লালমনিরহাট বার্তা
মানসিক স্বাস্থ্যের সুস্থতার চাবিকাঠি
ড: প্রবীর রায় | ২২ মে, ২০২৪, ৮:১৬ AM
মানসিক স্বাস্থ্যের সুস্থতার চাবিকাঠি

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে স্বাস্থ্য হল মানুষের শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক এই তিন অবস্থার সুস্থ সমন্বয়। এক কথায় সুস্থ বলতে আমাদের রোগমুক্ত সুস্থ শরীর, সব রকম মানসিক চাপ থেকে মুক্ত মন এবং পাশাপাশি সমাজের নানা রকম চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার সক্ষমতা। আর মানসিক স্বাস্থ্য বলতে বোঝায় আমাদের আবেগ (Emotion), আমাদের চিন্তা (Thought) ও আমাদের আচরণ (Behaviour)।

আমরা যতটা আমাদের শারীরিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সচেতন, ঠিক ততটাই উদাসীন আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে। আমাদের স্বাস্থ্যের একটু অবনতি হলেই আমরা ডাক্তারবাবুর পরামর্শ নেই, এমনকি ছোটখাটো শারীরিক দুর্ঘটনা যেমন পড়ে গিয়ে কেটে গেলে আমরা তৎক্ষণাৎ সেই কাটা জায়গায় ওষুধ লাগাই বা জ্বর হলে সঙ্গে সঙ্গে ওষুধের দোকান থেকে একটা জ্বরের ট্যাবলেট কিনে খাই। কিন্তু আমরা কখনো কি আমাদের মন খারাপের জন্য কোন ডাক্তারবাবুর পরামর্শ নেই? বা ওষুধের দোকানে গিয়ে কি বলি দাদা মন খারাপ করছে একটা ট্যাবলেট দিনতো? না! আমরা ডাক্তারবাবুর কাছে যাই না বা ডাক্তারখানা থেকে ওষুধও কিনে খাই না। কারণ আমরা কখনো ভাবি না যে মনেরও রোগ হয়। হ্যাঁ বন্ধুরা মনেরও রোগ হয় এবং মনের রোগ থেকে বাসা বাঁধতে পারে আমাদের শরীরের নানান জটিল রোগ। সুতরাং শরীরের জটিল রোগের হাত থেকে বাঁচতে মানসিক স্বাস্থ্যের সচেতনতা খুব জরুরীl শারীরিক স্বাস্থ্যের একটা সাধারণ প্রবাদ আছে তা হল 'Prevention is better than cure' অর্থাৎ কোন রোগ বাসা বাঁধার পূর্বে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া। মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও এমন প্রতিরোধক মূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়। আসুন আজ আমরা জেনে নিই মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়ার সহজ উপায় যা আমাদের হাতেই আছে।

মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়ার চাবিকাঠি:

1. নিয়মিত শরীর চর্চা: প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর এবং বিকালে 10-15 মিনিট একটু শরীর চর্চা, প্রয়োজনে হাটুন, দৌড়াদৌড়ি করুন। নিয়মিত শরীর শরীরচর্চা করলে আমাদের মস্তিষ্ক থেকে সেরাটোনিন নামক এক ধরনের হরমোন নিঃসৃত হয়, যা মানুষের হাসি খুশি রাখতে সাহায্য করেl

2. পর্যাপ্ত পানি গ্রহণ: দিনে তিন থেকে চার লিটার পানি গ্রহণ করা উচিতl

3. মেডিটেশন: নিয়মিত ১০-১৫ মিনিট মেডিটেশন করলে আমাদের নেতিবাচক চিন্তা বাসা বাঁধতে পারে না l

4. পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ: পুষ্টিকর খাবার খেলে শরীরের পাশাপাশি মানসিক ভাবে আমাদের মনও ভালো থাকে। পুষ্টিকর খাবার আমাদের মস্তিষ্কের আবেগ নিয়ন্ত্রণকারী হরমোনগুলোকে চাঙ্গা রাখতে সাহায্য করেl

5. মিডিয়া এক্সপোজার কমানো: অতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়াতে বেশি থাকলে অর্থাৎ অর্থাৎ স্ক্রীন টাইম বেশি হলে আমাদের দুশ্চিন্তা বেড়ে যায়l আজকাল সোশ্যাল মিডিয়াতে এমন কিছু খবর থাকে যা আমাদের মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্স মিটার হরমোন যেমন ডোপামিন নামক হরমোন অতিরিক্ত ক্ষরণ হয়l ফলে আমাদের নানান রকম দুশ্চিন্তার পাশাপাশি নেতিবাচক চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায় যা পরবর্তীতে নানান মানসিক রোগের সৃষ্টি হয়l

6. নিজের ওপরে বিশ্বাস রাখা: কখনো অন্যের সঙ্গে তুলনা করা একেবারেই বাঞ্ছনীয় নয়l এতে নিজের উপর বিশ্বাস হারিয়ে যায়l ফলে নানান রকম দুশ্চিন্তার পাশাপাশি নেতিবাচক চিন্তারও জন্ম নেয় এবং পরবর্তীতে নানান জটিল মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়।

7. নিজেকে ব্যস্ত রাখা: মন ভালো থাকে এমন কিছু কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখা প্রয়োজন l যেমন বই পড়া, কবিতা লেখা, গান শোনা, গান গাওয়া, খেলাধুলা করা, ক্রিয়েটিভ জিনিস তৈরি করা ইত্যাদি কাজে ব্যস্ত রাখলে মন ও শরীর দুই ভালো থাকেl নিজেকে ব্যস্ত রাখা মানে অতিরিক্ত মোবাইল দেখা নয়।

8. কাজের তালিকা তৈরি করা: রাতে ঘুমানোর আগে পরের দিনের প্রয়োজনীয় কি কি কাজ করতে হবে তার একটা তালিকা তৈরি করাl প্রয়োজনীয় কাজের তালিকা তৈরি থাকলে আমাদের টেনশন অনেক কমে যায়, কাজ করার পর আমাদের অনেক কনফিডেন্ট বেড়ে যায় এবং পরবর্তী কাজ করতে অনুপ্রেরণা দেয়l

9. গল্প করা: বন্ধু-বান্ধব, পরিবার-পরিজনের সাথে সময় করে গল্প করুন, আড্ডা দিয়ে সময় কাটানl এতে আপনার মন ভাল থাকবে আর মন ভালো থাকলেই শরীর ভালো থাকবেl যদি আপনার মনের মধ্যে কোন অহেতুক নেতিবাচক চিন্তা আসে তাহলে বন্ধু-বান্ধব ও পরিবার পরিজনের সঙ্গে তা শেয়ার করুন, দেখবেন তা অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে ভ্যানিশ হয়ে গেছে l

10. Positive self affirmation: প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে কয়েকটা কথা মনে মনে বলুন যেমন: এক 'আমি ভালো আছি' , দুই 'আমি আজ সবার সাথে সুন্দর ব্যবহার করব', তিন 'সবার মঙ্গল কামনা করি', চার 'ছোটদের যত্ন নেব এবং বড়দের সম্মান করবো'l পাশাপাশি পরিচিত মানুষদের সাথে দেখা হলে হেসে কথা বলুন, গুড মর্নিং বলুন। তাহলে আমাদের নিজেদের মন ভালো থাকার পাশাপাশি আমাদের পরিচিত, বন্ধুবান্ধব ও নিকট আত্মীয়ও মানসিক দিক থেকে ভালো থাকবে।

উপরোক্ত নিয়মগুলো পালন করার চেষ্টা করুনl দেখবেন এতে আপনার মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকবে পাশাপাশি আপনার শারীরিক স্বাস্থ্যও ঠিক থাকবে যা আপনার কাজ করার ইচ্ছা বেড়ে যাবে এবং বেঁচে থাকার আনন্দ অনুভব করবেন। ( লেখক- ভারতের কলকাতার ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট)

এই বিভাগের আরও খবর