লালমনিরহাট বার্তা
হালাল ব্যবসার নামে ওয়াজ করে প্রতারণা
বার্তা অনলাইন ডেস্কঃ | ১৪ সেপ, ২০২১, ১০:৩১ AM
হালাল ব্যবসার নামে ওয়াজ করে প্রতারণা
ওয়াজে সুদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে আর হালাল ব্যবসার কথা বলে ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এহসান গ্রুপ। তাদের ব্যবসার পক্ষে কথা কথা বলেছেন দেশের "খ্যাতিমান” অনেক ধর্মীয় বক্তা।
তারা এহসান গ্রুপকে একটি ইসলামী সমাজসেবা প্রতিষ্ঠান হিসেবে তুলে ধরেছেন।
এহসান গ্রুপের বিরুদ্ধে ১৭ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ করেছে র‌্যাব। দেশের দক্ষিণের জেলা পিরোজপুরে অবস্থিত ‘ইসলামী” এই এমএলএম কোম্পনিটির মালিক মুফতি মাওলানা রাগীব আহসান। প্রতিষ্ঠানটিকে কওমী-দেওবন্দের মারকাজ (কেন্দ্র) হিসেবে পরিচিতি করিয়ে দেয়া হয় ওয়াজে।

কুয়াকাটা হজুর নামে পরিচিত মাওলানা হাফিজুর রহমান সিদ্দিক গত বছর পিরোজপুরে এক ওয়াজে বলেন," এহসান গ্রুপ গোটা জাতির জন্য রহমত। ইসলামের হেফাজতে একটি প্রতিষ্ঠানের নাম এহসান।” ওই অনুষ্ঠানে আরো অনেকে বক্তৃতা করেন। কুয়াকাটা হজুর তাদের উদ্ধৃত করে বলেন,"এত আলেমের বক্তব্য শোনার পর এই গ্রুপ নিয়ে প্রশ্ন থাকবে না। যারা আমাদের ভালোবাসেন তারা এহসান নিয়ে কোনো প্রশ্ন করবেন না। আমিও এই গ্রুপের একজন সদস্য। এহসান গ্রুপকে যারা বিশ্বাস করবে না তারা মুনাফেক।”

তার এই ব্যবসায় ওয়াজ করে আরো সহযোগিতা করেন হাটহাজারীর মাওলানা মুফতি মিজানুর রহমান, মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ আইয়ুবি, মাওলানা নুরুল ইসলাস ওলিপুরী। এ নিয়ে কথা বলার জন্য কুয়াকাটা হুজুরকে পাওয়া যায়নি। তবে তার পিএস মাওলানা রফিকুল ইসলাম জানান," অনেক ওলামায়ে কেরাম ওখানে গিয়েছেন। ওয়াজ করে ব্যবসার কথা বলেছেন। তারা তো আর জানতেন না যে এভাবে বন্ধ হয়ে যাবে।” এইসব ওয়াজে মাওলানা রফিকুল ইসলাম নিজেও একাধিকবার গিয়েছেন বলে জানান।


‘মূল টাকা ফেরত চাইলে তার প্রতারণা ধরা পড়ে’
১৭ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে র‌্যাব গত বৃহস্পতিবার প্রতষ্ঠানের চেয়ারম্যান মুফতি মাওলানা রাগীব আহসান ও তার তিন ভাইকে ঢাকায় গ্রেপ্তার করে। ওইদিনই তাদের পিরোজপুর পুলিশের কাছে পাঠানো। সোমবার পিরোজপুরের আদালত তাদের সাত দিনের রিমান্ড দিয়েছে। যে মামলার বিপরীতে তাদের রিমান্ড হয়েছে সেই মামলায় ৯১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ করা হয়েছে।

হালাল ব্যবসার কথা বলে প্রতারণার কৌশল:

মামলাটির অভিযোগকারী পিরোজপুরের হারুনার রশীদ এজাহারে বলেছেন, ২০০৮ সাল থেকে শরিয়ত ভিত্তিক ও সুদমুক্ত হালাল ব্যবসার কথা বলে মানুষের কাছ থেকে টাকা নেয়া শুরু করেন মুফতি মাওলানা রাগীব আহসান । তিনি জানান,"এহসান গ্রুপের মাওলনা রগীব আহসান সুদমুক্ত হালল ব্যবসার প্রচার চালান। তিনি বলেন ইসলামে সুদ মায়ের সাথে জেনার সমান পাপ। তাই হারাম ও সুদভিত্তিক ব্যবসা করা যাবে না। ব্যবসার ওপর লাভের কথা বলে মানুষের কাছ থেকে ব্যাংকের মত টাকা নিতেন। বলতেন আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল এবং সুদকে হারাম করেছেন। কৌশল হিসেবে তাই একই পরিমাণ লাভ না দিয়ে, এক লাখ টাকায় মাসে কখনো দুই হাজার টাকা আবার কখনো এক হাজার ৮০০ টাকা দিতেন। আবার কখনো দুই হাজার ২৫ টাকা দিতেন। বলতেন ব্যবসায় যেরকম লাভ হয় সেরকম দিচ্ছি। কিন্তু মূল টাকা ফেরত চাইলে তার প্রতারণা ধরা পড়ে।”

‘তারা গ্রাহকদের টাকায় কয়েকশ' বিঘা জমি কেনার কথা বলেছিল, সেই জমিও বাস্তবে নাই’
তিনি বলেন," আমি যে মামলাটি করেছি তাতে ৯৫ জনের টাকার হিসাব রয়েছে। আমার আছে ১৬ লাখ টাকা। এরকম কয়েক হাজার গ্রাহক প্রতারিত হয়েছেন। আর এই গ্রাহকদের মধ্যে পুলিশ ও প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তাও আছেন।”
পিরোজপুর এলাকার বিভিন্ন মসজি ও মাদ্রাসার এক হাজারের বেশি ইমাম ও মাওলানা তার সঙ্গে কাজ করতেন। তাদের তিনি পার্টটাইম হিসেবে কাজে লাগাতেন। ফলে ধর্মভীরু লোকজন সহজেই তার প্রতারণার ফাঁদে পড়েন। আর দেশের বিশিষ্ট মাওলানাদের এনে তিনি তার ব্যবসার পক্ষে ওয়াজ নসিহত করাতেন ফলে সবাই বিশ্বাস করত। মুফতি মাওলানা রাগীব আহসানও ভাল বক্তৃতা দিতে পরেন।

তিনি শুরুতে এহসান গ্রুপ নামে কাজ শুরু করলেও পরে ধীরে ধীরে ১৭টি প্রতিষ্ঠান খোলেন। এই প্রতিষ্ঠানগুলো দিয়েই হালাল ব্যবসার কথা বলতেন। প্রতিষ্ঠান গুলো হলো: এহসান গ্রুপ বাংলাদেশ, এহসান পিরোজপুর বাংলাদেশ (পাবলিক) লিমিটেড, এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড বিল্ডার্স লিমিটেড, নুর-ই মদিনা ইন্টারন্যাশনাল ক্যাডেট একাডেমি, জামিয়া আরাবিয়া নুরজাহান মহিলা মাদ্রাসা, হোটেল মদিনা ইন্টারন্যাশনাল , আল্লাহর দান বস্ত্রালয়, পিরোজপুর বস্ত্রালয়-১ ও ২, এহসান মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, মেসার্স বিসমিল্লাহ ট্রেডিং অ্যান্ড কোং, মেসার্স মক্কা এন্টারপ্রাইজ, এহসান মাইক অ্যান্ড সাউন্ড সিস্টেম, এহসান ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস, ইসলাম নিবাস প্রজেক্ট, এহসান পিরোজপুর হাসপাতাল, এহসান পিরোজপুর গবেষণাগার এবং এহসান পিরোজপুর বৃদ্ধাশ্রম।

মামলা দায়েরকারী হারুনার রশীদ নিজেও একটি মাদ্রাসার শিক্ষক। তিনি বলেন, "এক পুলিশ কর্মকর্তার এখানে ২৮ লাখ টাকা আছে। প্রশাসনের এইরকম শতাধিক কর্মকর্তা এখানে টাকা বিনিয়োগ করেছে। তাই সাধারণ মানুষ টাকা দিতে চিন্তা করেনি। পিরোজপুরের সাবেক এসপি গত বছর এক অনুষ্ঠানে এহসান গ্রুপ ১৭ হাজার কোটি টাকা নেয়ার কথা জানালে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে।” এই প্রতারণার ব্যবসা পিরোজপুরের পাশের ঝালকাঠি ও বাগেরহাট জেলায়ও বিস্তার লাভ করে ।
মুফতি মাওলানা রাগীব আহসান এক সময় ঢাকার একটি মসজিদে ইমামতি করতেন। পরে একটি এমএলএম কোম্পানিতে চাকরি নেন। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে গড়ে তোলেন এহসান গ্রুপ। ২০১৯ সালে তিনি প্রথম গ্রেপ্তার হন। তখন গ্রাহকদের দেয়া কিছু চেক ডিসঅনার হয়। এরপর জামিনে মুক্তি পেয়েও তিনি এই ব্যবসা অব্যাহত রাখেন। ইসলামী বক্তাদের তার পক্ষে ওয়াজ করান।
এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী পিরোজপুরের পাবলিক প্রসিকিউর আলাউদ্দিন আহমেদ জানান,"তাদের বিরুদ্ধে মোট দুইটি মামলা হয়েছে। আরো দুইটি মামলা হতে পারে আগামীকাল। আরো অনেক প্রতারিত গ্রাহক মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।”

তিনি জানান,"এহসান গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলো এখন বন্ধ আছে। তারা গ্রাহকদের টাকায় কয়েকশ' বিঘা জমি কেনার কথা বলেছিলো। সেই জমিও বাস্তবে নাই। তাদের এখন যে সম্পদ আছে তা দিয়ে গ্রাহকদের পাওনার সামান্য অংশ মেটানো সম্ভব। ধারণা করা হচ্ছে তারা টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। টাকার খোঁজ জানতেই তাদের চার ভাইকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে।”
এই বিভাগের আরও খবর