লালমনিরহাট বার্তা
আব্দুল কুদ্দুস মাস্টার-একজন স্বপ্ন দ্রষ্টা
মোঃ নজরুল ইসলাম মন্ডল | ৮ ডিসে, ২০২২, ৬:৩৪ AM
আব্দুল কুদ্দুস মাস্টার-একজন স্বপ্ন দ্রষ্টা

লালমনিরহাট জেলার বরেণ্য ব্যক্তিদের সম্পর্কে লিখতে গেলে যে বহুমুখী প্রতিভাধর লোকটির নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে হয় তিনি সমাজে আব্দুল কুদ্দুস মাস্টার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন একাধারে সমাজকর্মী, সাহিত্য-সাংস্কৃতির সংগঠক, শিক্ষার প্রসারে নিবেদিত প্রাণ, রাজনীতির নেতা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, লেখক, গ্রন্থ প্রণেতা ও জনহিতৈষী একজন মানুষ। তাঁকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্বপ্ন দ্রষ্টা বললেও অতিরঞ্জিত হবে না। জীবনে নানাবিধ সমস্যার মাঝে থেকেও তিনি হাসিমুখে এগিয়ে গেছেন কর্ম সম্পাদনে। মাইলের পর মাইল পায়ে হেটে কষ্ট সহ্য করে সমাজ, সাহিত্য, সাংস্কৃতি ও শিক্ষার কল্যাণে তিনি যে অবদান রেখে গেছেন তা আগামী প্রজন্মের জন্য উজ্জল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

লালমনিরহাট জেলার এই বরেণ্য মানুষটির জন্মস্থান নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলাধীন বামুনীয়া গ্রাম। সেখানে তিনি ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ১ আগষ্ট জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আলহাজ¦ রিয়াজ উদ্দিন বসুনিয়া ও মায়ের নাম কুলসুম বেগম। নীলফামারীতে জন্ম গ্রহণ করলেও তার শৈশবের অনেকগুলো বছর কেটেছে ভারতের পশ্চিম বঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার শামুক তোলা গ্রামে। তাঁর পিতা একজন অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থ্য ছিলেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তার পরিবার আলীপুর দুয়ারে থাকলেও ১৯৫২ সালে ভারত থেকে মাইগ্রেশন করে লালমনিরহাট চলে এলে আদিতমারী থানার সাপ্টিবাড়ী ইউনিয়নের দৈলজোরে বসবাস আরম্ভ করেন। তার শিক্ষা জীবন সম্পর্কে যতটুকু জানা যায় তিনি পিতার আবাসস্থল আলিপুর দুয়ার উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত লেখা পড়া করেন। পরবর্তীতে এদেশে এলে রংপুর জিলা স্কুলে অস্টম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে সেখান থেকে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। অত:পরউত্তর বঙ্গের স্বনামধন্য উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কারমাইকেল কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু ভাষা আন্দোলনে জড়িত হবার কারণে নানাবিধ সমস্যা ও পুলিশী হয়রানীর শিকারে পরিণত হলে তার উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের পথে ছেদ পড়ে। পরবর্তীতে তিনি প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে বিএ ডিগ্রী লাভ করেন ও পড়াশুনার ক্ষেত্রে সমাপ্তি টানেন।

শিক্ষা জীবন শেষ হবার পর তিনি রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িত হয়ে দেশ সেবায় ব্রত হন। অত:পর ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত লালমনিরহাট আওয়ামী লীগের সক্রিয় সদস্য এবং প্রথম থানা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির কমিটি লালমনিরহাটে হলে তাকে বসানো হয় সভাপতির পদে। রাজনীতিতে জড়িত থাকার কারণে তাকে রাষ্ট্রীয় জুলুমের সম্মুখীন হতে হয়।

তার নামের সাথে যে মাস্টার নামটা জড়িত সেটা আসে উনিশ শত ষাটের দশকে স্থানীয় চিলড্রেন পার্ক উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কারণে।কিন্তু বিদ্যালয়টি অবাঙ্গালী (বিহারী) প্রভাবিত হওয়ায় চাকুরী থেকে ইস্তফা দিয়ে পরবর্তী জীবনে রাজনীতি, সমাজ সেবা ও প্রতিষ্ঠান গঠন ও গ্রন্থ প্রকাশে মনোনিবেশ করেন। একজন প্রগতিমনা লেখক হিসেবে তার লেখা পাঠক হৃদয়ে স্থান পায় এবং তিনিও খ্যাতি অর্জন করেন। তদানিন্তন দৈনিক বাংলা সহ অন্য অনেক পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তিনি কবি শেখ ফজলল করিমের সাহিত্য সাধনায় আকৃষ্ট ছিলেন বলে বিস্মৃতপ্রায় কবিকে উজ্জলভাবে তুলে ধরার নিরলস প্রচেষ্ঠা চালান। তিনি কবির ৩৮টি কবিতা নিয়ে “শেখ ফজলল করিমের কবিতা” নামে একখানা গ্রন্থ প্রকাশ করে প্রশংসা অর্জন করেন। তার আর একটা স্বপ্ন ছিল “শেখ ফজলল করিম রচনাবলী” শিরোনামে একখানা গ্রন্থ প্রকাশ করা। এ ব্যাপারে তিনি পান্ডুলিপি প্রস্তুত করে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে জমা দেন এবং উক্ত গ্রন্থ তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য ১৯০৪ সালে হোসেন মাহমুদ ও তার যৌথ সম্পাদনায় “শেখ ফজলল করিমের রচনাবলী” গ্রন্থখানা ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশ করে।

নিরলস কর্মী আব্দুল কুদ্দুসের নাম যে সকল প্রতিষ্ঠন গঠনের সাথে জড়িত আছে তার মধ্যে সর্বাগ্রে আসে কবি শেখ ফজলল করিম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নাম। বিদ্যালয়টির সূচনা হয়েছিল ১৯৭৬ সালের শহরের থানা রোডে যেখানে বর্তমানে পৌর প্রাথমিক বিদ্যালয় চলছে সেখানে, শেখ ফজলল করিম শিশু নিকেতন নামে। সে বিদ্যালয় পরে কবির নামে প্রতিষ্ঠিত বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে একীভূত হয়। তার উদ্যোগে লালমনিরহাট সাধারণ পাঠাগারেরও পদযাত্রা শুরু হয়েছিল থানা রোডে। পরে সেটা জেলা পরিষদ মিলনায়তনের পাশে বর্তমান স্থানে চলে যায়। তিনি লালমনিরহাট শহরের সাহিত্য সংগঠন ‘সাহিত্য পরিষদ লালমনিরহাট’ প্রতিষ্ঠার সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠানটি প্রথম সাধারণ সম্পাদক। পরবর্তীতে আমার উপর সম্পাদকের দায়িত্বভার অর্পন করেছিলেন। প্রতিষ্ঠানটি এখন পৌরসভা চত্বরে সগৌরবে চলমান আছে।

তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থে একজন হিতৈষী মানুষ। লালমনিরহাটে ‘সুজন’ নামের একটা প্রতিষ্ঠান গঠিত হলে তিনি সে প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদ অলংকৃত করেছিলেন। তাছাড়া স্থানীয় অনেক সংগঠনের কর্মকান্ডের সাথে জড়িত ছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ও তাকে দেখা গেছে একজন সংগঠক হিসেবে লালমনিরহাটে, এমনকি ভারতেও দায়ীত্ব পালন করতে। স্বাধীনতার পরেও সামাজিক সমস্যা দূরীকরণে তার প্রচেষ্টা অব্যহত ছিল।

আব্দুল কুদ্দুসের সাথে আমার হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তাকে আমি খালু বলে সম্বোধন করতাম। তিনি আমাকে ও আমার সহধর্মিনীকে নাম ধরে ডাকতেন। আমার সন্তানদেরকে আদর করতেন ও তাদের পড়াশুনার খোজ নিতেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন সদালাপী ও বন্ধুবৎসল। পরোপকারী ও হিতৈষী মানুষ হিসেবেও তার ব্যাপক পরিচিতি ছিল।

মানুষ মরণশীল। একদিন সকলকে এ নশ^র পৃথিবী ছেড়ে পরলোকে চলে যেতে হয়। তিনিও দীর্ঘ কর্মময় জীবনের সমাপ্তি টেনে একদিন ইহকাল ত্যাগ করেন। আমার জানামতে তার বুকের ব্যথা অনুভূত হলে তার পুত্র তাকে চিকিৎসার জন্য রংপুরে নিয়ে যান। সেখানে বিভিন্ন রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ডাক্তারের পরামর্শ মতে তাকে নিজ বাড়ীতে বিশ্রামে রাখা হয়। বিশ্রামরত অবস্থায় নিজ বাসভবনে তিনি ইন্তেকাল করেন। তার মৃত্যুর তারিখ ৩ ডিসেম্বর, ২০০৩ খ্রিস্টাব্দ, বুধবার। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭০বছর। তিনি চিরতরে চলে গেছেন এবং যাবার সময় লালমনিরহাটের সাহিত্য, সাংস্কৃতি ও রাজনৈতিক অঙ্গনে যে শুণ্যতা সৃষ্টি করে গেছেন তা বুঝি কোন দিন পূরণ হবার নয়।

সবশেষে পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন এই হিতৈষী মানুষটাকে জান্নাতবাসী করেন।

তথ্যসূত্র : (১) রঙ্গপুরের বরেণ্য ব্যক্তিত্ব : প্রকাশক, রঙ্গপুর গবেষণা পরিষদ, রংপুর। (২) কবি শেখ ফজলল করিমের কবিতা : প্রকাশক, মোঃ আব্দুল কুদ্দুস। (৩) লালমনিরহাট বার্তা : সম্পাদক, বীর মুক্তিযোদ্ধা এসএম শফীকুল ইসলাম।

এই বিভাগের আরও খবর