ধরলা নদীর পাড়ে সীমান্ত ঘেঁষে ভারতের কোচবিহার জেলার দিনহাটা থানার দড়িবাস এলাকায় শ্রী শ্রী মা বৃদ্ধেশ্বরী দেবীর পূজা উপলক্ষে বসে এই সীমান্ত মেলা। স্বাধীনতার আগেই শুরু হয়েছিল এই পূজা ও মিলনমেলা। ১৯৯২ সালে কড়াকড়ির কারণে বাংলাদেশ থেকে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। এবার আবার উন্মুক্ত হয়েছে সীমান্ত।
একটি সূত্র জানায়, এ বছরের পূজার বিশেষত্ব হলো— মন্দিরের পুরোহিত আসেন বাংলাদেশ থেকে, আর পূজারী ভারতের। দুই দেশের মানুষ একসাথে পূজা দেন, প্রসাদ খান, আর একদিনের জন্য হলেও ভুলে যান সীমান্তের বিভাজনরেখা।
বাংলাদেশের পুরোহিত বিকাশ চন্দ্র চক্রবর্তী ও ভারতের পূজারী জ্যোতিষ চন্দ্র রায় বলেন, এই আয়োজন সম্প্রীতির প্রতীক। দুই দেশের ভক্তরাই মন্দির পরিচালনা করেন। রবিবার দিনভর পূজা উপলক্ষে মিলনমেলায় ২০-২৫ হাজারের বেশি ভক্ত ও দর্শনার্থী সমবেত হয়। কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
মেলায় শুধু লালমনিরহাট নয়— রংপুর, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় ও কুড়িগ্রাম থেকেও মানুষ এসেছে। শুধু হিন্দু নয়, মুসলিম, খ্রিস্টানসহ নানা ধর্মের মানুষ আসে এখানে। কারণ দেশভাগে বিচ্ছিন্ন হওয়া স্বজনরা এই মেলাতেই মিলিত হতে পারেন। এখানে এসে আত্মীয়দের বুকে জড়িয়ে ধরে সবাই কাঁদে— কিন্তু সেই কান্নায় থাকে আনন্দের সুর। এটা সীমান্ত পেরোনো ভালোবাসার এক অফুরন্ত দৃশ্য।