টিপু সুলতানের পুরো নাম হচ্ছে, সুলতান ফতেহ আলী সাহেব টিপু। তার জন্ম ব্যাঙ্গালুর শহরে ১০ নভেম্বর ১৭৫০ সালে। তার পিতার নাম: সুলতান হায়দার আলী খান এবং মাতার নাম: ফাতিমা ফখর-উন-নিসা। ১০ বছর বয়সে বন্দি দশা থেকে ছোটভাইসহ নিজেকে মুক্ত করাসহ বিভিন্ন ঘটনায় তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও সাহসিকতার প্রকাশ ঘটেছে। ১৫ বছর বয়স থেকেই পিতার সাথে বিভিন্ন যুদ্ধে বিরত্বের সাথে অংশগ্রহণ করেছেন। তার পিতা সুলতান হায়দার আলীর প্রচেষ্টায় তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়ন, বিভিন্ন দেশের ভাষা ও অর্থশাস্ত্রে বিদ্যা অর্জন করেন। টিপু সুলতানের উপদেষ্টা হিসেবে ছিলেন পণ্ডিত পুরণাইয়া এবং সরদার গাজী খান এর নিকট থেকে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট তার মিত্র ছিল এবং পারস্যের সাথে সন্ধি স্থাপনে সফল হন। তার শাসনামলে একটি নতুন ক্যালেন্ডারসহ মুদ্রা ব্যবস্থা চালু করেন। পাশাপাশি একটি নতুন ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা যা মহীশূরের রেশম শিল্পের বিকাশের সূচনা করেছিল। ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি পরস্যের প্রযুক্তিতে তৈরী কামান ও রকেট আর্টিলারী ব্যবহার করেছিলেন।
তার পিতা হায়দার আলী ১৭৮২ সালে এক যুদ্ধে মৃত্যু বরন করার পর মাত্র ৩২ বছর বয়সে তিনি রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি একজন ধার্মিক মুসলিম ছিলেন। তিনি মসজিদের পাশাপাশি তার শাসনকালে ১৫৬টি সনাতন বা হিন্দু মন্দিরে নিয়মিত অর্থ বরাদ্দ দিতেন। সেই সময়ে বরাদ্দ পাওয়া এক বিখ্যাত মন্দির হলো শ্রীরাঙ্গাপাটনার রঙ্গন অষ্টমী মন্দির।
শিশুকাল থেকে পিতার কাছে বাঘের অনেক গল্প শুনার কারণে তিনি বাঘ খুব পছন্দ করতেন। তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও সাহস ছিল বাঘের মত। তার আমলে মহীশূরের আয়তনের অনেক বিস্তৃতি লাভ করেছিল। টিপু সুলতানকে ডাকা হতো শের-ই-মহীশূর অর্থাৎ মহীশূরের বাঘ; উপাধিটা ইংরেজদেরই দেয়া। তিনি ১৭৯৯ সালের শেষ যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন কিন্তু পরাজয় স্বীকার করেন নি। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৪৮ বছর।
একইভাবে ১৯৫৭ সালে বাংলার পতনের পর তার স্বাধিনতা উদ্ধার করার প্রয়াসে ১৭৭১ সালে ফকির মজনুশাহ বোরহান (কারো কারো মতে তার প্রকৃত নাম; নূর উদ্দীন মোঃ বাকের জং)এর নেতৃত্বে পাঁচ শতাধিক সুফিদের একটি দল ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। তিনি ও তার দল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং জয় লাভও করেন কিন্তু ১৭৮৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর বগুড়া জেলার কালেশ্বর নামক স্থানে ইংরেজ বাহিনীর সম্মুখীন হন সেই যুদ্ধে ফকির মজনুশাহ বোরহান মারাত্নকভাবে আহত হন এবং তারপর ইংরেজ বাহিনীর দ্বারা নি:সংশভাবে শহীদ হন। তার মৃত্যুর পর তার ভ্রাতুষ্পুত্র ফকির মুশা শাহ নেতৃত্ব দেন, তিনি ও তার দল অনেক যুদ্ধে মাস্কেট ও রকেটের সাহায্যে আক্রমণ পরিচালনা করেন এবং জয়লাভ করেন কিন্তু ১৭৯২ সালে এক লড়াইয়ে তিনিও শহীদ হন। তারপর এই প্রচেষ্টা অনেক দিনের জন্য থেমে যায়। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ ও তারপরবর্তি ঘটনার অনেখানী আমরা জানি এবং অনেকখানী লিখিতও আছে।
আমরা বাংলা, বিহার আর উরিষ্যার ইতিহাসের বাইরে এই উপমাহদেশের অন্যান্য ইতিহাস কমই জানি। বইপত্রও তেমন পাওয়া যায় না। উইকিপিডিয়াসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম ও বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমনকালীন স্থানীয় বিজ্ঞ লোকজনের সাথে আলাপ থেকে কিঞ্চিৎ ইতিহাস জানা যায়। তাছাড়া, ব্রিটিশ রাজের অধিনের লিখিত অনেক ইতিহাসই বিকৃত ও উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে তৈরী করা হয়েছে। আবার অনেক নিদর্শন নষ্ট করা হয়েছে, যেমন; ভেলরে অবস্থিত টিপু সুলতানের রাজ প্রসাদের অনেক কিছুই বর্তমানে নাই, তার বিশাল এলাকা জুড়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, তার মসজিদে প্রবেশ করা যায় না। শুধু তার প্রসাদে অবস্থিত জলকান্দেশ্বর মন্দির ও শ্রী নাগাথেভাধাই আম্মান মন্দির দিনের বেলায় দর্শার্থিদের জন্য খোলা থাকে।
অতি সম্প্রতি, গেরিলা লিডার এসএম শফিকুল ইসলাম (সম্পাদক, লালমনিরহাট বার্তা)সহ কর্ণাটক রাজ্যের ব্যাঙ্গালোরে অবস্থিত টিপু সুলতানের ভবন ও টিপুর জন্মস্থানসহ তামিল নাড়ু রাজ্যের ভেলরে অবস্থিত টিপু সুলতানের প্রাসাদ, মাজার ও বিশ্রামাগার দেখতে যায়। সেখান ভারতের গৌরবপূর্ণ অনেক অজানা ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারি।
এই উপমহাদেশে ১৭৯৯ পর্যন্ত স্বাধিন ও পরাক্রমশালী রাজত্ব ছিল মহীশূর। যা বর্তমানে চারটি আলাদা আলাদা রাজত্বে বিভক্ত: কর্ণাটক, তামিল নাড়ু, কেরালা ও অন্ধ্রপ্রদেশ। এই চার রাজ্য দক্ষিণ ভারতের অংশ। দক্ষিণ ভারতের বাকি রাজ্যসমূহ হচ্ছে; লাক্ষাদ্বীপ, পুদুচেরি ও তেলেঙ্গানা।
মহীশূর অঞ্চলের সভ্যতা অনেক প্রাচীন। কিছু কিছু ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায় যে, পৃথিবীতে মানুষের পদচারণার শুরু থেকে এই অঞ্চলের সভ্যতার সূত্রপাত হয়েছে। তবে, ইতিহাস লেখকের অভাবে অনেক তথ্য ও ঘটনাক্রম এখন পাওয়া যাচ্ছে না। যা পাওয়া যায় তা হলো, সনাতন ধর্মের আগমনের পূর্বে এখানে জৈন ধর্ম ও অদ্বৈতবাদের প্রভাব ছিল। সনাতন ধর্মের পর বৌদ্ধ ধর্ম ও ইসলামের আগমন ঘটে। ব্রিটিশ শাসনের মাধ্যমে এখানে খৃষ্ট ধর্মের আবির্ভাব ঘটে। উল্লেখ্য যে, অত্র এলাকায় উল্লেখযোগ্য কোন ধর্মযুদ্ধের বা দাঙ্গার ঘটনার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। বাহিরের কোন শক্তি তাদেরকে এমন অমানবিক কাজে লিপ্ত করতে পারেনি। সকল ধর্মের মানুষের সহাবস্থান, হাজার বছরের ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে। এখানের মানুষ সহজ-সরল হওয়ায় কথাবার্তা অনেকটা সোজাসাপ্টা, কখনো কখনো তা রসকস বিহীন ও ঊগ্র মনে হয়, কিন্তু আধুনিক ও উচ্চমার্গের কথার মারপ্যাঁচ নাই।
১৭৫৭ সালে বাংলা, বিহার ও উরিষ্যার পতনের পর, অন্যান্য রাজ্যের পতন বা আজ্ঞাবহ রাজ্যে পরিনত হলেও প্রায় ৪২ বছর অতিবাহিত হয়েছে মহীশূরের পতন ঘটাতে। কোন কোন ঐতিহাসিক বর্ণনা করেছেন, টিপু সুলতান বলতেন; “ভেড়া বা শিয়ালের মতো দু'শ বছর বাঁচার চেয়ে বাঘের মতো দু'দিন বেঁচে থাকাও ভালো”।