লালমনিরহাট বার্তা
মওলানা ভাসানীর খাদেম জয়নাল আবেদীন
বিশেষ প্রতিনিধি | ৩০ জুল, ২০২৩, ৮:১৩ AM
মওলানা ভাসানীর খাদেম জয়নাল আবেদীন

মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মুসাফির খানা ও মাযারের খাদেম জয়নাল আবেদীন (১০৫) সুদীর্ঘ প্রায় ৯০ বছর ধরে খেদমতে রয়েছেন।

তার পিতার নাম সুকুর মামুদ, গ্রাম: কুচবাড়ী, ইউনিয়ন: মগড়া, জেলা: টাঙ্গাইল, সে মাত্র ১৩ বছর বয়সে মাওলানা ভাসানীর কাছে বয়াত গ্রহণ করে। সেই থেকে তার খেদমতে নিয়োজিত আছেন। তার পিতা তাকে মওলানা ভাসানীর কাছে অর্পণ করেন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আয়ুর খানের নির্দেশে ষাট দশকে মাওলানা ভাসানীকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি বন্দী অবস্থায় জেলখানার দেওয়া খাবার না খেয়ে তিন দিন অনাহারে ছিলেন। অতঃপর কর্তৃপক্ষ বাধ্য হন তাকে একজন পাচক কাম বাজার সরবরাহকারী নিয়োজিত করার জন্য। সেই বাজার সরবরাহকারী ও পাচক ছিলেন জয়নাল আবেদীন।

মওলানা ভাসানীর বক্তব্য ছিল তোমার খাদ্যের মধ্যে বিষ মিশিয়ে আমাকে হত্যা করতে পারো, তোমরা আমার শত্রæ, তাই আমি তোমাদের সরবরাহকৃত খাদ্য কোন অবস্থায় খাব না। অনাহারে মৃত্যু হলেও না। তখন মওলানা ভাসানী ধানমন্ডির একটি বাসায় গৃহবন্দী ছিলেন। সেই গৃহকেই জেলখানা হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। বাসার চারপাশে আর্মি ও পুলিশ পাহারায় নিয়োজিত ছিলেন।

ধানমন্ডির ঘোষিত জেলখানায় মাওলানা ভাসানী তার মুরিদের মেয়ের সঙ্গে তাকে বিবাহ সম্পাদন করে দেন। বিবাহ পড়ান মাওলানা ভাসানী নিজেই। প্রায় তিন বছর জেলে থাকার পর মাওলানা ভাসানী জেলখানা থেকে ছাড়া পেয়ে সন্তোষে আসলেন। তিনিও হুজুরের সঙ্গে চলে এলেন। মওলানা ভাসানী জেলখানা থেকে মুক্তি পেয়ে সভা সমাবেশ করতে শুরু করেন, বিভিন্ন জেলায় গমন করেন। তার শ্বশুর বাড়ি জয়পুরহাটের পাঁচবিবি এবং কুড়িগ্রাম জেলার ভুরুঙ্গামারীর বাড়িতে যেতেন। হুজুর মওলানা ভাসানী তার মুরিদদেরকে সৎ, সত্য ও ন্যায়ের পথে চলার পরামর্শ দিতেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ও অজিফায় মনোনিবেশ করতে নির্দেশ দিতেন। মুরিদদের খোঁজ খবর রাখতেন, তাদের ভালো কাজে উৎসাহিত করতেন। মন্দ কাজ থেকে বিরত পরামর্শ দিতেন। মুরিদদের দুঃখ কষ্টে সার্বিক সহায়তা প্রদান করতেন। মুরিদ ও তাদের সন্তানদেরকে তিনি নিজের সন্তান এবং নাতি-নাতনি হিসেবে দেখতেন।

তিনি জানালেন, মাওলানা ভাসানী হুজুরের কাছে রাতে বেড়াতে-দিনে দুপুরে বরেণ্য রাজনৈতিক নেতা, শিল্পী, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, গবেষক, লেখক, কবি, কবিয়াল, কৃষক, শ্রমিকসহ সর্বস্তরের মেহনতী সাধারণ মানুষ আসেন দেখা করতেন, দোয়া নিতেন, পরামর্শ নিতেন। মওলানা ভাসানীর নিকট হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আতাউর রহমান খান, অলি আহাদ, কাজী জাফর আহমেদ, আব্দুল মান্নান, জাফর উল্লাহ চৌধুরী, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো, বাঘা কাদের সিদ্দিকী, আবুল মুকসুদ, আবুল মান্নান ভুইঞ্চা, কবি বুলবুল খান মাহবুব, ছাত্রনেতা আতিকুর রহমান ছালুসহ অনেকের আসতেন।

মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানীর দরবারে প্রতিদিন শত শত মানুষ আসতেন, হুজুর তাদের খাওয়াতেন, তাদের অভিযোগ শুনতেন, দোয়া করতেন। তবে কেউ খালি হাতে আসতেন না। হুজুরের খেদমতে টাকা পয়সা, চাল-ডাল, তেল, লবণ, তরী তরকারি, দুধ, মাছ, মাংস, মিষ্টি, দই, মিষ্টান্ন, কলাসহ বিভিন্ন ফলফলাদি নিয়ে আসতেন, যা দিয়ে আগত মেহমানদের আপ্যায়ন করা হতো। হুজুরের দরবারে প্রতিটি ধর্মীয় উৎসব মহাধুম ধামের সাথে পালন করা হতো। দরবার হলে মুর্শিদী, গণ সংঙ্গীত ও ভাব সংগীত পরিবেশিত হতো, চলতো জিকির, ছামা ও তবারক বিতরণ।

খাদেম জয়নাল আবেদীন ভারাক্রান্ত মনে মাওলানা ভাসানীর সর্বশেষ সন্তোষ ত্যাগের বিষয়ে জানালেন। তিনি বললেন হুজুর মক্কা অর্থাৎ খানায়ে কাবা ও নবীর মাযার জিয়ারতে যাওয়ার জন্য সন্তোষে সকলের কাছে বিদায় নিলেন। কিন্তু আল্লাহ পাকের কি ইচ্ছে? তিনি হজে যেতে পারলেন না বরং কিছুদিন পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১৯৭৬ সালে ১৭ নভেম্বর ইন্তেকাল করলেন। হুজুর ভাসানী লাশ স্মৃতি বিজরিত সন্তোষে নিয়ে আশা হলো। ঢাকায় এবং সন্তোষে লাখো মানুষ অশ্রু সজল নয়নে তাকে বিদায় জানালেন। তিনি সন্তোষের মাটিতে শায়িত রয়েছেন। প্রতিদিন রাতে শত শত মুরিদ, ভক্ত ও অনুসারীরা তার মাযারে আসেন। ফাতেয়া শরীফ পাঠ ও মাযার জিয়ারত করে দোয়া করেন। আল্লাহ্র অনুগ্রহ লাভের আশায় আত্মতৃপ্ত হয়ে ফিরে যান।

এই বিভাগের আরও খবর