নদ-নদীকে বলা হয় দেশ ও সমাজের জীবন রেখা। তার সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য সঠিক তালিকা ও তথ্য-উপাত্ত দরকার। নদ-নদী মাত্রিক এই দেশে, নদ-নদীর সংখ্যা কত? তা নিয়ে এখনো চলছে তুমুল বিতর্ক!! পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত ৪০৫ টি নদ-নদীর তালিকা নিয়েও অনেক বিভ্রান্তি আছে। কোন কোন বিশেষজ্ঞের মতে এই সংখ্যা এক হাজারের বেশি হবে।
“জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন” চার বছর যাবৎ মাঠ পর্যায়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে সম্প্রতি দেশের নদ-নদীর সংখ্যা (খসড়া) প্রকাশ করেছে, যার সংখ্যা হচ্ছে ৯০৭ টি। এই তালিকার সাথে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত তালিকা বিশদ গড়মিল ও পাল্টাপাল্টি ব্যাখ্যা থাকায় নদ-নদীর সংজ্ঞা, নদ-নদী সমীক্ষার প্রক্রিয়া ও মানদন্ড নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অন্যদিকে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন কর্তৃক প্রকাশিত নদ-নদীর দূষণকারী ও অবৈধ দখলদারদের তালিকা নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। যার ফলে সেই তালিকা এখনো ঝুলে আছে।
নদ-নদীর সংজ্ঞা ও সংখ্যা নিয়ে আলোচনা করতে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখে একটি সভার আয়োজন করেছে। সেখানে সর্স্তরের বিশেষজ্ঞদেরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে; নদ-নদীর সংজ্ঞা, নদ-নদী সমীক্ষার প্রক্রিয়া ও তার মানদন্ড ঠিক না করে কিভাবে এত বড় সমীক্ষা পরিচালনা করা হলো? তাহলে কি ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়া হয়েছে? ফলে, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তাব্যক্তিদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন প্রকাশিত ৯০৭ নদ-নদীর মধ্যে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত তালিকার প্রায় ১৩৯টি নদ-নদী বাদ পড়েছে। কেন বাদ দেয়া হলো? তার প্রতিবেদনসহ ব্যাখ্যা পাওয়া যায় নি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী ও বিশিষ্ট পানি বিশেষজ্ঞ মোঃ ইনামুল হকের “বাংলাদেশের নদ-নদী” বইয়ে ১২১৬টি নদ-নদীর ম্যাপসহ তালিকা পাওয়া যায়।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের খসড়া নদ-নদীর তালিকায় ৯০৭টি নদীর মধ্যে কোন কোন নদ-নদীর প্রশস্ত ও গভীরতার তথ্য দেয়া হয়নি এবং প্রায় ৬৩৩টি নদীর উৎসমুখ ও ৬৩২টি নদীর মিলনস্থলের এর তথ্য উল্লেখ নেই। অন্তত: ১৬টি নদ-নদীর দৈর্ঘ্যের ঘর ফাঁকা রয়েছে এবং অন্তত: ৩৩টি নদ-নদীর দৈর্ঘ্যের কলামে আয়তন বা একর লেখা রয়েছে, যা থেকে নদীর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ অনুমান করা যাচ্ছে না। তালিকায় অনেক স্থান বা উপজেলার নাম ভুল রয়েছে, একই স্থান বা উপজেলার নামে একাধিক বানান লেখা হয়েছে। একই নদীর নাম একাধিকবার উল্লেখ করা হয়েছে যেমন: চামটি নদী। কোন কোন ক্ষেত্রে স্থানের নামকে নদীর নাম বলে উল্লেখ করা হয়েছে যেমন: বিজনা-গুন্দাইজরী, বানিয়াচং নদী। অসংখ্য বানান ও উপজেলোর নাম ভূল করা হয়েছে, যেমনঃ গোলাপগঞ্জকে গোপালগঞ্জ উল্লেখ করা হয়েছে। মাত্র ০.৭০ একর আয়তনের জলাশয়কেও নদী হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ধরনের জলাধার এর প্রস্থ ৩০ মিটার ধরা হলেও দৈর্ঘ্য দাড়াবে প্রায় ৯৪.৪৬ মিটার, যা নদী হিসাবে বিবেচনা করা চলে না; ছোট খাল বা জলাধার হতে পারে। কোন কোন ক্ষেত্রে নদীর উৎস্য ভূল উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন: মহানন্দা নদীর উৎসমুখ কলামে লেখা হয়েছে “ভারত (ভোলাহাট, চাপাই নবাবগঞ্জ)”। এজাতীয় ভূল রয়েছে কমপক্ষে ৫৫টি নদীর ক্ষেত্রে।
যমুনা একটি প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ নদী হলেও এর উৎস বা শেষ অবস্থান জেলা, উপজেলা কোন কিছুই ঠিক নাই। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদী দেখানো হয়েছে হিমালয় ও দেওয়ানগঞ্জ এর উজানে। অসংখ্য নদীর ক্ষেত্রে দেখা যায় জেলা ও উপজেলার অসংগতি অর্থাৎ জেলা আছে তো উপজেলার নাম নাই আবার উপজেলা আছে কিস্তু জেলার নাম নাই। উত্তরখান, খিলখেত, গুলশান, তেজগাঁও, ডেমরা, কর্ণফুলি, বাকলিয়া ও পতেঙ্গাকে বলা হয়েছে উপজেলা। ডাকাতিয়া নদীকে চট্টগ্রাম জেলায় উল্লেখ করা হয়েছে। ৩৩টি নদ-নদীর দৈর্ঘ্যরে স্থানে আয়তন বা একর দেয়া হয়েছে। ৬২টি নদ-নদীর দৈর্ঘ্য এক কি.মি. এর কম দেখানো হয়েছে, যা আদৌ নদ-নদী কি না খতিয়ে দেখতে হবে।
সার্বিক পর্যালোচনায় অনুমান করা যায় যে, এই কাজের প্রক্রিয়ায় ও পেশাদরিত্বে অনেক ঘাটতি ছিল। যথাযথ ভাবে কাজের পরিকল্পনা তৈরী ও তদারকি হয় নি বা সঠিক ভাবে যোগ্যতাসম্পন্নদেরকে কাজে লাগানো হয় নি। এর দায় জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে নিতে হবে। কারণ, ব্যয়িত সময় ও অর্থ জাতির জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ! আবার, বিলম্বিত বা ভূল তথ্য, উদ্যোগ ও পরিকল্পনা প্রণয়নের ফলে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে জাতিকে অনেক বেশি মশুল দিতে হয়।
এমতাবস্থায়, এই তালিকা সংশোধনযোগ্য কি না ভেবে দেখতে হবে। নদ-নদীর সংজ্ঞা, নদ-নদী সমীক্ষার প্রক্রিয়া ও তার মানদন্ড ঠিক করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরসহ প্রতিটি জেলা পর্যায়ে যাদের এই বিষয়ে সঠিক জ্ঞান আছে এবং নিরপেক্ষ ব্যাক্তিগণের সমন্বয়ে সঠিক তালিকা প্রণয়নের কাজ, যতদ্রুত সম্ভব শুরু করা যেতে পারে। একই সাথে আন্ত:সীমান্ত নদ-নদীর সঠিক তথ্যও প্রকাশ করা দরকার। এক্ষেত্রেও অনেক বিভ্রান্তি রয়েছে, তা দুর করা আবশ্যক।