সীতাকুন্ড ট্রাজেডিতে রংপুরের ফায়ার ফাইটার ফরিদের খোঁজ ৭ দিনেও মেলেনি
রংপুর অফিসঃ | ১১ জুন, ২০২২, ৯:২৮ AM
রংপুরের ফায়ার ফাইটার ফরিদের খোঁজ ৭ দিনেও মেলেনি। চট্টগ্রমের সীতাকুন্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকান্ডের সাত দিন পেরিয়েছে। আজও শনাক্ত হয়নি অগ্নিকান্ডে নিহত ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের মধ্যে তিন জনের মরদেহ।তারেদ একজন হতে পারেন ফায়ার ফাইটার রংপুরের মিঠাপুকুরের ফরিদুজ্জামান ফরিদ। অগ্নিকান্ডের ঘটনার পরদিন সীতাকুন্ডে গিয়ে পরিচয় নিশ্চিত হতে ডিএনএ পরীক্ষার নমুনা দিয়েছেন ফরিদের ভ্যানচালক বাবা ছাইফুল ও মা ফুলমতি। কিন্তু কবে কখন আসবে জীবিত ছেলে বা মরদেহ তা কারও জানা নেই। এখন ফরিদের খোঁজে গ্রামের অনেক মানুষ আসে তার বাড়িতে। গত শনিবার (৪ জুন) রাতে ফায়ার স্টেশনের পাগলা ঘণ্টা বাজতেই দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে অসুস্থ শরীরে আগুন নেভাতে গিয়েছিলেন ফরিদ। এরপর থেকে তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।ফরিদুজ্জামান ফরিদ রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার ইমাদপুর ইউনিয়নের আদারহাট দক্ষিণপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। এক মাস আগে গ্রামের বাড়িতে ছুটি কাটিয়ে ফিরে যান কর্মস্থলে। সীতাকুন্ডে আগুন নেভাতে যাওয়া ইউনিটে ছিলেন ২২ বছর বয়সী তরুণ এই ফায়ার ফাইটার। সেদিন রাতের ভয়াবহ বিস্ফোরণে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনের লেলিহান থামাতে লেগেছে চার দিন। কিন্তু নিখোঁজ সন্তানের অপেক্ষায় থাকা মা ফুলমতি, ভ্যানচালক বাবা ছাইফুল আর ফরিদের স্ত্রী ইসামণির আহাজারি এখনো থামছে না।তাদের গগন বিদারী আহাজারিতে যেন থমকে গেছে আদারহাট দক্ষিণপাড়া গ্রামের আকাশ-বাতাশ।প্রতিবন্ধী অবুঝ ছোট বোন সাবিহা তার ভাইয়ের ছবি হাতে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। ফরিদ কথা দিয়েছিল ছোট বোনের জন্য এবার ঈদুল আজহায় নতুন কাপড় নিয়ে বাড়ি ফিরবে। আর ভ্যানচালক বাবা ছাইফুল মনে স্বপ্ন এঁকেছিলেন বাবা-ছেলে মিলে নড়বড়ে সংসারকে একটু সাজিয়ে নেবেন। ফরিদ একটু স্বাবলম্বী হলেই ছাইফুল ছেড়ে দেবেন ভ্যানের চাকা ঘুরানো।ঈদুল আজহার দ্বিতীয় দিনে বিবাহত্তোর সংবর্ধনা হওয়ার কথা ছিল ফরিদ-ইসামণির ।একে একে সব আশার আলো নিভে গেলেও যদি ফিরে আসে।ছেলের অগেক্ষায় চেয়ে আছেন বৃদ্ধ বাবা-মা ছোট বোন আর নব বধু স্ত্রী। গত সাত দিনে শুধু বেড়েছে দীর্ঘশ্বাস। এখন পুরো গ্রামের মানুষ ফরিদের জন্য অপেক্ষায়। রংপুরের মিঠাপুকুরের ছাইফুল ও ফুলমতি দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে ফরিদুজ্জামান ফরিদ বড়। তার ছোট বোন সাবিহা আকতার পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী।গত২২ মাষ আগে ফরিদ চাকুরীতে যোগ দেন। ৯ মাস আগে সীতাকুন্ডে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সে চাকুরীতে যোগ দেন ফরিদ। তার আইডি নম্বর ১৪৪১। ফরিদের স্বজনরা বলছেন, ফরিদ সম্ভবত বেঁচে নেই। এখনো তো কয়েকজন ফায়ার সার্ভিস কর্মীর মরদেহ শনাক্ত হয়নি। এ কারণে আমরা এখনো ফরিদের অপেক্ষায় আছি। যদি তার মরদেহ পাওয়া যায় তবুও শেষ দেখাটা হবে। ফরিদের জেঠা আমানুল্লাহ সরকার বলেন, ছোটবেলা থেকেই ফরিদ মেধাবী ও শান্ত-ন¤্র স্বভাবের ছিল ফরিদ।আমাদের গ্রামের সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল তার। পরিবারে দুঃখকষ্ট থাকলেও তার বাবা দিনমজুরি ও ভ্যান চালিয়ে ছেলেকে পড়ালেখা করিয়েছেন।অনেক চেষ্টায় সরকারি চাকরিতে ফরিদের সুযোগ হয়। কিন্তু আগুনের ছোবল থেকে অন্যের জীবন বাঁচাতে গিয়ে এক ফরিদের নিখোঁজের করনে অনেকগুলো জীবন অনিশ্চয়তায় কাতরাচ্ছে।ভাতিজা গত বছরের ৩ আগস্ট বিয়ে করেছে। এক মাস আগে বাড়িতে এসেছিল। কোরবানির ঈদে এসে বিয়ের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করার কথা ছিল। নিখোঁজ ফরিদের স্ত্রী ইসামণি স্বামীর কথা ভেবে এখনো বিলাপ করছেন। হাত তুলে সৃষ্টিকর্তার কাছে স্বামীকে ফিরে চাচ্ছেন। আর ফরিদের আদরের বোন প্রতিবন্ধী সাবিহা মোবাইলে ভাইয়ের ছবি নিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। মা ফুলমতি তার প্রিয় সন্তানের কাপড়চোপড়ে লেগে থাকা গায়ের গন্ধে খুঁজছে ফরিদকে। অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বাবা ছাইফুল ইসলাম। কথা বলার মতো পরিস্থিতি নেই তাদের। মিঠাপুকুরের ইমাদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম ডানো বলেন, ফরিদের মা-বাবার অবস্থা ভালো না। ছেলের জন্য কাঁদতে কাঁদতে তারা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। গত রোববার রাতে আত্মীয় স্বজন ও এলাকাবাসীর টাকায় ভাড়া করা অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে সীতাকুন্ডে গিয়ে ফরিদের মা-বাবা ডিএনএ নমুনা দিয়ে এসেছেন। মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফাতেমাতুজ জোহরা বলেছেন, ফরিদুজ্জামান ফরিদের খোঁজে সীতাকুন্ডের কন্ট্রোল রুমে যোগাযোগ অব্যাহত আছে। আমরা উপজেলা প্রশাসন থেকে তার পরিবারের খোঁজখবর রেখেছি। রংপুর ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক ফরিদ আহাম্মদ চৌধুরী জানান, বছর দুয়েক আগে সীতাকুন্ড ফায়ার সার্ভিস স্টেশনে ফায়ার ফাইটার (সিপাহী) পদে যোগ দেন ফরিদুজ্জামান ফরিদ। গত শনিবার রাতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনার পর থেকে তার কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না।