লালমনিরহাট বার্তা
লালমনিরহাট জেলার অতীত ঐতিহ্যবাহী পত্রিকা ও সংস্কৃতি
দেলোয়ার হোসেন রংপুরী | ৯ জুল, ২০২২, ৫:৩৯ AM
লালমনিরহাট জেলার অতীত  ঐতিহ্যবাহী পত্রিকা ও সংস্কৃতি
লালমনিরহাটের অতীত ঐতিহ্য অনেক সমৃদ্ধ। বৃটিশ শাসনামলে লালমনিরহাট শুধু পূর্ববঙ্গের বিখ্যাত বেঙ্গল-ডুয়ার্স রেল সংযোগকারী জংশন সমৃদ্ধ রেল শহরই ছিল না, এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ বিমানবন্দর সমৃদ্ধ ঐতিহ্যবাহী প্রসিদ্ধ জনপদ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিল এ লালমনিরহাট। এলাকার গুরুত্ব বিবেচনায় বৃটিশ শাসনামলে লালমনিরহাটে ঘূর্ণায়মান মঞ্চের থিয়েটার হল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ ঘূর্ণায়মান মঞ্চের থিয়েটার হলকে ঘিরে তৎকালে লালমনিরহাটে সংস্কৃতি চর্চার একটা অনুকূল পরিবেশ বিরাজমান ছিল। সঙ্গত কারণেই বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের মধ্যে লালমনিরহাট সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় অনেক এগিয়ে ছিল। এছাড়াও লালমনিরহাটের কাকিনায় তৎকালীন 'কাকিনার জমিদার' বৃহত্তর রংপুরে শিক্ষা-সংস্কৃতির বিকাশে উল্লেখযোগ্য পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেন। বৃটিশ আমলে কাকিনা জমিদারের প্রচেষ্টায় লালমনিরহাটের কাকিনায় ব্রাহ্মসমাজ, বালিকা বিদ্যালয়, হাইস্কুল, থিয়েটার হল, মিউজিয়াম, লাইব্রেরি, ছাপাখানা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে এ অঞ্চলে সাহিত্য সংস্কৃতি বিকাশের পথ প্রশস্থ হয়। কালক্রমে কাকিনা তথা লালমনিরহাট শিক্ষা- সংস্কৃতির এক উর্বর ভূমিতে পরিণত হয়।
পত্রিকা প্রকাশনার ক্ষেত্রেও লালমনিরহাটের রয়েছে সোনালী অতীত ঐতিহ্য। বাংলাদেশের তথা পূর্ববঙ্গের প্রথম সাপ্তাহিক পত্রিকা "রঙ্গপুর বার্তাবহ" রংপুর থেকে প্রকাশিত হলেও ১৮৫৭ সালের ১৩ জুন লর্ড ক্যানিং এর জারীকৃত স্বাধীন মত প্রকাশের অন্তরায় মুদ্রণযন্ত্র আইনের কোপানলে পড়ে রঙ্গপুর বার্তাবহের প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। এসময় কাকিনার জমিদার শম্ভুচন্দ্র রায় চৌধুরী লালমনিরহাটের কাকিনা থেকে "রঙ্গপুর দিকপ্রকাশ" নামে একটি পত্রিকা বের করেন। কথিত আছে কাকিনার 'প্রজাবৎসল রাজা' খ্যাত জমিদার শম্ভুচন্দ্র রায় চৌধুরী তৎকালীন কুন্ডির গোপালপুরের জমিদারের বন্ধ হয়ে যাওয়া "রঙ্গপুর বার্তাবহ" পত্রিকার মালিকানা ক্রয় করে "রঙ্গপুর দিকপ্রকাশ" পত্রিকা প্রকাশ করেন। উল্লেখ্য যে, সে সময়ে এটি ছিল একটি প্রথম শ্রেণির সাপ্তাহিক সংবাদপত্র।
১২৬৭ বঙ্গাব্দের (১৮৬১খ্রিঃ) প্রথম দিন অর্থাৎ ১লা বৈশাখ বৃহস্পতিবার "রঙ্গপুর দিকপ্রকাশ" পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। সে সময় পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন মধুসূদন ভট্টাচার্য এবং সহকারী সম্পাদক ছিলেন তারাশঙ্কর মৈত্রেয়। পত্রিকাটির শিরোনামের আগে ইংরেজিতে জঙঘএঙচঙজঊ উওকচজঙকঅঝঐ কথাটি এবং দক্ষিণ দিক থেকে তোলা কাকিনা রাজবাড়ীর ছবি মুদ্রিত থাকতো। এটি প্রতি বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হতো। এর প্রচার সংখ্যা ৩০০ কপি বলে জানা যায়।
সংগৃহীত তথ্যমতে জমিদার শম্ভুচন্দ্র রায় চৌধুরী, শ্রীধর বিদ্যালংকার, জগবন্ধু তর্কবাগীশ, গুরুচরণ সরকার, যোগেন্দ্র বিদ্যামনি, গোবিন্দ পঞ্চানন, রাজমোহন সার্বভৌম, বিশ্বেন্দ্র বিদ্যারতœ, জানকীনাথ সার্বভৌম, তারাশঙ্কর মৈত্রেয়, হরশংকর মৈত্রেয়, ভারতচন্দ্র গুপ্ত, মুন্সী ফজলার রহমান, গোবিন্দ প্রসাদ রায়সহ এরকম আরও অনেক গুণী লেখকের লেখায় এ পত্রিকাটি সমৃদ্ধ ছিল।
রাজা শম্ভুচন্দ্র রায় চৌধুরী ১৮৬৮ সালে ইহলোক ত্যাগ করেন। এর পরেও "রঙ্গপুর দিকপ্রকাশ" পত্রিকার প্রকাশনা অব্যাহত থাকে। রাজা শম্ভুচন্দ্র রায় চৌধুরীর মৃত্যুর পর তাঁর দত্তকপুত্র রাজা মহিমারঞ্জন রায় চৌধুরী সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা দানের পাশাপাশি এ পত্রিকার প্রকাশনা অব্যাহত রাখেন। সুপন্ডিত হরশংকর মৈত্রেয় এ সময় পত্রিকাটির সম্পাদক এবং গোলকচন্দ্র দাস পত্রিকাটির প্রকাশকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন বলে জানা যায়। এভাবে রঙ্গপুর দিকপ্রকাশ পত্রিকাটি একটি প্রথম শ্রেণির সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসেবে টানা ৪৩ বছর টিকে থাকার রেকর্ড গড়েছিল। "রঙ্গপুর দিকপ্রকাশ" পত্রিকাটিকে "রঙ্গপুর বার্তাবহ" পত্রিকার পর বঙ্গদেশের প্রাচীন পত্রিকা হিসেবে গণ্য করা হয়। লালমনিরহাটের বরেণ্য কবি শেখ ফজলল করিম তাঁর আত্মজীবনী কথায় লিখেছেন," রঙ্গপুর দিকপ্রকাশ প্রাচীন পত্রিকা বঙ্গসাহিত্য সংসারে এক সোমপ্রকাশ ব্যতীত এত পুরাতন কাগজ বোধহয় আর একখানিও নাই।"
এদিকে ১৮৬৪ সালের জানুয়ারি মাসে (পৌষ,১২৭০ বঙ্গাব্দে) কাকিনা শম্ভুচন্দ্র মুদ্রণযন্ত্র থেকে " রচনাবলী" নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। পত্রিকাখানি বেশ উঁচু মানের ছিল বলে জানা যায়। কাকিনা থেকে পত্রিকা প্রকাশ সে যুগের অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা। সে সময় লালমনিরহাটের কাকিনা থেকে শুধু যে "রঙ্গপুর দিকপ্রকাশ" বা "রচনাবলী" প্রকাশিত হয়েছে তা নয়। লালমনিরহাটের প্রথিতযশা কবি শেখ ফজলল করিম কাকিনায় তার নিজ বাড়িতে "সাহাবিয়া প্রিন্টিং ওয়ার্কস" নামে ছাপাখানা স্থাপন করে পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। কবি তাঁর প্রেস থেকে ১৯০৮ সালে "বাসনা" নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন যাতে সমসাময়িক ঘটনাবলীর চিত্র তুলে ধরা হতো। জানা যায়, রাজা মহিমা রঞ্জন পত্রিকাটির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এ পত্রিকাটি দু'বছর চালু ছিল। এছাড়াও কবি ফজলল করিম কাকিনা থেকে 'জমজম' (শিশু মাসিক পত্রিকা), 'কল্লোলিনী', ও 'রতœপ্রদীপ'(হাতে লেখা সাপ্তাহিক) নামের আরও তিনটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। লালমনিরহাটের কাকিনা থেকে একযোগে এতগুলো পত্রিকা প্রকাশ প্রমাণ করে শতবছর আগেও কাকিনা তথা লালমনিরহাটের সাংস্কৃতিক অঙ্গণ অনেক সমৃদ্ধ ছিল।

(লেখক- ইঞ্জিনিয়ার দেলোয়ার হোসেন)
সভাপতি,
লালমনিরহাট সাহিত্য-সংস্কৃতি সংসদ, লালমনিরহাট।)
এই বিভাগের আরও খবর