লালমনিরহাট বার্তা
মহীশূরের বাঘ: টিপু সুলতান
শমশের আলী, ‍বিশেষ প্রতিনিধি | ৩০ সেপ, ২০২৩, ৫:০০ AM
মহীশূরের বাঘ: টিপু সুলতান

টিপু সুলতানের পুরো নাম হচ্ছে, সুলতান ফতেহ আলী সাহেব টিপু। তার জন্ম ব্যাঙ্গালুর শহরে ১০ নভেম্বর ১৭৫০ সালে। তার পিতার নাম: সুলতান হায়দার আলী খান এবং মাতার নাম: ফাতিমা ফখর-উন-নিসা। ১০ বছর বয়সে বন্দি দশা থেকে ছোটভাইসহ নিজেকে মুক্ত করাসহ বিভিন্ন ঘটনায় তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও সাহসিকতার প্রকাশ ঘটেছে। ১৫ বছর বয়স থেকেই পিতার সাথে বিভিন্ন যুদ্ধে বিরত্বের সাথে অংশগ্রহণ করেছেন। তার পিতা সুলতান হায়দার আলীর প্রচেষ্টায় তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়ন, বিভিন্ন দেশের ভাষা ও অর্থশাস্ত্রে বিদ্যা অর্জন করেন। টিপু সুলতানের উপদেষ্টা হিসেবে ছিলেন পণ্ডিত পুরণাইয়া এবং সরদার গাজী খান এর নিকট থেকে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট তার মিত্র ছিল এবং পারস্যের সাথে সন্ধি স্থাপনে সফল হন। তার শাসনামলে একটি নতুন ক্যালেন্ডারসহ মুদ্রা ব্যবস্থা চালু করেন। পাশাপাশি একটি নতুন ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা যা মহীশূরের রেশম শিল্পের বিকাশের সূচনা করেছিল। ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি পরস্যের প্রযুক্তিতে তৈরী কামান ও রকেট আর্টিলারী ব্যবহার করেছিলেন।

তার পিতা হায়দার আলী ১৭৮২ সালে এক যুদ্ধে মৃত্যু বরন করার পর মাত্র ৩২ বছর বয়সে তিনি রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি একজন ধার্মিক মুসলিম ছিলেন। তিনি মসজিদের পাশাপাশি তার শাসনকালে ১৫৬টি সনাতন বা হিন্দু মন্দিরে নিয়মিত অর্থ বরাদ্দ দিতেন। সেই সময়ে বরাদ্দ পাওয়া এক বিখ্যাত মন্দির হলো শ্রীরাঙ্গাপাটনার রঙ্গন অষ্টমী মন্দির।

শিশুকাল থেকে পিতার কাছে বাঘের অনেক গল্প শুনার কারণে তিনি বাঘ খুব পছন্দ করতেন। তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও সাহস ছিল বাঘের মত। তার আমলে মহীশূরের আয়তনের অনেক বিস্তৃতি লাভ করেছিল। টিপু সুলতানকে ডাকা হতো শের-ই-মহীশূর অর্থাৎ মহীশূরের বাঘ; উপাধিটা ইংরেজদেরই দেয়া। তিনি ১৭৯৯ সালের শেষ যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন কিন্তু পরাজয় স্বীকার করেন নি। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৪৮ বছর।

একইভাবে ১৯৫৭ সালে বাংলার পতনের পর তার স্বাধিনতা উদ্ধার করার প্রয়াসে ১৭৭১ সালে ফকির মজনুশাহ বোরহান (কারো কারো মতে তার প্রকৃত নাম; নূর উদ্দীন মোঃ বাকের জং)এর নেতৃত্বে পাঁচ শতাধিক সুফিদের একটি দল ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। তিনি ও তার দল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে অনেক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং জয় লাভও করেন কিন্তু ১৭৮৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর বগুড়া জেলার কালেশ্বর নামক স্থানে ইংরেজ বাহিনীর সম্মুখীন হন সেই যুদ্ধে ফকির মজনুশাহ বোরহান মারাত্নকভাবে আহত হন এবং তারপর ইংরেজ বাহিনীর দ্বারা নি:সংশভাবে শহীদ হন। তার মৃত্যুর পর তার ভ্রাতুষ্পুত্র ফকির মুশা শাহ নেতৃত্ব দেন, তিনি ও তার দল অনেক যুদ্ধে মাস্কেট ও রকেটের সাহায্যে আক্রমণ পরিচালনা করেন এবং জয়লাভ করেন কিন্তু ১৭৯২ সালে এক লড়াইয়ে তিনিও শহীদ হন। তারপর এই প্রচেষ্টা অনেক দিনের জন্য থেমে যায়। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ ও তারপরবর্তি ঘটনার অনেখানী আমরা জানি এবং অনেকখানী লিখিতও আছে।

আমরা বাংলা, বিহার আর উরিষ্যার ইতিহাসের বাইরে এই উপমাহদেশের অন্যান্য ইতিহাস কমই জানি। বইপত্রও তেমন পাওয়া যায় না। উইকিপিডিয়াসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম ও বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমনকালীন স্থানীয় বিজ্ঞ লোকজনের সাথে আলাপ থেকে কিঞ্চিৎ ইতিহাস জানা যায়। তাছাড়া, ব্রিটিশ রাজের অধিনের লিখিত অনেক ইতিহাসই বিকৃত ও উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে তৈরী করা হয়েছে। আবার অনেক নিদর্শন নষ্ট করা হয়েছে, যেমন; ভেলরে অবস্থিত টিপু সুলতানের রাজ প্রসাদের অনেক কিছুই বর্তমানে নাই, তার বিশাল এলাকা জুড়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, তার মসজিদে প্রবেশ করা যায় না। শুধু তার প্রসাদে অবস্থিত জলকান্দেশ্বর মন্দির ও শ্রী নাগাথেভাধাই আম্মান মন্দির দিনের বেলায় দর্শার্থিদের জন্য খোলা থাকে।

অতি সম্প্রতি, গেরিলা লিডার এসএম শফিকুল ইসলাম (সম্পাদক, লালমনিরহাট বার্তা)সহ কর্ণাটক রাজ্যের ব্যাঙ্গালোরে অবস্থিত টিপু সুলতানের ভবন ও টিপুর জন্মস্থানসহ তামিল নাড়ু রাজ্যের ভেলরে অবস্থিত টিপু সুলতানের প্রাসাদ, মাজার ও বিশ্রামাগার দেখতে যায়। সেখান ভারতের গৌরবপূর্ণ অনেক অজানা ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারি।

এই উপমহাদেশে ১৭৯৯ পর্যন্ত স্বাধিন ও পরাক্রমশালী রাজত্ব ছিল মহীশূর। যা বর্তমানে চারটি আলাদা আলাদা রাজত্বে বিভক্ত: কর্ণাটক, তামিল নাড়ু, কেরালা ও অন্ধ্রপ্রদেশ। এই চার রাজ্য দক্ষিণ ভারতের অংশ। দক্ষিণ ভারতের বাকি রাজ্যসমূহ হচ্ছে; লাক্ষাদ্বীপ, পুদুচেরি ও তেলেঙ্গানা।

মহীশূর অঞ্চলের সভ্যতা অনেক প্রাচীন। কিছু কিছু ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায় যে, পৃথিবীতে মানুষের পদচারণার শুরু থেকে এই অঞ্চলের সভ্যতার সূত্রপাত হয়েছে। তবে, ইতিহাস লেখকের অভাবে অনেক তথ্য ও ঘটনাক্রম এখন পাওয়া যাচ্ছে না। যা পাওয়া যায় তা হলো, সনাতন ধর্মের আগমনের পূর্বে এখানে জৈন ধর্ম ও অদ্বৈতবাদের প্রভাব ছিল। সনাতন ধর্মের পর বৌদ্ধ ধর্ম ও ইসলামের আগমন ঘটে। ব্রিটিশ শাসনের মাধ্যমে এখানে খৃষ্ট ধর্মের আবির্ভাব ঘটে। উল্লেখ্য যে, অত্র এলাকায় উল্লেখযোগ্য কোন ধর্মযুদ্ধের বা দাঙ্গার ঘটনার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। বাহিরের কোন শক্তি তাদেরকে এমন অমানবিক কাজে লিপ্ত করতে পারেনি। সকল ধর্মের মানুষের সহাবস্থান, হাজার বছরের ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে। এখানের মানুষ সহজ-সরল হওয়ায় কথাবার্তা অনেকটা সোজাসাপ্টা, কখনো কখনো তা রসকস বিহীন ও ঊগ্র মনে হয়, কিন্তু আধুনিক ও উচ্চমার্গের কথার মারপ্যাঁচ নাই।

১৭৫৭ সালে বাংলা, বিহার ও উরিষ্যার পতনের পর, অন্যান্য রাজ্যের পতন বা আজ্ঞাবহ রাজ্যে পরিনত হলেও প্রায় ৪২ বছর অতিবাহিত হয়েছে মহীশূরের পতন ঘটাতে। কোন কোন ঐতিহাসিক বর্ণনা করেছেন, টিপু সুলতান বলতেন; “ভেড়া বা শিয়ালের মতো দু'শ বছর বাঁচার চেয়ে বাঘের মতো দু'দিন বেঁচে থাকাও ভালো”।

১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজ সেনাপতি হেক্টর মুনরোর ও তার বাহিনীর কাছে দ্বিতীয় মহীশূর যুদ্ধে টিপু সুলতান ও তার বাবা মারাত্মকভাবে পরাস্ত হন এবং মহীশূর রাজ্যের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়, নিহত হয় অনেক সৈন্য। এমনিতেই তিনি প্রচন্ড ইংরেজ বিরোধী ছিলেন, তদুপরি এই পরাজয়ে তিনি আরো বেশি তেজদীপ্ত হয়ে ওঠেন। ঘটনাক্রমে ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে হেক্টর মুনরোর একমাত্র পুত্রসহ সুন্দরবনের সাগর দ্বীপে বাঘ শিকার করতে গিয়ে বাঘ আক্রমণে নিহত হয়। এই সংবাদ পেয়ে টিপুর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়। তিনি এই ধারণা কাজে লাগিয়ে একটি বিচিত্র খেলনা বানিয়েছিলেন, যা সারা দুনিয়ায় "টিপু'স টাইগার" (Tipu’s Tiger) নামে বিখ্যাত হয়ে আছে। ফরাসি যন্ত্রকুশলীদের দ্বারা নির্মিত প্রমাণ আকারের এই খেলনাটিতে ক্লকওয়ার্ক সিস্টেম ব্যবহৃত হয়েছিলো। খেলনায় দম দিয়ে ছেড়ে দিলে এর সাথে লাগানো একটি অর্গান পাইপ থেকে রক্ত হীম করা বাঘের প্রচণ্ড গর্জন, আর এক ইংরেজের প্রচণ্ড গোঙানির আওয়াজ বের হতো। পুরো খেলনাটি ছিলো এরকম: একজন ইংরেজ একটি বাঘের থাবার মধ্যে অসহায়ভাবে পড়ে গোঙাচ্ছে আর একটা বাঘ প্রচন্ড আওয়াজ করে সেই ইংরেজের বুকের উপর চেপে গলা কামড়ে ধরতো। তখন ইংরেজটি তার হাত উঠিয়ে চেষ্টা করতো বাঘের মাথাটি এদিক-ওদিক সরিয়ে দিতে। ভিতরকার যন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসতো মহীশূর সুলতানের প্রিয় গজলের সুর। "টিপু'স টাইগার" বানানোর পিছনে একদিকে যেমন ছিলো তার ইংরেজদের প্রতি উষ্মা, তেমনি অন্যদিকে ছিলো প্রচন্ড ব্যঘ্রপ্রীতি।

কোন কোন ঐতিহাসিকের বর্ণনা মতে, ১৩৯৯ সালে মহীশূর রাজ্য প্রতিষ্ঠা লাভ করে। রাজ্যটি প্রারম্ভিক সময়ে বিজয় নগর সাম্রাজ্যের একটি সামন্ত রাজ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল, যার বেশিরভাগ অংশের জন্য সনাতন ধর্মালম্বি ওয়াদিয়ার পরিবার কর্তৃক প্রতিষ্ঠা ও শাসিত হতো। সপ্তদশ শতাব্দীতে রাজ্যটির অবিচ্ছিন্ন প্রসার ঘটে এবং নরসরাজ ওয়াদিয়ার ও চিক্কা দেবরাজ ওয়াদিয়ারের শাসনামলে এই রাজ্যকে বর্তমান সময়ের দক্ষিণ কর্ণাটক ও তামিলনাড়ুর কিছু অংশকে নিয়ে দাক্ষিণাত্যে একটি শক্তিশালী রাজ্য হিসাবে গড়ে তোলে।

পরবর্তিতে সংক্ষিপ্ত মুসলিম শাসনামলে (১৭৬১-১৭৯৯), রাজ্যটি সুলতানি রীতির প্রশাসনে স্থানান্তরিত হয়। এই সময়কালে মহীশূর মাথাপিছু আয়ের টেকসই বৃদ্ধি, অর্থনীতিতে কাঠামোগত পরিবর্তন, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের গতি বৃদ্ধি পায় ও সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক উচ্চতায় পৌঁছায় এবং ১৮তম শতাব্দীর শেষার্ধে প্রকৃত শাসক হায়দার আলী এবং তাঁর ছেলে টিপু সুলতানের অধীনে সামরিক শক্তি ও আধিপত্যের সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছে যায়।

সেই সময় মহীশূরকে ভারতের শিল্প ও সংস্কৃতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসাবে আবির্ভূত হয়। মহীশূর সুলতান ও রাজারা কেবল চারুকলা ও বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ হিসাবে পারদর্শী ছিলেন না, তারা পাশাপাশি উৎসাহি ও পৃষ্ঠপোষকও ছিলেন এবং তাদের উত্তরাধিকারীরা আজও রকেট বিজ্ঞান, সংগীত এবং শিল্পকে প্রভাবিত করে চলেছে।

সুলতান হায়দার আলী খান একজন নিরক্ষর কিন্তু খুবই বুদ্ধিদীপ্ত ও শক্তিমান ব্যাক্তিত্ব ছিলেন। তার জন্ম ১৭২০ সালে কোলার কর্ণাটক রাজ্যের কোলার জেলায়। তার পিতা ফাতাহ মাহমুদ একই স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। ফাতাহ মাহমুদ কর্ণাটিক নবাবের সেনাবাহিনীতে বাঁশের রকেট আর্টিলারিতে (যা প্রধানত সংকেত দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হতো) ৫০ জন সৈন্যের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি অবশেষে মহীশূর রাজ্যের ওয়াদিয়ার রাজাদের চাকরিতে প্রবেশ করেন, যেখানে তিনি একজন শক্তিশালী সামরিক কমান্ডার হয়ে ওঠেন। ওয়াদিয়াররা তাকে জায়গির (জমি অনুদান) হিসাবে বুডিকোট প্রদান করে, যেখানে তিনি নায়েক হিসাবে কাজ করেছিলেন।

ফাতাহ মুহাম্মদ এক যুদ্ধে মারা যাওয়ার পর হায়দার আলী ও তার ভাই শাহবাজ সামরিক চাকরিতে প্রবেশ করেন। আর্কটের শাসকদের অধীনে বেশ কয়েক বছর চাকরি করার পর, তারা শ্রীরঙ্গপত্তনায় আসেন, যেখানে হায়দারের চাচা কাজ করতেন। তিনি তাদের পরিচয় করিয়ে দেন দেবরাজ, দ্বিতীয় কৃষ্ণরাজা ওয়াদিয়ারের দালওয়াই (মুখ্যমন্ত্রী, সামরিক নেতা এবং ভার্চুয়াল শাসক) এবং তার ভাই নাঞ্জরাজার সাথে, যিনি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী পদেও ছিলেন। তিনি হায়দার আলী এবং শাহবাজকে মাহীশূরের সেনাবাহিনীতে কমান্ডার হিসাবে নিয়োগ করেন; হায়দার আলী ও শাহবাজ একশ অশ্বারোহী এবং দুই হাজার পদাতিক বাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

নিজে নিরক্ষর হওয়ার কারণে কর্মজীবনের শুরুর দিকে, হায়দার আলী তার প্রধান আর্থিক সহকারী হিসেবে খান্ডে রাও নামে একজন ব্রাহ্মণ পণ্ডিতকে নিয়োগ করেছিলেন। তবে, হায়দার আলী একজন অসাধারণ স্মৃতিশক্তি এবং সংখ্যাগত বুদ্ধিমত্তার অধিকারী ছিলেন বলে জানা গেছে। তার দুর্দান্ত গাণিতিক দক্ষতার সাথে বিশেষজ্ঞ হিসাব রক্ষকদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বা ছাড়িয়ে যেতে পারতেন। তিনি খান্ডে রাও-এর সাথে এমন একটি পদ্ধতি তৈরি করতে কাজ করেছিলেন, যাতে হিসাবের বিবরণগুলি এতটাই পরিশীলিত ছিল যে সমস্ত ধরণের ভৌত পণ্য ও সমস্ত ধরণের আয়-ব্যয়ের হিসাবে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। জালিয়াতি বা আত্মসাতের জন্য সামান্য সম্ভাবনা ছিল না। তার পাশাপাশি হায়দার আলীর বুদ্ধি, যুদ্ধ কৌশল ব্যবহার করে পর পর বেশ কয়েকটি যুদ্ধে জয়লাভ করায় অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে ১৭৫৯ সালে সেনা প্রধানের দায়িত্ব পেয়ে যান।

কিন্তু, ওয়াদিয়ারের রাজ পরিবারের মধ্যকার বিরোধ, খান্ডে রাও এর বিশ্বসঘাতকতা ও রানী মাতার ষড়যন্ত্রমূলক প্ররোচনায় ১৭৬০ সালে হায়দার আলীকে শ্রীরঙ্গপত্তনা থেকে বের করে দেওয়া হয় এবং শিশু টিপু সুলতানসহ পরিবারের সদস্যদেরকে বন্দি করা হয়। টিপু সুলতান মাত্র ১০ বছর বয়সে জানালার লোহার শিক ভেঙ্গে তার ছোটভাইসহ বন্দি দশা থেকে পালিয়ে যায়। পরবর্তিতে অধিকাংশ সেনা সদস্যদের সমর্থন পেয়ে হায়দার আলী ১৭৬১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে উৎখাত করে এবং রাজা দ্বিতীয় কৃষ্ণরাজ ওয়াদেয়ারকে তার নিজের প্রাসাদে বন্দী করার পর মহীশূরের রাজা হন।

তার পরই মহীশূর রাজ্য মারাঠা, হায়দ্রাবাদের নিজাম, ট্রাভানকোর রাজ্য ও ব্রিটিশদের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে, যা চারটি ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয়। প্রথম ইঙ্গ-মহীশূর যুদ্ধে সাফল্য পায়, দ্বিতীয়টিতে অচলাবস্থার পরে, তৃতীয় ও চতুর্থ যুদ্ধে পরাজয় ঘটে। শ্রীরঙ্গপত্তন অবরোধের সময়ে চতুর্থ যুদ্ধে টিপুর সুলতানের শহীদ হওয়ার পরে ব্রিটিশদের দ্বারা তাঁর রাজ্যের বিশাল অংশ দখল হয়ে যাওয়ার ফলে, যা দক্ষিণ ভারতে মাহীশূরীয় আধিপত্যের সমাপ্তি ঘটে। ১৩৯৯ সালে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর থেকে শতাধিক যুদ্ধ বিগ্রহের কারণে রাজ্যের শক্তি ও সামর্থ্য কিছুটা বৃদ্ধি ঘটলেও সার্বিক অর্থে অনেকখানী কমেছিল। এরই ফলাফল হিসাবে ৪২ বছর পর হলেও ব্রিটিশ বাহিনীর চুড়ান্ত বিজয় হয় এবং পুরো ভারত একক নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।

এরপর ব্রিটিশরা অধীনতামূলক মিত্রতার মাধ্যমে ওয়াদিয়ারদেরকে তাদের হারানো সিংহাসনে পুন:প্রতিষ্ঠা করে এবং ক্ষয়িষ্ণু মহীশূর একটি অধিনস্ত রাজ্যে রূপান্তরিত হয়। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পরে ১৯৪৮ সালে মহীশূর ভারতীয় ইউনিয়নে যুক্ত হওয়ার পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত ওয়াদিয়াররা রাজ্য শাসন অব্যাহত রাখে।

সুলতান হায়দার আলী ও টিপু সুলতান আমলের কিছু নিদর্শন এখনো দেখা যায়। যেমন; কর্ণাটক রাজ্যে: ব্যাঙ্গালোরে টিপুর জন্মস্থান, টিপু সুলতানের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ ও দূর্গ, ইত্যাদি। মহীশূরে টিপু সুলতান ঈদগাঁ, টিপু সুলতান পার্ক, টিপু সুলতান লঙ্গরখানা, টিপু সুলতান ট্রাস্ট, ইত্যাদি। তামিল নাড়ু রাজ্যের নাগল নগরে টিপু সুলতান স্মৃতি মহল, ভেলরে টিপু সুলতান দুর্গ ও পারামাকুদিতে টিপু সুলতান মাঠ, ইত্যাদি। কেরালা রাজ্যে: সুলতানের সংগ্রহশালা, পালাক্কাদ দরবার, মসজিদ, ইত্যাদি। তাছাড়াও বিভিন্ন স্থানে টিপু সুলতান ও তার পিতার সহায়তায় নির্মিত অনেক মসজিদ ও মন্দির রয়েছে। উল্লেখ্য যে, মহীশূর রাজ্যের মধ্যে ব্যাঙ্গালুর অনেকখানী নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল। বাকি অঞ্চলসমূহে খরা বা রৌদ্রতাপের তীব্রতা অনেক বেশি। তাই গ্রীষ্মকালে টিপু সুলতান ব্যাঙ্গালোরের প্রসাদ ব্যবহার করতেন।

ভগবান এস গিদোয়ানি কর্তৃক লিখিত টিপু সুলতানের জীবনী ও কিংবদন্তী বিষয়ে ঐতিহাসিক উপন্যাস যার শিরোনাম হচ্ছে, টিপু সুলতানের তরবারি (The Sword of Tipu Sultan)। উপন্যাসটি একটি অন্যতম সর্বোচ্চ বিক্রিত বই, প্রকাশিত হওয়ার পর যার প্রায় দুই লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছিল। এই উপন্যাসের বহু ভাষায় অনুবাদ প্রকাশিত এবং ৪৪টি সংস্করণের পুনর্মুদ্রণ প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৯০ সালে এই উপন্যাস অবলম্বনে তৈরী হয়েছে ৬০ পর্বের টিভি সিরিয়াল। বাংলাসহ যা বিশ্বের প্রায় ১০ টি ভাষায় প্রচারিত হয়েছে।

ভারতীয় উপমহাদেশে টিপু সুলতানের তলোয়ারের কথা সবারই জানা। এক সময় বাংলাদেশে সোর্ড অফ টিপু সুলতান নামে যে ধারাবাহিক টিভি নাটক দেখানো হতো তা ছিল অনেক জনপ্রিয়। টিপু সুলতান ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের দক্ষিণের মহীশূর রাজ্যের শাসক। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তাঁর অসীম সাহসীকতার জন্য তিনি ইতিহাসে পেয়েছেন বীরের মর্যাদা। সেই সাথে যোদ্ধা টিপুর সেই তলোয়ারটিও হয়ে উঠেছিল সাহসীকতার প্রতীক।

গত মে ২০২৩ মাসে লন্ডনের বনহ্যামস নিলাম হাউসে ১৮ শতকের প্রখ্যাত ভারতীয় শাসক টিপু সুলতানের তলোয়ারটি এক কোটি ৪০ লাখ পাউন্ড অর্থাৎ প্রায় ১৮৬ কোটি টাকায় বিক্রি হয়েছে। যা সবার কাছে সোর্ড অফ টিপু সুলতান নামেই পরিচিত। বনহ্যামস কর্তৃপক্ষ এক বিবৃতিতে জানান, তাদের নিলাম হাউসে এখন পর্যন্ত বিক্রি হওয়া ভারতীয় এবং ইসলামী ঐতিহ্যবাহী কোনো জিনিসের এটাই সর্বোচ্চ দাম। এটি ধারণার চেয়ে সাত গুণ বেশি দামে বিক্রি হয়েছে। দেশপ্রেম ও দেশের জন্য আমৃত্যু লাড়াকু এই নেতা মাত্র ১৬ বছরের শাসন ও আত্নত্যাগের কারণে আজও আলোচনার মধ্যমণি হয়ে আছে।

ব্রিটিশ সম্রাজ্যবাদ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ একমাত্র টিপু সুলতান তৈরী করতে পেরেছিলেন। নিজের সৈন্যদের মধ্যে কারো কারো শঠতা, পার্শ্ববর্তি রাজ্যের অসহযোগিতা ও বিরোধিতা তাঁকে পরাজিত করতে পেরেছিল। ওয়াদিয়ারের রাজ পরিবার ১৭৯৯ সালে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পনী কর্তৃক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে নিরবিচ্ছিন্নভাবে প্রায় দেড়’শ বছর ছিল কিন্তু ইতিহাসে তেমন কোন স্থান করে নিতে পারে নি।

এখনো টিপু সুলতানের জন্মভূমি দক্ষিণ ভারতে কর্ণাটক রাজ্যে, এখনো রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে টিপু সুলতানের জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকী নিয়মিত পালন করা হয়। যদিও ২০১৫ সাল থেকে কিছু প্রভাবশালী ব্যাক্তি এই দিবস পালনে বিরোধিতা করে আসছিল। কিন্তু তারা ধর্ম, বর্ণ ও সাম্প্রদায়িকতার অনেক উর্ধে দেশপ্রেমের চিন্তায় নিজেদেরকে জাগ্রত করতে পেরেছে বিধায় টিপু সুলতানের বিরত্ব ও আত্নত্যাগকে স্মরনীয় করে রেখেছে। দক্ষিণ ভারতের সংস্কৃতি, শিল্প ও সাহিত্যের মান অনেক এগিয়ে আছে যার ফলে, তাদের তৈরী নাটক ও চলচিত্র অনেক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। দক্ষিণ ভারতের রাজ্য সমূহের ভাষা যেমন: তামিল, কন্নড়, তেলুগু, মালয়ালাম এর সাথে হিন্দি, বাংলা, উরিয়া, উর্দু, ভোজপুরী, নেপালী, কাশ্মিরী, মিজু, গারো, খাসীয়া, অসমিয়া, মারাঠি শব্দের মিল না থাকায় অন্যান্য রাজ্যের সাথে তাদের মৌখিক যোগাযোগ তেমন বৃদ্ধি পায় নাই। তবে, দক্ষিণ ভারত বিশেষ করে তামিল নাড়ু ও কেরালা রাজ্য, ভারতের সাথে নৌপথে পুরো আরব, আফ্রিকা, অষ্ট্রেলিয়া ও শ্রীলংকার সাথে যোগসূত্র স্থাপনে আবহমানকাল থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। ভৌগোলিকভাবে, এই এলাকার জমি শক্ত ও ঊঁচু পাথরের উপর স্থাপিত, তাই সমুদ্রের নীচে তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি কম।

এই বিভাগের আরও খবর